পশ্চিমবঙ্গের কলেজে কলেজে এখন, আক্ষরিক অর্থে, কেবলই দৃশ্যের জন্ম হইতেছে। দৃশ্যগুলি ভয়ানক। পূর্ণাঙ্গ তালিকার প্রয়োজন নাই, জনস্মৃতি এত ক্ষণস্থায়ী নহে। ভাঙড় মহাবিদ্যালয়ের ঘটনাটিই যথেষ্ট। রাজ্যের প্রধান শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় দলনেতা এবং ভূতপূর্ব বিধায়ক আরাবুল ইসলাম সেই কলেজে যে কীর্তি স্থাপন করিয়াছেন এবং তাহার পরেও বিন্দুমাত্র লজ্জা বা অনুতাপের পরিচয় না দিয়া বরং উচ্চকণ্ঠে যে ভাবে আস্ফালন করিয়াছেন, তাহার বিবরণ শুনিলে ধৃতরাষ্ট্র দ্বিতীয় বার অন্ধ হইতেন। এই বিষয়ে কোনও সংশয় থাকিতে পারে না যে, ওই ঘটনার যথাযথ তদন্ত ও বিচার জরুরি, অপরাধীর শাস্তিবিধান জরুরি। এই বিষয়েও সম্ভবত কোনও সংশয় নাই যে, উল্লিখিত জরুরি কাজগুলি সম্পন্ন হইবে না, বস্তুত তাহার কোনও উদ্যোগই হইবে না। তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিব এবং রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানাইয়াছেন, আরাবুল ইসলামকে তিনি মহিলাদের সহিত সংযত আচরণ করিতে বলিয়াছেন, সেই মহিলা ‘চোর-ডাকাত’ হইলেও। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
আচরণ তুচ্ছ করিবার বিষয় নহে। বস্তুত, যথাযথ আচরণবিধি অনুশীলনের মধ্য দিয়াই সমাজ এবং রাজনীতি আপনাকে অনেক দূর অবধি উন্নীত করিতে পারে, তাহার বহু নজির ইতিহাসে রহিয়াছে। বিপরীতে, সৎ এবং শোভন আচরণের রীতি হইতে বিচ্যুতির ক্রমান্বয়ী অধোগতি একটি সমাজকে কোন অতলে টানিয়া লইতে পারে, আধুনিক পশ্চিমবঙ্গ তাহার এক ভীতিপ্রদ চলচ্চিত্র, আরাবুল ইসলাম তাহার একটি দৃশ্যমাত্র। কিন্তু সদাচরণের পরামর্শ দিয়া সমাজের উন্নতিসাধনের পরিকল্পনা শুনিতে চমৎকার হইলেও বাস্তবসম্মত নহে। প্রয়োজন সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন। ‘সমাজব্যবস্থা’ কথাটি সচরাচর অস্পষ্ট এবং অনির্দিষ্ট ভাবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এই কথাটির যথার্থ তাৎপর্য অপরিসীম। যে ব্যবস্থায় সমাজের বিবিধ প্রতিষ্ঠান চলে, তাহার কাঠামোগত সংশোধন করিতে না পারিলে প্রকৃত সংশোধন অসম্ভব, প্রকৃত ‘পরিবর্তন’ অসাধ্য।
পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থায় এই মৌলিক পরিবর্তনের প্রয়োজন সর্বাগ্রে। বামফ্রন্ট জমানায় শিক্ষার সমগ্র কাঠামোটির ‘রাষ্ট্রীয়করণ’ ঘটিয়াছে, অর্থাৎ কার্যত সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনায় রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। সি পি আই এম তাহাকে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নিয়ন্ত্রণে পরিণত করিয়াছিল, বস্তুত সেই উদ্দেশ্যেই পরিচালন ব্যবস্থাটি তাহারা ‘রাষ্ট্রায়ত্ত’ করিয়াছিল। আজ জমানা পরিবর্তিত, নিয়ন্ত্রণের কারিগররাও পরিবর্তিত, কিন্তু নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাটি অপরিবর্তিত। নূতন জমানার কর্ণধাররা কি প্রকৃত পরিবর্তন চাহেন? যদি সত্যই চাহেন, তবে সর্বাগ্রে কলেজ পরিচালন ব্যবস্থার মূলে আঘাত করিতে হইবে। ‘বেসরকারিকরণ’ শুনিলে হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট এবং আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে যুগ্ম মনোবেদনা ঘটিতে পারে, সুতরাং বলা চলে, কলেজের ‘বিরাষ্ট্রীয়করণ’ জরুরি। কে বা কাহারা কলেজ পরিচালনা করিবেন, তাহা নির্ধারণের দায়িত্ব ও অধিকার সেই কলেজের শিক্ষকশিক্ষিকাদের। সেখানে জনপ্রতিনিধি বা সরকারি কর্তাদের কোনও ভূমিকা থাকিতে পারে না। সরকারি কর্তারা সরকারি প্রশাসন চালাইবেন, জনপ্রতিনিধিরা আইনসভায় জনসাধারণের প্রতিনিধিত্ব করিবেন। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁহাদের স্থান নহে। ইহাই সর্ব রোগ হরণ করিবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা নাই। অ-সভ্য, অ-শালীন আচরণের জন্য অষ্টম বা দশম শ্রেণি অনুত্তীর্ণ হইতে হইবে, এমন কোনও আইন তো দেশে বহাল নাই। সুতরাং এমন পরিবর্তনের পরেও শিক্ষিকার প্রতি জলপাত্র নিক্ষিপ্ত হইতে পারে, অধ্যক্ষ প্রহৃত হইতে পারেন, ধৃতরাষ্ট্র আরও বহু বার অন্ধ হইতে পারেন। কিন্তু তাহা হইবে শিক্ষাজগতের অন্দরনিহিত সমস্যা। তাহার সমাধানও সেই অন্দরই খুঁজিয়া লইবে, খুঁজিতে বাধ্য হইবে। স্থানীয় দলনেতা, দলনেতা হইবার সুবাদেই, কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতির কেদারায় সমাসীন হইতেছেন এবং সেই পদাধিকারবলে ‘আমার কলেজ’-এ যখন তখন চড়াও হইতেছেন এই বিসদৃশ ঘটনার অন্তত কোনও সুযোগ থাকিবে না। আপাতত এইটুকুই হউক। |