জনকল্যাণ
অন্য পথে হাঁটা
লকাতার বুকে ‘সমাজতন্ত্রে’র একটু ছোঁয়া!
বর্ষায় এখন আর ভয় করে না মন্টু পাত্রের।
স্বামী লোকেশ্বরানন্দ
নিমাই কাটারি এখন নিশ্চিন্তে বাঁশের কাজ করেন নিজের ফ্ল্যাটের বারান্দায়। ওঁরা সবাই উত্তর কলকাতার রামবাগান বস্তির বাসিন্দা ছিলেন। এখনও ওঁরা ওখানকারই বাসিন্দা। তবে বস্তিতে নয়, নিজের ফ্ল্যাটে বাস করেন। কারও এক কামরা, কারও দু’কামরা, কারও তিন কামরা এবং অনেকের চার কামরার ফ্ল্যাট রয়েছে খাস কলকাতার বুকের উপর। পরিবারের সদস্যসংখ্যা অনুযায়ী এই ফ্ল্যাট বিলির ব্যবস্থা কলকাতার কোনও বামপন্থী সংগঠন করেনি। বরং, সমাজতান্ত্রিক ধাঁচে ফ্ল্যাট বিলির এই ব্যবস্থা করেন রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী লোকেশ্বরানন্দ। রামবাগান বস্তির চেহারাটা তার ফলে পাল্টে গিয়েছে। পরিবেশ বদলের ফলে উধাও হয়ে গিয়েছে রামবাগান বস্তিও। বদলে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বিবেকানন্দ পল্লি।
বছর পঞ্চান্নর নিমাই কাটারি বলেন, ‘‘সেই ছোটবেলা থেকে দেখতাম বস্তির মানুষ বলে আশপাশের মানুষ আমাদের সঙ্গে সে ভাবে মিশতে চাইত না। আমরা কেউ স্কুলে যাওয়ার স্বপ্নও কখনও দেখিনি। বছরের সব সময়েই সারা বস্তি স্যাঁতসেতে থাকত। একটা চাপা দুর্গন্ধ সব সময় থাকত। আর চিল্লামিল্লি। বস্তির ছোট ছোট ঝুপড়ি ঘরে গাদাগাদি করে থাকতাম।” এই ছবিটা বদলে যেতে শুরু করল ১৯৮৫ থেকে, জানালেন নিমাইবাবু।
রামবাগান, এখন যেমন।
বস্তির জায়গাতেই শুরু হল পাকা ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি। শুরু করল বিবেকানন্দ সমাজকল্যাণ কেন্দ্র। স্বামী লোকেশ্বরানন্দের তত্ত্বাবধানে কাজটি হয় বলে জানালেন রামবাগানের বিবেকানন্দ সমাজকল্যাণ কেন্দ্রের কর্মী তাপস মিশ্র।
একটা সময় ছিল যখন এই রামবাগান বস্তির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে অন্য এলাকার ছেলেমেয়েদের বিয়ে হত না বলে জানালেন তাপসবাবু। সেই সময় এখানকার পুরুষরা এলাকার ধনীদের লেঠেল হিসেবে কাজ করত। এলাকার জনৈক অজিতবাবুর অনুরোধে ১৯৫২-য় প্রথম এখানে স্বামী লোকেশ্বরানন্দ আসেন। প্রথমে চালু করেন বয়স্কদের লেখাপড়ার একটি কেন্দ্র। ওঁদেরই অনুরোধে পরবর্তী কালে ওই বস্তির ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য স্কুল খোলা হয়। বস্তির উন্নয়নে কিছু কিছু উদ্যোগ নেওয়াও শুরু করেন লোকেশ্বরানন্দ।
রামবাগান, অ্যালবাম থেকে।
প্রায় চার দশক পরে ওই এলাকাতেই বস্তিবাসীদের পাকা বাড়িতে পুনর্বাসনের প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পে দু’হাজার বস্তিবাসীর জন্য ২২টি ব্লকে ৩৫২টি ফ্ল্যাট তৈরির পরিকল্পনা করেন স্বামী লোকেশ্বরানন্দ।
পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু হয় ১৯৮৫-তে। প্রথম ব্লকটির কাজ শেষ হয় ১৯৯০-এ। প্রকল্পটির ২২টি ব্লক-ই গত বছরের মধ্যে তৈরি হয়েছে। এলাকার বাসিন্দা ছবি সাহা বলেন, “এখন এখানে সব ছেলেমেয়েই স্কুলে লেখাপড়া করে। বেশ কয়েক জন এমএ পাশও করেছে। এখন অন্যদের থেকে আমাদের ‘আলাদা’ বলে মনে হয় না। এখন আর আমাদের কেউ ‘বস্তির লোক’ বলে না।” এখন এ পাড়ার মেয়ে বউ হয়ে কলকাতার অন্য পাড়ায় অনায়াসে যাচ্ছে। অন্য পাড়ার মেয়েরাও খুশি হয়ে এ পাড়ার বউ হয়ে আসছে, হাসতে হাসতে জানালেন কুটিরশিল্পী জগন্নাথ পাকড়ে।

ছবি: সুদীপ আচার্য।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.