দলীয় ‘হুঁশিয়ারি’ শঙ্কুদেবকেও
সুরেন্দ্রনাথে ক্লাস চালু রাখতে নির্দেশ মমতার
তিনি যে রাজধর্ম পালনের দিকে এগোতে চান, সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ক্লাস চালু রাখার নির্দেশ দিয়ে সেটা আরও এক বার বুঝিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দলীয় রাজনীতির কবল থেকে মুক্ত করার যে প্রতিশ্রুতি তাঁরা দিয়েছিলেন, ভাঙড় কলেজ নিয়ে আরাবুল ইসলাম বা শঙ্কুদেব পণ্ডার আচরণে তার বিপরীত চিত্র ফুটে ওঠায় দিন কয়েক আগে ক্ষোভ জানিয়েছিলেন মমতা। আরাবুলের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়ে এবং শঙ্কুদেবকে সংযত হতে বলে এ ব্যাপারে দলের অবস্থান তখন স্পষ্ট করে দেন তিনি।
কিন্তু তাতেও এ জাতীয় ঘটনাপ্রবাহ থেমে থাকেনি। তৃণমূলেরই দুই গোষ্ঠীর ঝগড়ায় সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ক্লাস বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাঁর নির্দেশ কেন নিচু স্তরের কোনও কোনও নেতার বোধগম্য হচ্ছে না, সে সম্পর্কে বৃহস্পতিবার ফের মুখ্যমন্ত্রী দলীয় স্তরে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। শুধু তা-ই নয়, দিল্লি থেকেই শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে নির্দেশ দিয়েছেন, সুরেন্দ্রনাথে যেন ক্লাস চালু থাকে। তিনি যে এই ধরনের ঘটনা আর বরদাস্ত করবেন না, এই নির্দেশের মাধ্যমে সেই বার্তাই আরও এক বার দিলেন ‘প্রশাসক’ মমতা। মুখ্যমন্ত্রীর সেই নির্দেশের জেরে আজ, শুক্রবার থেকে নিয়মিত ক্লাস চালু হচ্ছে সুরেন্দ্রনাথ সান্ধ্য কলেজে।
শঙ্কুদেব পণ্ডার ‘মদতে’ বহিরাগত দুষ্কৃতীদের তাণ্ডবে ১৫ মে পর্যন্ত ক্লাস বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সুরেন্দ্রনাথ সান্ধ্য কলেজের কর্তৃপক্ষ। মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের পরে, এ দিন সন্ধ্যায় শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করে কলেজ খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পূর্ণচন্দ্র মাইতি বলেন, “রাজ্যের শিক্ষা-অধিকর্তার সঙ্গে কথা হয়েছে। উনি সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন। তাই শুক্রবার ক্লাস চালু হবে।”
গত শনিবার বহিরাগত এক দল যুবক বাঁশ-লাঠি-রড নিয়ে কলেজে ঢুকে ভাঙচুর চালায় ও ছাত্র-শিক্ষাকর্মীদের মারধর করে বলে অভিযোগ। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেন কলেজ-কর্তৃপক্ষ। মুখ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীকে ঘটনার কথা জানানো হয়। ব্রাত্যবাবু এ দিন বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী চান, কলেজে যেন নিয়মিত পঠনপাঠন হয়। প্রয়োজনে আমি নিজে কলেজের পরিস্থিতি দেখতে যাব। কিন্তু পড়াশোনা বন্ধ রাখা যাবে না।” পাশাপাশি শঙ্কুদেবের কার্যকলাপকে মমতা যে মোটেই ভাল চোখে দেখছেন না, তৃণমূল নেতৃত্বের তরফে তা এ দিন ওই ছাত্র-নেতাকে ফের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ছাত্র, শিক্ষক বা পরিচালন সমিতির হাত ধরে দলতন্ত্রের দাপট দীর্ঘকাল ধরেই এ রাজ্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ‘ঐতিহ্যের’ চেহারা নিয়েছে। শিক্ষাজগতের সঙ্গে যুক্ত অনেকেরই বক্তব্য: বাম জমানায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণের রাশ থাকত আলিমুদ্দিনের হাতে। তাই সেগুলো বহু ক্ষেত্রেই স্থানীয় বাম নেতাদের ‘মনসবদারি’র কেন্দ্র হয়ে উঠত। রাজ্যে পালাবদলের পরেও ছবিটা পাল্টায়নি বলে ওই মহলের আক্ষেপ। তাঁদের মতে, নতুন জমানাতেও বহু ক্ষেত্রে কলেজে ‘রাজনৈতিক দখলদারি’র পরিবর্তন হয়নি। পাল্টেছে শুধু দলীয় আনুগত্যের রং!
বাস্তবিকই দেখা যাচ্ছে, যে সব কলেজে কিছু দিন আগে পর্যন্ত পরিচালন সমিতির মাথায় ছিলেন বাম নেতা বা অনুগামীরা, সেখানে এখন তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের ভিড়। মমতা যতই চান না কেন, এই পথে শিক্ষাঙ্গনে দলতন্ত্রের থাবা ঠেকানো সম্ভব নয় বলে মনে করছেন শিক্ষাব্রতীদের অনেকে। ব্রাত্যবাবু অবশ্য এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে চাননি। তবে পূর্বতন বাম সরকারের উচ্চ শিক্ষামন্ত্রী সুদর্শন রায়চৌধুরীর দাবি, “আমাদের সময়েও পরিচালন সমিতিতে বামপন্থীরা থেকেছেন। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই তাঁরা ছিলেন শিক্ষানুরাগী, এবং নিজেদের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। এখন যা হচ্ছে, তার সঙ্গে আগের অবস্থার তুলনাই চলে না।”
উপরন্তু সম্প্রতি এমনও দেখা যাচ্ছে যে, তৃণমূলের একাধিক গোষ্ঠীর পারস্পরিক বিবাদে কলেজের স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিঘ্নিত হচ্ছে। দিন কয়েক আগে আমহার্স্ট স্ট্রিটের সিটি কলেজে এমন ঘটনা ঘটেছে, তার পরে সুরেন্দ্রনাথে। সুরেন্দ্রনাথ দিবা কলেজের অধ্যক্ষ চিন্ময়শেখর সরকার এ দিন বলেন, “কলেজে ভাঙচুর মানে সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করা। এটি জামিন-অযোগ্য অপরাধ। তার পরেও অভিযুক্ত যুবকদের পুলিশ গ্রেফতার করছে না।”
সামনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা। তাই কোনও কলেজেই এখন নিয়মিত ক্লাস নেই। এ দিন সুরেন্দ্রনাথ দিবা কলেজে গিয়ে দেখা গেল, হাতে গোনা কয়েক জন পড়ুয়া এসেছেন। বিএ প্রথম বর্ষের এক ছাত্র বলেন, “কলেজের ভিতরে বহিরাগতদের মৌরসিপাট্টা ভেঙে যাওয়ায় এখন শিয়ালদহ স্টেশনে ছাত্র-ছাত্রীদের নানা ভাবে ভয় দেখানো হচ্ছে।”
সুরেন্দ্রনাথ দিবা ও সান্ধ্য দুই কলেজেই পরিচালন সমিতির সভাপতি স্থানীয় বিধায়ক শিখা মিত্র। এখন দু’টিতেই ছাত্র সংসদ টিএমসিপি-এর দখলে। দলীয় সূত্রের খবর, সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক তমোঘ্ন ঘোষই বাইরে থেকে ছাত্র সংসদ পরিচালনা করেন। ইদানীং শঙ্কুদেব ‘দুষ্কৃতীদের সাহায্য’ নিয়ে কলেজগুলোর দখল নিতে সচেষ্ট হয়েছেন বলে টিএমসিপি-রই একাংশের অভিযোগ। পুলিশ কী বলে?
প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে পুলিশের দাবি: দুই কলেজের ছাত্র সংসদ টিএমসিপি-র দখলে থাকলেও তা নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হয়নি। শিখাদেবী এবং দুই কলেজের আইনজীবী দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেদের পছন্দের প্রার্থী নিয়ে সংসদ গঠন করেছেন। তদন্তকারী এক অফিসারের কথায়, “কলেজের প্রাক্তন ছাত্র দেবাশিসবাবু তৃণমূল সাংসদ সোমেন মিত্রের ঘনিষ্ঠ। ওঁদের ‘পদ্ধতি’ নিয়ে শঙ্কুদেবের আপত্তি। তিনি এখন কলেজে দেবাশিসবাবুদের কর্তৃত্ব খর্ব করতে চাইছেন।” দলের অন্দরে এমনও অভিযোগ উঠেছে যে, স্থানীয় বিধায়কের ‘সঙ্গীরাই’ কলেজে গোলমাল পাকাচ্ছেন। দেবাশিসবাবু অবশ্য এ দিন বলেন, “আমরা এর সঙ্গে জড়িত নই। তা ছাড়া কলেজ-কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে নিয়ম মেনে নির্বাচন হয়েছে। নথি দিয়ে তা প্রমাণ করে দিতে পারব।”
বিধায়ক শিখাদেবীর দাবি, কলেজে ক্লাস বন্ধ করার কথা তাঁকে জানানো হয়নি। ‘নিষ্ক্রিয়তা’র জন্য পুলিশের দিকে আঙুল তুলে তিনি বলছেন, “অধ্যক্ষ এবং ছাত্র-শিক্ষকদের অনেকে আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। আমি দেখেছি, ওঁরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। হয়তো তাই কলেজ বন্ধ করে দিয়েছেন। অধ্যক্ষ থেকে শিক্ষক সকলে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন। স্থানীয় থানায় ডায়েরি করেছেন। অথচ থানা কোনও পদক্ষেপ করছে না।” শিখাদেবী জানান, তিনি কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি হওয়ার পরে পরিচয়পত্র চালু করেছেন, সিসিটিভি বসিয়েছেন, অনলাইনে ভর্তিরও ব্যবস্থা করেছেন। “শঙ্কুদেবকে ডেকে বলেছিলাম, কলেজটা মসৃণ ভাবে চালানো দরকার। আমি সুরেন্দ্রনাথকে আদর্শ কলেজ করতে চেয়েছি। কিন্তু আগে যারা সিপিএম করত, তাদের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে দলের কিছু লোক আমাকে এবং আমার স্বামী সোমেন মিত্রকে আঘাত করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটাকেই নষ্ট করে দিচ্ছে।” আক্ষেপ শিখাদেবীর।

পরিবর্তনের
পরে কলেজ

পরিচালন সমিতির সভাপতি
আগে এখন
আসানসোল
বি বি কলেজ
প্রতিভারঞ্জন মুখোপাধ্যায়
(প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক)
মলয় ঘটক
(রাজ্যের আইনমন্ত্রী)
আরামবাগ
নেতাজি মহাবিদ্যালয়
বিনয় দত্ত
(প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক)
কৃষ্ণচন্দ্র সাঁতরা
(বতর্মান তৃণমূল বিধায়ক)
মেদিনীপুর কলেজ পুলিনবিহারী বাস্কে
(ঝাড়গ্রামের সিপিএম সাংসদ)
প্রণব বসু
(তৃণমূলের পুরপ্রধান)
গড়বেতা কলেজ সুশান্ত ঘোষ
(প্রাক্তন সিপিএম মন্ত্রী)
গোলক মাজি
(তৃণমূল শিক্ষক নেতা)
খেজুরি কলেজ হিমাংশু দাস
(সিপিএম জোনাল সম্পাদক)
শিশির অধিকারী
(কেন্দ্রীয় মন্ত্রী)
শীতলখুচি কলেজ হরীশ বর্মন
(প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক)
আবেদ আলি মিয়াঁ
(ব্লক তৃণমূল সভাপতি)
আশুতোষ কলেজ মনতোষ দাশগুপ্ত
(বামপন্থী শিক্ষাবিদ)
সৌগত রায়
(কেন্দ্রীয় মন্ত্রী)
সুরেন্দ্রনাথ কলেজ সুদিন চট্টোপাধ্যায়
(উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের প্রাক্তন সভাপতি )
শিখা মিত্র
(তৃণমূল বিধায়ক)
ভাঙড় কলেজ মাজাত দফাদার
(তৃণমূল নেতা)
আরাবুল ইসলাম
(প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক)
নব বালিগঞ্জ কলেজ রবীন দেব
(সিপিএম নেতা)
জাভেদ খান
(দমকলমন্ত্রী)
ভৈরব গাঙ্গুলী কলেজ আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়
(প্রাক্তন উপাচার্য)
মদন মিত্র
(পরিবহণমন্ত্রী)
লালবাবা কলেজ বেলুড় সুধাংশু মৈত্র
(বেলুড় বিদ্যামন্দিরের প্রাক্তন শিক্ষক)
সুলতান সিংহ
(তৃণমূল বিধায়ক)
বঙ্গবাসী কলেজ আশিস রায়
(প্রাক্তন উপাচার্য)
অশোক দেব
(তৃণমূল সাংসদ)
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.