ইনফোসিস-উইপ্রো যাতে রাজ্য ছেড়ে চলে না যায়, তার জন্য এ বার উদ্যোগী হলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তাদের প্রকল্পকে এসইজেড তকমা দেওয়া নিয়ে বিতর্কের জেরে ইনফোসিস-উইপ্রোর এ রাজ্য ছেড়ে চলে যাওয়া যখন এক প্রকার পাকা, তখন শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “ইনফোসিস-উইপ্রো যে কেউ আসতে পারে। সবাই ওয়েলকাম।” প্রশাসনিক কর্তাদের মতে, এই মন্তব্যের মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রী
বুঝিয়ে দিলেন যে, এই দুই তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার লগ্নি ধরে রাখতে তিনি একটা মধ্যপন্থা নিচ্ছেন। আর সে জন্য এ দিন আরও এক বার কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন মমতা।
মহাকরণে মমতা।
নিজস্ব চিত্র |
তিনি যে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বা এসইজেড গড়ার বিরোধী, তা রাজ্যে বিধানসভা ভোটের আগেই তৃণমূলের নির্বাচনী ইস্তাহারের মাধ্যমে স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন মমতা। ক্ষমতায় আসার পরে তাঁর পক্ষে সেই অবস্থান বদলানো কঠিন। গত বৃহস্পতিবারই সল্টলেকে এক অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “ইনফোসিসের জন্য খুব খারাপ লাগছে। ওদের এসইজেড তকমা দিতে না পারায় খারাপ লাগছে। কিন্তু আমি এসইজেড না-করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে পারি না। আমি খুব জেদি। কেউ বলতে পারেন এটা বদ অভ্যাস। কিন্তু আমি ওই রকমই।” এ দিনও তিনি বলেছেন, “আমাদের সিদ্ধান্ত হল এসইজেড করা যাবে না। আমি আমার নিজের এগ্রিমেন্ট কী করে ভায়োলেট করব?”
সে ক্ষেত্রে ইনফোসিস বা উইপ্রোর পক্ষে রাজ্যে প্রকল্প গড়া কী ভাবে সম্ভব হবে? গত বৃহস্পতিবার মমতার বক্তব্যে ইনফোসিসকে ধরে রাখার চেষ্টার ইঙ্গিত ছিল না। কিন্তু এ দিন মহাকরণ সূত্রের খবর, নিজের অবস্থান সামান্য নরম করে মমতা সেই বিকল্প পথের সন্ধান শুরু করেছেন।
দীর্ঘ টালবাহানার পরে পশ্চিমবঙ্গে ইনফোসিসের লগ্নি নিয়ে জটিলতা কাটে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমলেই। এসইজেড করা নিয়ে তৎকালীন প্রধান শাসক দল সিপিএমের মধ্যেও মতপার্থক্য ছিল। শেষ পর্যন্ত ছোট এসইজেড গড়ার পক্ষে সায় দেয় সিপিএম পলিটব্যুরো। সেই মতো উইপ্রোর প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ সারা হয়ে যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ বাকি। রাজারহাটে জমি দেওয়া হয় ইনফোসিসকে।
কিন্তু নতুন সরকারের জমানায় ফের সঙ্কট দেখা দেয় এসইজেড তকমা ঘিরে। ইনফোসিসের পক্ষে জানিয়ে দেওয়া হয়, এসইজেড না হলে তাদের পক্ষে রাজ্যে বিনিয়োগ করা কঠিন। কেন না, সে ক্ষেত্রে কর ছাড়-সহ বিভিন্ন আর্থিক সুযোগসুবিধা মিলবে না। এই অবস্থায় রাজ্য সরকারের তরফে কেন্দ্রকে অনুরোধ করা হয়, এসইজেড তকমা ছাড়াই ইনফোসিসকে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার জন্য। কিন্তু তাতে কতটা কাজের কাজ হবে সে নিয়ে ইনফোসিস সূত্রে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মমতা এ দিন বলেন, “আমরা কেন্দ্রকে বলেছি, আউট অফ দ্য ওয়ে তে গিয়ে এসইজেড-এ যে সব সুবিধা ইন্ডাস্ট্রি-কে দেওয়া হয় সেগুলি ইনফোসিসকে দেওয়া হোক। ওদেরই (ইনফোসিস) বা বলার দরকার কী যে, এসইজেড না হলে হবে না! তথ্যপ্রযুক্তি একটা অন্য রকম শিল্প।”
কেন এসইজেড নিয়ে তাঁর আপত্তি, সেই ব্যাখ্যা দিয়ে মমতা এ দিন বলেন, “জমি নিয়ে দালালি করে হাজার-হাজার একর জমি নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। রাজারহাটে তিন-চার জন গুন্ডাকে দিয়ে জমি দখল করা হয়েছিল। এই কায়দাটা
এবং রাজনৈতিক ফায়দাটা আমরা ভাল বলে মনে করিনি।”
ইনফোসিস-উইপ্রোর ক্ষেত্রে এসইজেড তকমা ছাড়াই কেন্দ্রের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা আদায় যদি সমস্যা সমাধানের একটা ভাবনা হয়, তা হলে অন্য ভাবনাটা হল ইতিমধ্যেই এসইজেডের ছাড়পত্র পাওয়া কোনও প্রকল্প এলাকায় এই প্রকল্প দু’টিকে নিয়ে যাওয়া। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রে বলা হচ্ছে, কোন জায়গায় প্রকল্প হবে তা নিয়ে দুই তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থারই নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ আছে। বস্তুত, সেই প্রশ্নে (এবং পছন্দের এলাকায় জমির দাম নিয়ে) বাম জমানায় দীর্ঘদিন থমকে ছিল ইনফোসিসের প্রস্তাব। ফলে অন্য কোনও জায়গায় প্রকল্প সরাতে তারা রাজি হবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তবে সম্ভাব্য সব রকম পথ খতিয়ে দেখতে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, মুখ্যসচিব সমর ঘোষ এবং শিল্পসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মমতা বৈঠক করবেন বলে মহাকরণ সূত্রে খবর।
তিনি যে শিল্প-বিরোধী নন, ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তা বোঝানোর চেষ্টা করছেন মমতা। সম্প্রতি জমির ঊর্ধ্বসীমা সংক্রান্ত ছাড় পাওয়ার যোগ্য প্রকল্পের তালিকা অনেক বিস্তৃত করে দিয়েছেন তিনি। জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে ‘কেস টু কেস’ সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এই সিদ্ধান্তকে শিল্পায়নের পক্ষে অত্যন্ত জরুরি প্রথম ধাপ হিসেবে স্বাগত জানিয়েছে শিল্প মহল। তবে একই সঙ্গে জমি অধিগ্রহণ সম্পর্কে তৃণমূলের অনমনীয় অবস্থানকে শিল্পায়নের বাধা হিসেবেই দেখছে তারা। মমতা অবশ্য এ দিনও সেই অবস্থানে অনড় থেকে বলেছেন, “আমরা বলেছিলাম, বিশেষ কারণ ছাড়া জমি অধিগ্রহণ করব না। এই সরকার তেমন কিছু করবে না। তবে আজও বাঁকুড়া ও বর্ধমানে দু’টি সংস্থার জমির ঊর্ধ্বসীমা সংক্রান্ত কেস ক্লিয়ার করেছি। শিল্পের কারণে যদি কারও কাছে বেশি জমি থাকে তা হলে তাকে আমরা অনুমতি দেব।”
প্রশাসনিক এবং তৃণমূল সূত্রে বলা হচ্ছে, শিল্পায়ন ছাড়া রাজ্যের ভোল যে পাল্টানো সম্ভব নয়, সেটা মমতাও জানেন। সেই কারণেই উইপ্রো-ইনফোসিসকে ধরে রাখার এই নতুন চেষ্টা। পাশাপাশি বিদেশি লগ্নি টানার চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে রাজ্য সরকার। ইতিমধ্যেই ইজরায়েল, চিনের মতো দেশ রাজ্যে বিনিয়োগে উৎসাহ দেখিয়েছে। এ রাজ্যে আসছেন মার্কিন বিদেশসচিব হিলারি ক্লিন্টনও। মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেন, “সবাই তো আসছেন। অনেকে বাংলায় শিল্প করতে চাইছেন। স্বাগত। আমেরিকা আমাদের সুপার পাওয়ার। এটা তো বড় ব্যাপার।”
তবে হিলারির সফর ঘিরে যাতে অকারণ প্রত্যাশার চাপ তৈরি না হয়, সে ব্যাপারেও সতর্ক মমতা। হিলারি তাঁর সঙ্গে বিনিয়োগ নিয়ে কথা বলবেন কিনা জানতে চাওয়া হলে এ দিন তাঁর মন্তব্য, “সেটা কী করে বলব? আপনারা তো দেখছি জন্মের আগেই অন্নপ্রাশনের দিন ঠিক করে ফেলছেন!” |