|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
পরিচয় পাওয়া যায় রাবীন্দ্রিক অনুষঙ্গের |
সম্প্রতি আইসিসিআর-এ অনুষ্ঠিত হল ঈলীনা বণিকের একক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ। |
ঈলীনা বণিকের ছবির প্রদর্শনী হল সম্প্রতি আইসিসিআর-এর উদ্যোগে তাঁদের দ্য বেঙ্গল আর্ট গ্যালারিতে। সার্ধশতবর্ষে রবীন্দ্রনাথের প্রতি শিল্পীর শ্রদ্ধাঞ্জলি এই প্রদর্শনী। তাই এর শিরোনাম- ‘জার্নি অফ অ্যান আর্টিস্ট ইন দ্য লাইট অব টেগোর’। রবীন্দ্রনাথের দর্শন, তাঁর গান ও ছবি ঈলীনাকে নানা ভাবে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করেছে। ছাত্রীজীবনের প্রথম পর্যায়ে শিল্পী কলকাতার পাঠভবন স্কুলে পড়েছেন। সেখানকার রাবীন্দ্রিক অনুষঙ্গ তাঁকে নানা ভাবে ছুঁয়ে গেছে। তাঁর শিল্পশিক্ষা বিশ্বভারতীর কলাভবনে। সেই পরিমণ্ডল থেকে পরিপূর্ণ ভাবে আত্মস্থ করেছেন রাবীন্দ্রিক জীবনবোধ ও সৌন্দর্যচেতনার সারাৎসার। ঈলীনা নানা রকম আঙ্গিকে কাজ করেন। তাঁর বিষয়ভাবনাতেও বৈচিত্র আছে। তবু তাঁর ছবির একটি স্বাভাবিক প্রবণতা এই যে, তার ভিত্তিতে থাকে অভিব্যক্তিবাদ বা এক্সপ্রেশনিজমের অন্তর্মুখীনতা ও রূপের বিশ্লেষণ পদ্ধতি। এইখানে রাবীন্দ্রিক উত্তরাধিকার তাঁর ছবিতে নানা ভাবে আলো ফেলেছে।
আমরা একটু বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারি, রবীন্দ্রনাথের ছবি কী ভাবে পরবর্তী প্রজন্মকে প্রভাবিত বা অনুপ্রাণিত করেছে। আমাদের চিত্রকলার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ প্রথম আধুনিকতাবাদী শিল্পী। তিনিই প্রথম ছবিতে গভীর এক অন্তর্মুখীনতা নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। এর প্রধান উৎস ছিল আদিমতার উত্তরাধিকার। এই উত্তরাধিকারকে কাজে লাগিয়েই পাশ্চাত্যে, বিশেষত জার্মানিতে ১৯০৫ সাল থেকে অভিব্যক্তিবাদী ধারার বিকাশ ঘটেছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সঙ্গে সম্যক পরিচিত ছিলেন। কিন্তু তাঁর ছবি ছিল সেই ধারা থেকে অনেকটাই দূরবর্তী। কেননা আদিমতা ও অভিব্যক্তিবাদের সঙ্গে তিনি সমন্বিত করে নিতে পেরেছিলেন দেশজ ঐতিহ্য ও তাঁর আজীবন লালিত ঔপনিষদিক চেতনা। এই সংশ্লেষ থেকেই গড়ে উঠেছে তাঁর ছবিতে রূপের স্বাতন্ত্র্য ও অভিনবত্ব। ১৯৪০-এর দশকের শিল্পীরা এই অন্তর্মুখীনতাকে স্পর্শ করতে চেয়েছেন। কিন্তু এ বিষয়ে সামগ্রিক সফলতা অর্জন করেছেন ষাটের দশকের শিল্পীরা। সেই অভিব্যক্তিবাদী অন্তর্মুখীনতা কেমন করে প্রবাহিত হয়ে এসেছে ১৯৯০-এর দশকে উঠে আসা শিল্পীদের ক্ষেত্রে, তারই প্রকৃষ্ট নজির ঈলীনার ছবি। |
|
শিল্পী: ঈলীনা বণিক |
১৯৯০-এর দশকের দ্বিতীয়ার্ধে তাঁর ছবি ছিল প্রগাঢ় ভাবে অবয়বী এবং মানবিক চেতনাসম্পন্ন। মানুষের বিশেষত নিম্নবর্গীয় মানুষের বেঁচে থাকার তীব্র সংকট রূপায়িত হত সেখানে। সেই সব ছবির অবয়ব বিন্যাসে আদিমতাসম্পৃক্ত অভিব্যক্তিবাদী তীব্রতা যেমন ছিল, তেমনি ছিল কিউবিজম থেকে আহৃত ঘনত্ব ও কৌণিকতা। আদিমতার মধ্য দিয়েই কিছুটা রাবীন্দ্রিক ছায়া প্রতিফলিত হয়েছে এখানে। এই ত্রিমাত্রিক ঘনত্ব আবার কমেও এসেছে। দ্বিমাত্রিকতার দিকে গেছে। পুরাণকল্পমূলক প্রতিমা এসেছে। আদিমতার সেই অতীত বর্তমানে প্রতিফলিত হয়েছে। ১৯৯৪-৯৫ সালে টেম্পারা ও মিশ্রমাধ্যমে আঁকা এই প্রদর্শনীর ‘প্যাশান’ ছবিটি এর একটি দৃষ্টান্ত। লাল প্রেক্ষাপটের ছবিটিতে সিংহবাহিনী দেবী, শরীরী মিলনে লিপ্ত নর-নারী এসবের উত্তপ্ত পরিমণ্ডলে যখন দেখা দেয় এক ঝাঁক সাদা উড়ন্ত পাখির প্রতিমা, তখন বাস্তবের আলোড়ন জারিত হয়ে যে কাব্যময়তা জেগে ওঠে, তাতে রাবীন্দ্রিক অনুষঙ্গের কিছু আভাস পাওয়া যায়।
মানবীচেতনা তাঁর ছবির প্রধান একটি উৎস। নারীত্বের আত্মগত আবেগ দিয়ে তিনি জীবন ও প্রকৃতিকে অনুধাবনের চেষ্টা করেন। সেই চেতনাকে তিনি ছড়িয়ে দেন সমগ্র প্রকৃতিতে। টেম্পারায় আঁকা ‘মেনস্ট্রুয়েটিং উইদিন নেচার’ শীর্ষক ছবিটি এর অন্যতম একটি দৃষ্টান্ত। যেখানে নারীত্ব সমগ্র প্রকৃতিকে পরিব্যাপ্ত করে। এর পাশাপাশি চলতে থাকে নিসর্গ নিয়ে তাঁর নানা রকম রূপবিন্যাস। ‘সলিচ্যুড’ ছবিটিতে রাবীন্দ্রিক নিসর্গের প্রতিফলন খুব স্পষ্ট অনুভব করা যায়। এই নিসর্গই আবার বিমূর্তায়িত হয়ে যায়। ‘ডিসেন্ডিং রিভার্স ফ্রম দ্য পার্পল স্কাই’ ছবিটি এই বিমূর্তায়িত নিসর্গের দৃষ্টান্ত, যেখানে শিল্পী একান্ত নিজস্ব এক রূপরীতি তৈরি করতে পেরেছেন। আবার ‘দ্য এনসেন্ট আউল’ ছবিতে যখন তিনি আঁকেন আঁধারলিপ্ত একটি প্যাঁচা বা ‘ওয়ান্ডার অব একসিসটেন্স’ ছবিতে একটি প্রাচীন কচ্ছপ, তখন বলিষ্ঠ আয়তনময়তায় অভিব্যক্তিবাদী যে অস্তিত্ব উঠে আসে, তার ছায়াময়তায় রাবীন্দ্রিক অনুষঙ্গের পরোক্ষ আভাস থাকে। এর পাশাপাশি অলঙ্করণময় ডিজাইনধর্মী রূপায়ণের দিকেও তাঁর ঝোঁক এসেছে সম্প্রতিকালে। এখানে ‘দ্য বাটারফ্লাই এগেনস্ট রেড’ ছবিটি এর অন্যতম দৃষ্টান্ত। মোট ৭৩টি ছবি নিয়ে আয়োজিত অনেকটা পূর্বাপর চরিত্রের এই প্রদর্শনীটি থেকে তাঁর বিবর্তনেরও কিছু আভাস পাওয়া যায়। |
|
|
|
|
|