খেলার খবর |
|
‘গুলি খেলা’
অর্ঘ্য ঘোষ • ময়ূরেশ্বর |
|
বছর কুড়ি-পঁচিশ আগেও গ্রামেগঞ্জে তেমন দোকানপাট ছিল না। কিন্তু শীত অর্থাৎ ধান তোলার মরসুমে অলিতে-গলিতে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠত অস্থায়ী দোকান। ধানের বিনিময়ে গ্রামবাসীরা ওই সব দোকান থেকে সংগ্রহ করতেন তেলেভাজা-সহ বিভিন্ন জিনিসপত্র। কচিকাঁচারাও মাঠে মাঠে ঘুরে ঝড়ে পড়া ধানের শিস সংগ্রহ করে তা দিয়ে কিনত মার্বেল বা গুলি। তাই শীতের সময় ছোটদের হাতে হাতে ঘুরত রংবেরংয়ের মার্বেল। অপেক্ষাকৃত মোটা চিনা মাটির মার্বেলও মিলত।
মার্বেল খেলা মূলত চার প্রকারের-- ‘জেতা-জিতি’, ‘খাটা-খাটি’, ‘গাই-বাছুর’ এবং ‘ওয়ান-টু’। জেতাজিতি খেলাটি একককেন্দ্রিক। এই খেলার জন্য মাঠে একটি ছোট গর্ত কাটা হয়। যাকে বলা হয় ‘গোপ’। ‘গোপ’ থেকে ফুট দু’য়েক দূরে একটি সরলরেখা টানা হয়। যার প্রচলিত নাম ‘গচ্চা’ দাগ। ওই দাগ থেকে ৭-১০ ফুট দূরে ‘দান দাগ’ নামে টানা হয় আরও একটি সরলরেখা। ৮-১০ জন খেলোয়াড়রের মধ্যে কে আগে দান নেবে তা স্থির করে নেওয়া হয় টসের মাধ্যমে। এরপর নিজেদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রত্যেকে ১-২ কিংবা ৩টি করে মার্বেল টস জয়ীর হাতে তুলে দেয়। এ ছাড়াও প্রত্যেকের হাতে থাকে একটি অপেক্ষাকৃত মোটা আকৃতির মার্বেল। যাকে বলা হয় ‘আটা’। সাধারণত চিনামাটির মার্বেলই ‘আটা’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। টসজয়ী অর্থাৎ দানচালকারীকে সব মার্বেলগুলি ‘গোপ’ নিশানা করে সতর্কতার সঙ্গে ছুড়তে হয়। যদি কোনও গুটি ‘গচ্চা দাগ’ তার না হয় তাহলে দানচালকারীকে ‘গচ্চা’ দিতে হবে। অর্থাৎ প্রথমে একজন যে সংখ্যক গুটি দিয়ে খেলা শুরু করছিল, সেই সংখ্যক গুচি গচ্চা দিয়ে ফের দান চালতে হয়। যদি ‘গচ্চা’ দেওয়ার মত প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত গুটি না থাকে তাহলে ধার হিসেবে অন্যদের থেকেও নেওয়ার রীতি রয়েছে। |
যদি দানচালকারী ঠিকঠাক দান চেলে এক বা একাধিকগুটি ‘গোপে’ ঢোকাতে পারে তাহলে তার ওই গুটিগুলি জেতার সম্ভাবনা থাকে। তবে এক্ষেত্রে আরও একটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয় তাকে। অন্যান্য খেলোয়াড়রা গোপের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা গুটিগুলির মধ্যে একটিকে নির্দিষ্ট করে দেয়। দানচালকারীকে ‘আটা’ ছুড়ে ওই গুটিটিকে মারতে হয়। যদি ওই গুটি দানচালকারী ঠিকঠাক মারতে পারে তাহলে গোপে ঢোকা গুচি-সহ সমস্ত গুচি সে পেয়ে যায়। যদি নিশানা ব্যর্থ হয়, তাহলে গোপে ঢোকা গুটিগুলি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। তবে নিশানা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ‘আটা’ যদি অন্য কোনও গুটিকে স্পর্শ করে তাহলে সে সুযোগও হারিয়ে ফের ‘গচ্চা’ দিতে হয়। ‘খাটা-খাটি’তে একক ভাবে দু’ দল কিংবা দলগতভাবে দু’ দল করে খেলোয়াড় নিয়ে খেলা চলে। কে বা কারা আগে খাটানোর অধিকারী হবে তা নির্ধারিত হয় টসের মাধ্যমে। যারা খাটবে তারা একটি বর্গাকার ঘরে ১টি করে গুটি রাখবে। দানচালকারীরা ১৫-২০ ফুট দূরত্ব থেকে বর্গাকার ঘর নিশানা করে নিজেদের ‘আটা’ ছুড়বে। এরপর আঙুলের মাথায় আটা রেখে অন্য দু’টি আঙুল দিয়ে পেছনের দিকে টেনে বর্গাকার ঘরে রাখা বিপক্ষের গুটি নিশানা করে ছুড়ে দেবে। আটার ধাক্কায় বার্গাকার ঘর থেকে বিপক্ষের গুটি কমপক্ষে চার আঙুল দূরত্বে পাঠাতে হবে। না হলে খাটানোর সুযোগ হারাবে প্রথমপক্ষ। যদি দানচালকারী সফল হয় তাহলে একই কায়দায় লক্ষ্যভ্রষ্ট না হওয়া পর্যন্ত বিপক্ষের গুটি দূরে পাঠানোর সুযোগ মেলে। দানচালকারী লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে বিপক্ষকে কনুই কিংবা হাতের একটি আঙুল মুড়ে নিজের গুটি অনেকটা ‘নাক খত’ দেওয়ার কায়দায় বর্গাকার ঘরে পৌঁছে দিতে হয়। এই প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় ‘খাটা-খাটি’। খাটাখাটি চলাকালীন বিপক্ষকে নানা রকম টিকা-টিপ্পনী কিংবা অঙ্গভঙ্গি করে উত্যক্ত করার রীতিও প্রচলিত আছে। সব উপেক্ষা করে নিজের গুটি ঘরে পৌঁছে দেওয়ার পর খাটানোর সুযোগ পায় বিপক্ষ।
যেকোনও সংখ্যক খেলোয়াড় নিয়ে মূলত একক ভাবে খেলা হয় ‘গাই-বাছুর’। এ ক্ষেত্রে একাধিক রেখা বিশিষ্ট বর্গাকার ঘরে সকলকে একটি করে গুটি রাখতে হয়। মাঝের গুটিটি গাই এবং বাকিগুলি বাছুর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে সকলকে নিজেদের আটা, ঘর অভিমুখে ছুড়তে হয়। যার গুটি ঘর থেকে সবথেকে দূরে পড়বে তাকে সে খাটাখাটির মতই প্রথমে একটি বাছুর, ঘরের চার আঙুল দূরত্বের বাইরে বের করতে হবে। যদি সফল ভাবে বাছুর বের করা যায়, তাহলে একই কায়দায় অন্য বাছুরগুলিকেও বের করার সুযোগ মেলে। যদি বাছুর চার আঙুল দূরত্ব অতিক্রম না করে, তাহলে ‘গচ্চা’ হিসেবে ফের একটি গুটি দিয়ে খেলায় সামিল হতে হবে দানচালকারীকে। কিন্তু যদি কেউ গচ্চা এড়িয়ে সমস্ত বাছুর-সহ গাইকেও বের করতে পারে, তখন ক্রমান্বয়ে বেশি দূরত্বে অবস্থানকারীরা একে একে নিজেদের আটা দিয়ে একই কায়দায় দানচালকারীর আটা নিশানা করে ছোড়ে। যার আটা প্রথমে দানচালকারীর আটাকে আঘাত করতে পারে, সে সমস্ত গুটি পেয়ে যায়। অন্যথায় সকলে ব্যর্থ হলে বাছুর-সহ গাইয়ের মালিক হয়ে যায় দানচালকারী। ‘ওয়ান-টু’ খেলায় একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে খেলোয়াড়দের গোপ নিশানা করে গুটি ছুড়তে হয়। যার গুটি গোপে ঢোকে সে মোড় আওতার বাইরে যায়। এরপর সর্বাধিক দূরত্বে পড়া গুটির মালিক হাতের আঙুলের টিপে ওয়ান-টু-থ্রি থেকে টেন পর্যন্ত গণনা-সহ নিজের ঘুটি দিয়ে অন্যদের গুটিকে আঘাত করে গোপে ঢোকাতে পারে, সেও যায় মোড় আওতার বাইরে। সর্বশেষজনকে তখন মোড় মেনে নিতে হয়। এরপর মোড়ধারীর পূর্ব নির্ধারিত দূরত্ব থেকে গোপ লক্ষ করে নিজের গুটি ছোড়ে। গুটি গোপে প্রবেশ করলে তাকে আর মোড় খাটতে হয় না। কিন্তু ব্যর্থ হলে অন্য খেলোয়াড়রা পর্যায়ক্রমে ইচ্ছামত দূরত্ব থেকে নিজেদের গুটি হাতের আঙুলের টিপে মোড়ধারীর গুটি দূরে পাঠায়। ওই সময় প্রতিটি টিপে খোলোয়াড়রা-- ‘এক-এ ইঁদুর, দুই-এ দাঁত, তিন-এ তেঁতেন, চার-এ চোর, পাঁচ-এ পঁচো, ছয়-এ-ছুঁচো, সাত-এ-শালিক, আট-এ-এঁটুলি, নয়-এ- ন’ সম্বন্ধ, দশ-এ বিয়ে’ বলে রাগায় বা খেপায়। মোড়ধারীর গুটি দূরে রাঠানোর প্রক্রিয়া শেষ হলে অর্থাৎ সমস্ত খেলোয়াড়দের গুটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে মোড়ধারীকে নিজের গুটি আঙুলের টিপে গোপে ঢোকাতে হয়। যত টিপ ব্যর্থ হয় অন্য খেলোয়াড়রা তখন ‘এক-এ-একটি ছেলে, দুই-এ-দুইটি ছেলে’ বলে ফের রাগাতে থাকে। গোপে গুটি ঢুকলে রেহাই মেলে মোড়ধারীর। ফের নতুন করে খেলা শুরু হয়।
ময়ূরেশ্বরের দাসপলশার অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষিকা তৃপ্তি দাস এব তার সহপাঠী লোকপাড়ার বধূ হরপার্বতী ঘোষ-রা বলেন, “এক সময় মার্বেল খেলার জন্য স্কুল এবং বাড়িতে প্রচুর বকুনি খেয়েছি। আজও ওই খেলা স্মৃতিতে ভেসে ওঠে। এখন ওই খেলা দূরের কথা, দোকানে মার্বেলই পাওয়া যায় না!
|
(হারিয়ে যাওয়া খেলা-পর্ব ১৭) |