শনিবারের নিবন্ধ
ভূতের রাজার বরে
প্রথমবার যখন ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ দেখি তখন আমি ক্লাস থ্রি বা ফোর-এ পড়ি। ইস্কুল থেকে সকলকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তার পর পরই আরও বার তিনেক ছবিটা দেখি। হয়তো নিজের অজান্তেই তখন থেকেই সিনেমার ভূত আমার ঘাড়ে চেপেছে। সিনেমা বানানোর ভূত চাপতে তখনও বছর কুড়ি দেরি। এর আগে ‘হাটারি’, ‘সাউন্ড অফ মিউজিক’, মেরি পপিন্স’, ‘বর্ন ফ্রি’ দেখে খুবই মুগ্ধ হয়েছিলাম। কিন্তু ‘গুগাবাবা’র ব্যাপারটাই ছিল আলাদা। একে তো নিজের ভাষায় দেখা প্রথম ছবি, তার ওপর হাসি, গান, ফ্যান্টাসি আর ভূতবাজিতে ভরপুর একটা জমজমাট গপ্পো। উপেন্দ্রকিশোরের লেখা গল্পের থেকেও অনেক মজাদার। তখন তো জানতাম না যে এই ছবিটা যাঁর করা তিনি চলচ্চিত্র ইতিহাসে সর্বকালের, সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচালকদের একজন। এটাও জানতাম না যে ভূতের রাজার গলাটা স্বয়ং তাঁরই! সেই ভূতের রাজা যে একদিন আমার ঘাড়ে ভর করে ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ তৈরি করিয়ে নেবে, তা কে জানত!
আমার বাবার চিত্রশিল্পী এক বন্ধু ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের কাছের মানুষ। আমার ছবি আঁকার হাত দেখে খুশি হয়ে আমার প্রিয় ইলাস্ট্রেটর এবং লেখকের কাছে একদিন নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর ইম্পোজিং চেহারা এবং ব্যারিটোন গলা শুনে প্রথমে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু শত ব্যস্ততার মধ্যেও যখন আমার ড্রইং খাতার সবক’টা পাতা দেখলেন এবং বেশ উৎসাহ দিলেন, তখন ভয়টা কেটে গেল। এর বেশ কিছু দিন পরের কথা, আমরা অনেক দিনের জন্য কলকাতার বাইরে গিয়েছিলাম। ফিরে আসার পর বাবার সেই বন্ধু বাবাকে বলেছিলেন, ‘মানিকদা তোর ছেলের খোঁজ করছিলেন। তোদের যোগাযোগ করতে পারিনি...’ শুনেছি তিনি ছেলে বুড়ো বিভিন্ন লোকের মুখচ্ছবি তাঁর মনের ক্যামেরায় তুলে ফেলতেন অথবা স্কেচ করে রাখতেন।
বিভিন্ন ছবিতে দরকার মতো সেই সব মুখের মালিককে ব্যবহার করতেন। কতটা পেরেছি জানি না, কিন্তু ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-এও ছোট ছোট চরিত্রে খুব মন দিয়ে কাস্ট করার চেষ্টা করেছি। এ ক্ষেত্রে সত্যজিৎ রায় যে ছবির জন্য আমাকে খুঁজছিলেন তার নাম ‘সোনার কেল্লা’, আর যে ভূমিকায় আমাকে ভাবা হয়েছিল, তার নাম তোপসে। এই আফশোস আমার কোনওদিন যাবে না।
আরও বেশ কিছু পরে, তখন আমি ছবিকরিয়ে হতে চাই শুনে আমার দিদিমা, চলচ্চিত্রকার বিমল রায়ের স্ত্রী, আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়ের কাছে। উনি তখন অসুস্থ, বলেছিলেন আমি অবজার্ভার হিসেবে যোগ দিতেই পারি। তবে শু্যটিং আপাতত বন্ধ আছে। মাস পাঁচ-ছয় পরে শুরু হবে। তার আগে যেন যোগাযোগ করি। সে যোগাযোগ আর করা হয়নি। বাধ্য হয়ে চাকরি নিয়ে কলকাতার বাইরে চলে যেতে হয় আমাকে। বলাই বাহুল্য, এই আফশোসও আমার কোনও দিন যাবে না। আর কোনও দিন কারও সহকারী হয়ে কাজ শেখা হয়ে ওঠেনি আমার।
সত্যি কথা বলতে কী, সাংঘাতিক ফিল্ম বোদ্ধা আমি কোনও কালেই নই। অল্পবিস্তর দেশি-বিদেশি ছবি দেখেছি। কিন্তু সাংঘাতিক দুর্বোধ্য ছবি দেখে ‘আহা মাস্টারপিস’ বলে লাফিয়ে উঠতে কখনওই মন সায় দেয়নি। আমার ইন্টেলেকচুয়াল বন্ধুরা এই নিয়ে আমাকে খ্যাপাত। বলত, ফিল্মটা বোঝার জিনিস নয়, অনুধাবন করার জিনিসভাল কবিতার মতো। সাংঘাতিক ট্যান যাওয়া ফিল্ম দেখিয়ে মিটিমিটি হেসে বলত, ‘ব্যাপারটা কেমন অ্যামবিগুইটির দিকে এগোচ্ছে দেখেছিস!’ আমি প্রমাদ গুনতাম। সত্যজিৎ রায়ের ‘সিকিম’ তথ্যচিত্র ছাড়া অধিকাংশ ছবিই আমার দেখা। ওগুলো শিল্পগুণে অনন্য হয়েও সোজা। আমি ‘বুঝতে’ পারি। তাই আমি সত্যজিৎ-ভক্ত। অবশ্য আমার অতিরিক্ত সত্যজিৎ রায় ভক্তি নিয়ে ঠাট্টাও কম হয় না। সত্যজিৎ রায়ের একটা ছবি আমার স্টাডিতে আছে। দেবদ্বিজে আমার খুব ভক্তি আছে এমনটা নয়। বিজ্ঞাপনের ছবি করে যতই সাফল্য পাই না কেন, কাহিনিচিত্রের প্রযোজক তখনও পর্যন্ত কিছুতেই পাচ্ছি না।
দু’-দু’টো চিত্রনাট্য তৈরি হয়ে পড়ে আছে, কিছুটা কথা এগিয়েই কেঁচে যাচ্ছে। একবার নয়, বারংবার। দুত্তোরি বলে ঠিক করলাম ছবি বানাবোই না। সেই সিদ্ধান্তটা সেলিব্রেট করতে করতে হাতের গ্লাস তুলে স্টাডির ছবির সত্যজিৎ রায়কে বললাম, “স্যার, আমার তা হলে আর ফিচার ছবি করা হল না।” ভাববেন গল্পের খাতিরে রং চড়াচ্ছি, ক’দিন পরেই এক প্রযোজকের ফোন। চিত্রনাট্য না, শুধু কনসেপ্ট শুনেই রাজি। সেই ছবিই ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’।
আগেই বলেছি, এর আগে দু’-দু’টো স্ক্রিপ্ট আপাদমস্তক তৈরি হয়েও ছবি হয়নি। এদিকে আমি খুঁতখুঁতে বলে বদনাম আছে। সময় নিয়ে স্ক্রিপ্ট লিখতে চাই, ধীরেসুস্থে প্রি-প্রোডাকশনের কাজ করতে চাই। কনসেপ্ট শুনেই প্রযোজক বললেন এক মাসের মধ্যে স্ক্রিপ্ট লিখে ফেলতে। ডাকলাম দেবব্রতকে (দেব রায়)। এ ছবিতে ও আমার সহ-পরিচালক ছিল। চিত্রনাট্যের প্রাথমিক কাঠামোটা লিখে ফেলে সংলাপ লেখা শুরু হল। আস্তে আস্তে আমার কল্পনার চরিত্ররা রক্তমাংসের হয়ে উঠতে লাগল। বিজ্ঞাপনের ছবি তো সব সময় তাড়াহুড়োয় করতে হয়। সেই প্রোভার্বিয়াল ‘ইয়েস্টারডে ডেডলাইন’। ভেবেছিলাম ফিচারের চিত্রনাট্য লেখার জন্য সময় পাব। কিন্তু দেখলাম সে সুখ বরাতে নেই। একদিন সকালবেলা কম্পিউটারে কম্পোজ করছি, চিত্রনাট্য তখন ফাইনাল স্টেজে। আমার স্ত্রী ঘুম থেকে উঠে বলল, ‘এ কি! তুমি এত সকাল সকাল কম্পিউটারের সামনে?’ অগত্যা বলতেই হল, আসলে গোটা রাত কম্পিউটারের সামনেই কেটেছে। বাংলা ওয়ার্ড তত দিনে সড়গড় হলেও চন্দ্রবিন্দু লিখতে গেলেই চিত্তির। হেল্প-এর শরণাপন্ন হতে হচ্ছে।
স্ক্রিপ্টে স্বাধীনতা সংগ্রামী পুঁটিরাম ঘোষের একটা ট্র্যাক ছিল। তার ফাঁসি, ভূতেদের মেস-এ থাকা, যেখানে পথনির্দেশ বোঝাতে তিরচিহ্নের বদলে কঙ্কালের হাত আঁকা থাকে। নোনাধরা দেওয়ালে পোস্টারে লেখা থাকে, ‘দুনিয়ার ভূত এক হও। ভুকা ভূত ভয় দেখাও। ওটা হাতিয়ার’। পরে চৌধুরী প্যালেসে, বাসস্থানের আশায় পুঁটিরাম হাজির হয়। এটা না জেনেই যে র্যামসে সাহেব সেখানকার বাসিন্দা। সাহেব তো দো-নলা বন্দুক নিয়ে পুঁটিরামকে তাড়া করল। দর্পনারায়ণ বলল, ‘সাহেব, ছেড়ে দিন, মরার ওপর খাঁড়ার ঘা।’ এই পর্যন্ত লিখে আমরা এত খুশি হলাম যে আমি আর দেবব্রত স্কচের বোতল খুলে সেলিব্রেট করতে বসলাম। কিন্তু পরে ছবির দৈর্ঘ্য কমানোর জন্য গোটা পুঁটিরাম ঘোষের ট্র্যাকটাই বাদ দিতে হয়। স্ক্রিপ্ট শুনে প্রোডিউসার বললেন, এই হল অ্যাড-ফিল্মমেকারদের দোষ। কুড়ি সেকেন্ড অন্তর-অন্তর পাঞ্চলাইন। একটা হাসির রোলে পরের কথা চাপা পড়ে যাবে। শুভানুধ্যায়ীরা পইপই করে বলল, কমেডি ছবিদু’ঘণ্টার বেশি কিছুতেই নয়। এবার শুরু হল নির্মমভাবে বর্জনের পালা। এইখানে প্রযোজককে সবিনয়ে একটা কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। দর্শক ঘন ঘন হাসছেন বলেই পরের পাঞ্চলাইন মিস করছেন, সেই জন্যই অনেকে ছবিটা একাধিকবার, কেউ কেউ চারবারও দেখছেন পুরো রসটা উপভোগ করার জন্য। রিপিট ভিউইংয়ে লাভটা কিন্তু প্রযোজকেরই। এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, ছবির ডায়ালগ সর্বত্রই খুব প্রশংসিত হচ্ছে। এর অংশীদার আমার সঙ্গে সমান ভাবেই দেবব্রত। যে এ ছবির অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর এবং সহকারী চিত্রনাট্যকার। ছবির ক্রেডিট টাইটেল মন দিয়ে পড়লেই সে কথা বোঝা যাবে।
অনীকের আঁকা ছবির পোস্টার
স্ক্রিপ্ট লেখা চূড়ান্ত হতেই শুরু হল হন্টেড হাউজ হান্টিংয়ের গল্প, মানে লোকেশন খোঁজা। মনের মতো ‘চৌধুরী প্যালেস’ খুঁজতে গিয়ে গোটা কলকাতা ও আশেপাশে গোটা কুড়ি-পঁচিশ বাড়ি দেখেও প্রায় কোনও বাড়িই পছন্দ হল না। একটা বাড়ি যা-ও বা পছন্দ হয়েছিল মেগাসিরিয়ালের জন্য তার দেওয়ালে সাইকেডেলিক চিত্র-বিচিত্র রং। অতএব চলবে না। আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি এমন সময় শ্রীরামপুর রাজবাড়ির খোঁজ পেলাম। আমাদের ছবির নাম যে ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ সে কথা না জেনেও যিনি আমাদের শ্রীরামপুর রাজবাড়িটা ঘুরে দেখালেন তিনি ওই বাড়ির একটা অদ্ভুত গল্প শোনালেন। ওই বাড়ির চত্বরে নাকি একটা পুকুর ছিল। সেখানে ডুবে মারা যায় ওই বংশের একজন। জনশ্রুতি, অপঘাতে মৃত ওই মানুষের আত্মা ও বাড়িতে আজও ঘুরে বেড়ায়।
যাই হোক, আমরা যেমন বাড়ি খুঁজছিলাম, সেটা পেয়ে গেলাম। এবং এ ক্ষেত্রে ওই বাড়ির কর্তৃপক্ষ, বিশেষ করে শ্যামদা’শ্যাম গোস্বামীর সহায়তার কথা উল্লেখ না করে পারছি না। লোকেশন পছন্দের পর ভূতগ্রস্তের মতো শুরু হল প্রি-প্রোডাকশনের কাজ। লুক টেস্ট, কস্টিউম আরও হাজারো উনকোটি-চৌষট্টি। সহযোগী দেবব্রতকে বললাম, আত্মারাম আর খাজা খানের নাচ আর তালির রিহার্সাল দেওয়াতে মিউজিকের সঙ্গে। একদিন নিঝুম দুপুরে এক ভদ্রলোক আমার বাড়ির বাইরের ঘরে অপেক্ষা করছেন। হঠাৎ প্রচণ্ড আঁতকে উঠলেন আমার বন্ধ স্টাডির মধ্যে থেকে ভুতুড়ে তালির আওয়াজ শুনে। আসলে কিছুটা বিশ্রামের পর ফের শুরু হয়েছে খাজা খানের মহড়া। এর মধ্যে, বলাই বাহুল্য, গান রেকর্ডিং হয়ে গিয়েছে। আমার স্ত্রী সন্ধি ঝাঁপিয়ে পড়ে ‘আলপিন টু এলিফ্যান্ট’ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টে ব্যস্ত। এই সব করতে করতেই শু্যটিংয়ের ডেট চলে এল। আর আমি টের পেলাম কুড়ি-তিরিশ সেকেন্ডের অ্যাড ফিল্ম করা আর ফিচার ছবি করা যাকে বলে ওয়ান-ডে ম্যাচ থেকে টেস্ট খেলতে যাওয়া।
পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় বিদেশে থাকতেই মেল চালাচালি হয়েছিল। ওর খুবই পছন্দ হয়েছিল স্ক্রিপ্টটা এবং কথা ছিল দেশে ফিরে এটাই হবে ওর প্রথম কাজ। কিন্তু এর মধ্যেই হঠাৎ শুরু হয়ে গেল ‘কহানি’র শু্যটিং। আমাদের শু্যটিংও তখন দোরগোড়ায়। এত অল্প সময়ে অন্য কারও ডেট পাওয়া সম্ভব নয়। আর তা ছাড়া পরমকেই ভেবে রেখেছিলাম ওই চরিত্রটার জন্য। ওকে বললাম, তোমাকে নিয়েই শু্যট করব ছবিটা। এদিকে ‘কহানি’র কাজ এক্সটেন্ডেড হতে হতে এমন জায়গায় দাঁড়াল যে আমার যে দিন প্রথম শু্যটিং তার আগের গোটা রাত পরম ‘কহানি’র শু্যটিং করেছে। সেখান থেকে সোজা আমাদের ফ্লোরে। স্বাভাবিক ভাবেই ঘন ঘন হাই উঠছিল ওর। ঘটনাচক্রে যেটা ওর অভিনীত অয়নের চরিত্রটার সঙ্গে খুব মানানসই। কেননা, অয়নও সারা রাত জেগে স্ক্রিপ্ট লিখেছে।
টাইটেল কার্ডের ডিজাইন
আরেকদিন এর-ওর বকেয়া কাজ তুলতে তুলতে একই দিনে ডেট পড়ল পরম, বেণুদা (সব্যসাচী চক্রবর্তী) আর বিভুদা’র (বিভু ভট্টাচার্য)। সেদিনের প্রোডাকশন স্টিলগুলো দেখলে মনে হবে হয়ত একটু পুরনো, ফেলুদার ছবির শু্যটিং হচ্ছিল। সদাহাস্যময় বিভুদা’কে প্রিমিয়ারের দিন প্রচণ্ড মিস করেছি। আজও করি।
গোটা শু্যটিং জুড়েই নানা রকম মজার কাণ্ডকারখানা ঘটেছে। তবে তার সবগুলো বলা যাবে না। কয়েকটা বলছি
একটা লম্বা-- সিকোয়েন্স আছে স্বস্তিকা (মুখোপাধ্যায়) আর মমতাজের। যেখানে কোয়েল, মানে মমতাজ, কদলীবালা অর্থাৎ স্বস্তিকাকে ‘হিপ অ্যান্ড হ্যাপেনিং’ হয়ে উঠতে বলবে। অন্ত্যমিল সহ বিরাট লম্বা শট। গোটাটা এক টেক-য়ে নেওয়া হবে। স্বস্তিকা আর মমতাজ ক্যামেরার দিকে এগিয়ে আসবে আর ক্যামেরা ও অন্য যন্ত্রপাতি নিয়ে অভীক (মুখোপাধ্যায়, চিত্রগ্রাহক) ও তার দলবল পেছোবে। দুরূহ শট। কোথাও একটা ভুল হলেই গোটাটা এন-জি। এদিকে টায়ে-টায়ে অন্ত্যমিল। অভিনেত্রীরা ইম্প্রোভাইজ করবে বা মেক-আপ দেবে সে সুযোগ নেই। প্রত্যেকেই খুব টেন্সড। আর সবচেয়ে চাপ স্বস্তিকা আর মমতাজের। শিডিউলও তত দিনে ঘেঁটে-ঘ। অনেকগুলো শট বাতিলের পর একটা চলনসই শট নিয়ে সেদিনের মতো প্যাক-আপ। কিন্তু মনটা খুঁতখুঁত করছিল। অভীক সাধারণত কম কথার ছেলে। সেও দেখলাম ঊষ্মা প্রকাশ করছে শটটা মনোমতো হয়নি। পরের দিন ঠিক করলাম শটটা রি-টেক করব।
দেবব্রত পাখি পড়ানোর মতো ডায়ালগ মুখস্ত করাত। সকালে টেকের এক ঘণ্টা আগে থেকে সে আবার লেগে গেল কাজে। স্বস্তিকা আর মমতাজ চলে এল ঠিক সময়ে। এবার এক টেকেই ও কে। এখন যখন দৃশ্যটা সিনেমা হলে দেখানো হয় আর মানুষ প্রশংসা করে তখন বুঝি সেদিনের পরিশ্রমটা সার্থক। যদিও মমতাজ বলে ওই ডায়ালগগুলো নাকি এখনও রাতে ওর স্বপ্নের মধ্যে হানা দেয়। আর স্বস্তিকা বলে ওই ডায়ালগগুলো আজও ওর মুখস্তএক টেকেই উতরে দিতে পারবে।
অন্ত্যমিলের একটা নেশা আছে। যার জেরে সেটে ডায়ালগ শুনে সবাই দেখলাম কিছু না কিছু রাইম করতে শুরু করল। দর্পনারায়ণ আর নায়েবের মধ্যে একটা দৃশ্য ছিল এই রকম
নায়েব: কত্তামশাই, রায়েতরা বলছে কি... বলছে কি... ইসে
দর্পনারায়ণ: কী?
নায়েব: বলছে বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কীসে?
দর্পনারায়ণ: তা হলে সরকার বাহাদুরের ঘরে টাকা কে ভরবে? আমার পিসে? অ্যাই বিশে... ইত্যাদি।
হঠাৎ আমার মাথায় এল পরম এখানে কমেন্ট করতে পারে, “এই রাইম করে কথা বলাটা... একটু ক্লিশে...”।
অয়ন ফোনে শুনল সিনেমাটোগ্রাফার সুমিত নাকি পথ অবরোধের জন্য ট্রাক ধরে ফিরছে। শুনে অয়ন বলে ট্রাক! বেস্ট অফ লাক।’ শুনে সেটে পেছন থেকে কেউ একজন বলে উঠল, ‘ওহ***’।
পরাণদার (পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়) ডায়ালগ ছিল, “আজ রওনা হলে পৌঁছব কাল কি?’ নায়েব বলে, “আজ্ঞে জুড়িগাড়ি করে কেতুগ্রাম, সেখান থেকে পাল্কি’। পরাণদা সেই শুনে ফট করে জুড়ে দিলেন, “দেখো, রাস্তার হাল কী”যদিও সেটা শেষ পর্যন্ত ছবিতে রাখা হয়নি।
জমিদার দর্পনারায়ণের চরিত্রে পরাণদা চলেছেন পাল্কি করে। ডিসেম্বরের কনকনে শীতের রাত। খোলা আকাশের নীচে, খোলা মাঠে শু্যটিং। ডাকাতদের পরনে ধুতি, খালি গা। জমিদারের ডাকাত দেখে দাঁতকপাটি লাগবে কী, ডাকাতদেরই দাঁতকপাটি লাগবার জোগাড়। হারেরেরে বলতে বাড়তি গিটকিরি লেগে যাচ্ছে। ডাকাতের জঙ্গলের কাছেই হয়েছিল ভূতনাথ বাবাজির আখড়ার শু্যটিং। দিনের বেলায়। শু্যটিং পার্টির লোকজন ছাড়াও অচিরেই স্থানীয় লোকজন জমে গেল। মাঝবয়সী মহিলারা ভূতনাথ বাবার ভেক ধরা সুমিতকে (সমাদ্দার) বেশ গদগদভাবে নমো করতেও লাগলেন। দেখে আমার বহু দিন আগে দেখা খবরের কাগজের একটা ছবি মনে পড়ে যাচ্ছিল। এক দেহাতি মহিলা ভক্তিভরে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের উদ্দেশে প্রণাম জানাচ্ছেন।
অবশ্য সবচেয়ে চমকপ্রদ ঘটনাটা ঘটেছিল প্রথম দিন। শ্রীরামপুর যাওয়ার পথে। সকালবেলা, দ্বিতীয় হুগলি সেতুর টোলপ্লাজায় দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ আমাদের সহকারীরা দৃষ্টি আকর্ষণ করাল আমাদের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ট্রাকের দিকে। ট্রাকটার সামনের উইন্ডস্ক্রিনের ওপর ইংরেজিতে লেখা দু’টো নাম‘অনীক’ এবং ‘অভীক’। আমি আর অভীক গাড়িতে যে যে দিকে বসেছিলাম, ঠিক সেই অর্ডারে। এটা যদি ধরেও নেওয়া যায় নামগুলো ট্রাকমালিকের দুই ছেলের নাম, তা হলেও এটা বলতেই হয় এই নামগুলো ততটা কমন নয়। তার থেকেও বেশি আশ্চর্যের যে ওই নাম লেখা ট্রাক ঠিক আমাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের শু্যটিংয়ের প্রথম দিন! এটা কি নিছকই কাকতালীয় ঘটনা না ভুতুড়ে কাণ্ড? অভীক অবশ্য অভয় দিয়ে বলেছিল, ‘‘ওমেনটা স্পষ্ট। ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ না চললে ওটাই আমাদের ভবিষ্যৎ।”
অর্থাৎ যৌথভাবে ট্রাকের ব্যবসায় নামতে হবে।
যদিও ‘ভবিষ্যৎ’ অন্য কথা বলছে। ১৬ মার্চ মুক্তি পেয়েছে ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’। তারপর যা যা ঘটেছে তাতে স্বয়ং ভূতের রাজা আমার ওপর সদয় হয়েছেন বলা ছাড়া আর কোনও ব্যাখ্যা আমার মাথায় আসছে না।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.