মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সেটা বুঝতে হবে। আর ঘৃণার সংস্কৃতি?
সে তো প্রায় সাড়ে তিন দশকের বাম জমানাতেও ছিল। প্রশ্ন তুলেছেন
শিবাজীপ্রতিম বসু |
এক যে ছিল পথ, তার উপান্তে এক প্রাসাদ। বন্ধুর, প্রাত্যহিক জীবনের রক্তক্লেদমাখা পথ, সর্পিল। এ পথে চলতে গেলে শুধু স্থিতবুদ্ধি হলেই চলে না, বেপরোয়া, সংঘর্ষময় হয়ে উঠতে হয়। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে কেউ কেউ প্রাসাদে পৌঁছয়। প্রাসাদটি অতি সম্ভ্রান্ত, ঐতিহ্যে গম্ভীর, সৌজন্য ও কূটনীতির মিশেলে ঢাকা যা থেকে বিচ্ছুরিত হয় ক্ষমতার প্রতাপ ও মায়া। প্রাসাদ পথকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় কখনও মধুর প্রলেপে, কখনও পরুষ হাতে। পথও প্রতিনিয়ত পেশ করে চলে চাওয়া-পাওয়ার, অন্যায়-প্রতিকারের নিত্যনতুন দাবিপত্র।
এ হেন টানাপোড়েন সত্ত্বেও, এ দেশে পথ ও প্রাসাদের সম্পর্ক অচ্ছেদ্য। পরস্পরের পরিপূরক। সেই পথিকই সফল, যিনি বন্ধুর পথপরিক্রমার পরেও প্রাসাদে সাবলীল; আবার, ক্ষমতাসৌধে বসেও যিনি ভোলেন না জন-পথকে। তাই, সম্প্রতি ভারতীয় প্রেস কাউন্সিলের সভাপতি মার্কণ্ডেয় কাটজু যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সাম্প্রতিক কার্টুনকাণ্ড প্রসঙ্গে মনে করিয়ে দেন, ‘তিনি (শ্রীমতী বন্দ্যোপাধ্যায়) তার পথের লড়াকু নন, (রাজ্যের) মুখ্যমন্ত্রী’, তখন বক্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা সত্ত্বেও খটকা লাগে। কারণ, এই বক্তব্যে পথের রাজনীতির সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রিত্বের (অর্থাৎ প্রাসাদী ক্ষমতার) বিরোধাভাসকে স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। অথচ, ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জন-রাজনীতি আর প্রাতিষ্ঠানিক/সরকারি ক্ষমতাকে কখনওই পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়।
সম্প্রতি ফেসবুকে মমতা ও তাঁর দলের দুই গুরুত্বপূর্ণ নেতার ছবির পাশে সত্যজিৎ রায়ের কিশোরপাঠ্য ‘সোনার কেল্লা’-র দু’টি জনপ্রিয় চরিত্রের আদলে যে ইঙ্গিতপূর্ণ সংলাপ রচনা করা হয়েছে, এবং তা অন্যদের কাছে ‘ফরওয়ার্ড’ করা নিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপককে যে হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে, তা নিয়ে প্রতিবাদের যে ঝড় উঠেছে, তা সম্ভব হয়েছে, কারণ দেশটির নাম ভারত। ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও সংবিধানের পিছনে আছে উদার গণতন্ত্রের আদর্শ, যার প্রতিফলন ঘটেছে সংবিধানের ১৯ নম্বর ধারায়, যার জেরে ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ নাগরিকদের মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি উনিশ মাসের জরুরি অবস্থার শেষে এই অধিকার স্বমহিমায় ফিরেছে।
এর বিপরীতে, সাম্প্রতিক চিনে, কমিউনিস্ট পার্টি যে ভাবে ১৯৯২ সালে তৈরি হওয়া অতি জনপ্রিয় আধ্যাত্মিক গোষ্ঠী, ফালুন গং’কে (১৯৯৯ থেকে) ‘সরকারবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেছে, মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার চালিয়ে এবং এই গোষ্ঠীর ইন্টারনেট সংযোগ আর ওয়েবসাইটে নিষেধাজ্ঞা জারি করে তার সঙ্গে ভারতের মতো উদার গণতন্ত্রের তফাতটা শিশুও বুঝতে পারবে! বিরুদ্ধ জনমত পদদলনে হিটলারের নৃশংসতা অতুলনীয়, কিন্তু হিটলারের সমসাময়িক সোভিয়েত ইউনিয়নের জোসেফ স্তালিনও এ ব্যাপারে কম যেতেন না। প্রতিবাদী কণ্ঠরোধে স্তালিন-জমানার যে-সব কীর্তি প্রকাশিত হয়েছে, বিশেষত বুখারিনের মতো প্রবীণ নেতাদের বিরুদ্ধে দেশ ও কমিউনিজম বিরোধিতার অভিযোগ তুলে বিচারের নামে প্রহসন চালিয়ে যে ভাবে নিকেশ করা হয়েছে, তার বর্ণনা পড়লে শিউরে উঠতে হয়।
তাই, শাসকপক্ষকে ভিন্ন/বিরুদ্ধমত সইতে হলে, কার্টুন-সহ নানা রঙ্গব্যঙ্গ হজম করতে হলে তাদের উদারনৈতিক সংস্কৃতি থেকেই শিক্ষা নিতে হবে চিন বা প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে নয়। পরমতসহিষ্ণুতার উদারনৈতিক ঐতিহ্যকেও দু’ভাবে দেখা যায় একটি নীতি বা আদর্শের দিক থেকে, অন্যটি প্রয়োজন বা স্ট্র্যাটেজির দিক থেকে। প্রথমটির প্রতিফলন দেখা যায় ভলতেয়ার থেকে টমাস পেন-এর মতো উদারপন্থীদের এমত মনোভাবে, যা বলে: ‘তুমি যা বলছ, তা আমি মানি না, কিন্তু আমি জীবন দিয়েও তোমার (আমার বিরুদ্ধ-মত) বলার অধিকার রক্ষা করব।’ দ্বিতীয় দিক থেকে, শাসক প্রতিষ্ঠান-বিরোধী মত প্রকাশ করার সুযোগ দেয় এই ভেবে যে, নতুবা শাসকবিরোধী ক্ষোভ জমে জমে এক সময় ফেটে পড়ে শাসন ব্যবস্থাকেই ধ্বস্ত করে দেবে। অনেকটা এই ভাবনাই অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউমকে জাতীয় কংগ্রেসের মতো প্রতিষ্ঠান স্থাপনে উদ্যোগী করেছিল। এই ভাবনা থেকেই ডিভিশন আইনে ইংরেজ সরকার ভারতের আঞ্চলিক ভাষাগুলিতে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলির ওপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করলে, রবীন্দ্রনাথ ১৮৯৮ সালে টাউন হলে ‘কণ্ঠরোধ’ নামক প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য: আমাদের মধ্যে ভয়ংকরত্বের আর কোনও লক্ষণ নাই; কেবল একটি আছে আমরা অজ্ঞাত।...তবে হে রাজন, আমাদিগকে আরও কেন অজ্ঞেয় করিয়া তুলিতেছ।...যে একমাত্র উপায়ে আমরা আত্মপ্রকাশ করিতে পারি, তোমাদের নিকট আপনাকে পরিচিত করিতে পারি, তাহা রোধ করিয়া ফল কী।...সংবাদপত্র যতই অধিক এবং অবাধ হইবে, স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে দেশ ততই আত্মগোপন করিতে পারিবে না।...
|
রাজ্যের বর্তমান ব্যবস্থাকে যদি ভীষণ রকম কণ্ঠরোধী মনে হয়, তবে কিঞ্চিৎ অদূর অতীতে তাকাতে অনুরোধ করি। ক্ষমতায় আসীন হওয়ার দু’বছরের মধ্যে বামফ্রন্টের প্রধান শাসক দল কী ভাবে আনন্দবাজার পত্রিকার সমালোচনামূলক অবস্থানের জন্য এই পত্রিকার বিরুদ্ধে তীব্র রাজনৈতিক আক্রমণ চালানোর পাশাপাশি সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়ে (যুক্তি: মূল্যহার বেশি! কোনও সাম্প্রতিক প্রতিতুলনা মনে আসছে?) শায়েস্তা করতে চেয়েছিল, তা সুবিদিত। আর ঘৃণার সংস্কৃতির পরাকাষ্ঠা প্রত্যক্ষ করেছি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজীবনের শেষ দিকে, যখন প্রয়াত সন্তোষ ভট্টাচার্য উপাচার্য হলেন। শাসক দলের অপছন্দ হওয়ায় ভদ্রলোক বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শাসক দল নিয়ন্ত্রিত কর্মচারী ও ছাত্র সংগঠনের বিক্ষোভ শুরু হত। অনেক দিন গাড়ির দরজা খুলতেও বাধা দেওয়া হত, যেখানেই তিনি যেতেন পিছু পিছু ধিক্কার-মিছিল। তাঁর পুরো কার্যকালটাই এই কাণ্ড চলেছিল।
কিন্তু আগে হয়েছিল বলেই কি এখনও হবে? রাতারাতি পরিবর্তন আসবে না। পূর্বতন শাসকদের সর্বত্র দখলদারির মানসিকতার প্রবাহ নতুন শাসক দলেরও অনেককে আক্রান্ত করবে, এবং সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ও বুদ্ধিতে অনেক কাঁচা হওয়ায় বর্তমান শাসককুলের বাড়াবাড়ি চোখে পড়বে অনেক বেশি। এই মিডিয়া বিস্ফোরণের যুগে প্রতিনিয়ত তা পত্রেপুষ্পে পল্লবিত হবে। এ ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার ও শাসক দলের একমেবাদ্বিতীয়ম্ নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা অপরিসীম। পশ্চিমবঙ্গে কোনও একক ব্যক্তি (বিধানচন্দ্র রায়ও নন) এমন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা ভোগ করেননি। বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন তিনি। তাই তাঁর দায়িত্বও বিপুল। তাঁকে পথেরও হতে হবে, প্রাসাদেরও। সংগ্রামী মেজাজের সঙ্গে মেশাতে হবে আরও বেশি উদার সহিষ্ণুতা, স্থৈর্য।
|
শ্রীচৈতন্য কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক |