গত দু’বছরে শিলিগুড়ি ও তার আশপাশের প্রচুর মানুষের কাছ থেকে প্রায় তিনশো কোটি টাকা তুলে নিয়ে ব্যবসা গোটানোর অভিযোগ উঠেছে দু’টি চিটফান্ড সংস্থার বিরুদ্ধে। এবং প্রশাসনের নাকের ডগাতেই ঘটনাটি ঘটেছে বলে খোদ দার্জিলিং জেলা পুলিশের রিপোর্ট। পুলিশকে সংস্থা দু’টির কাজকর্ম সম্পর্কে তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে বলেছিল রাজ্য লিগ্যাল এড অথরিটি। পুলিশ জানিয়েছে, আমানতকারীদের টাকা ফেরত না-দেওয়ার অভিযোগে দুই সংস্থার কয়েক জন এজেন্ট ও এক ডিরেক্টরকে গ্রেফতার
করা হয়েছে।
রাজ্য জুড়ে বিভিন্ন চিটফান্ডের বিরুদ্ধে আদালতে বিস্তর অভিযোগ আসে। বহু মানুষ প্রতারিত হয়ে আইনি সহয়তা চান। দার্জিলিং জেলার এক আইনি সহায়তা সংগঠনের তরফে অমিত সরকারও চিট ফান্ডের ‘প্রতারণা’ নিয়ে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। যার ভিত্তিতে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি পিনাকী ঘোষ রাজ্য লিগ্যাল এড কর্তৃপক্ষকে যথোচিত ব্যবস্থা নিতে বলেন। তদন্ত শেষ করে রিপোর্ট পাঠিয়েছেন দার্জিলিঙের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার।
কী বলা হয়েছে তাতে?
পুলিশি রিপোর্ট অনুযায়ী, অভিযুক্ত দুই চিটফান্ড সংস্থার প্রচারে প্রভাবিত হয়ে শিলিগুড়ি ও লাগোয়া অঞ্চলের বহু মানুষ তাদের ফাঁদে পা দিয়েছিলেন। দু’টি সংস্থা শহর জুড়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। একটি সংস্থার প্রচারে এ-ও বলা ছিল যে, টাকা গচ্ছিত রাখলে সংস্থার প্রযোজিত সিনেমা-সিরিয়ালে অভিনয় কিংবা নাচ-গানের সুযোগ মিলবে। স্থানীয় বহু ছেলে-মেয়েকে এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ করে সংস্থা দু’টি।
কী ভাবে কারবার চালাচ্ছিল তারা?
পুলিশ-রিপোর্টের দাবি, এজেন্টরা গ্রাহকদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ১০০ টাকা জমা রাখলে এক বছর পরে ১৬০ টাকা আসবে। অর্থাৎ ৬০% সুদ! বলা হয়, দেড় বছরে জমা টাকা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। বস্তুত, প্রথম দিকে বেশ কিছু গ্রাহক প্রতিশ্রুত হারে টাকা পেয়েও যান। চিটফান্ডের দেওয়া চেক নগদে ভাঙাতে তাঁদের অসুবিধে হয়নি।
ফলে মুখে মুখে দুই সংস্থার নাম ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ চাকুরিজীবী, রাজমিস্ত্রি, দিনমজুর থেকে শুরু করে পরিচারক, সব্জি বিক্রেতা, মাছ বিক্রেতা বহু লোক তাদের গ্রাহক হয়ে যান। প্রতি দিন তাঁরা ফান্ডে টাকা জমা দিচ্ছিলেন। এমনকী, অনেকে ব্যাঙ্কের ফিক্সড ডিপজিট ভেঙে চিট ফান্ডে টাকা ঢেলেছিলেন।
আর এই ভাবে এক বছরেই সংস্থা দু’টি প্রায় তিনশো কোটি টাকা বাজার থেকে তুলে নেয় বলে পুলিশ-রিপোর্টে বলা হয়েছে। তারা ওয়েবসাইটেও বিভিন্ন ‘প্রকল্প’ নিয়ে বিজ্ঞাপন দিতে থাকে। কিন্তু ২০১১-র জুনের পরে ছবিটা আচমকা বদলে যায়, যখন দুই সংস্থার চেক ব্যাঙ্কে ‘বাউন্স’ হতে শুরু করে।
ব্যাঙ্ক জানিয়ে দেয়, দুই কোম্পানির অ্যাকাউন্টে কোনও টাকা নেই! দেখা যায়, ওদের অফিসে তালা, ওয়েবসাইট অদৃশ্য, বিজ্ঞাপনের হোর্ডিংও খুলে নেওয়া হয়েছে। বোঝা যায়, কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে তারা ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে।
পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে জানতে পারে, মহারাষ্ট্রের দুই বাসিন্দা ওই দুই চিটফান্ডের মালিক। রামসজীবন সাহেব রাম চৌধুরী নামে তাঁদের এক জনকে পুলিশ ধরতে পেরেছে। কিন্তু টাকার সন্ধান মেলেনি। সংস্থার তেমন কোনও স্থাবর সম্পত্তিও নেই বলে জানিয়েছে পুলিশ।
রাজ্য সরকারকেও এই রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে। উল্লেখ্য, পশ্চিমবঙ্গে কয়েকটি চিটফান্ডের ভূমিকা খতিয়ে দেখতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক (আরবিআই) এবং সেবি-কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখেছেন সিপিএম নেতা গৌতম দেব।
মঙ্গলবার তিনি বলেন, “আমি আরবিআইয়ের গর্ভনর ও সেবি-র চেয়ারম্যানকে চিঠি লিখে কয়েকটি চিটফান্ডের বিষয়ে জানিয়েছি। ওরা কোথা থেকে টাকা তুলছে, কারা তাদের ডিরেক্টর বা ওই চিটফান্ড-মালিকদের কী কী ব্যবসা আছে এ সব তথ্য আরবিআই এবং সেবি’কে পাঠানো হয়েছে।” |