প্রবন্ধ ৩...
সমাজ যদি প্রশ্ন না
তোলে, নেতার কী দায়?
শ্চিমবঙ্গের পরিবর্তিত সরকারের এক বছর পূর্তির প্রাক্কালে এক গভীর সংশয় নাগরিক জীবনকে ত্রস্ত করে তুলেছে। অনেকেই মনে করছেন যে, সরকার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে আহত করছে এবং এই পরিবর্তন তাঁরা আদৌ চাননি। ফিরে আসছে নন্দীগ্রামোত্তর স্মৃতি। এটাই কি কাম্য ছিল? না কি অনাবিল শান্তির প্রবাহে নিয়ত অবগাহনান্তে পারস্পরিক পিঠ চুলকানির চমৎকার অভ্যাস বজায় রাখলেই পরিবর্তনের জমানাকে দিব্যি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা যেত!
আসলে গোড়ায় কতকগুলো গলদ আছে। আমরা মার্ক্সীয় চিন্তা বা উদার গণতন্ত্রের কাঠামোগুলিকে গ্রহণ করতে চেষ্টা করেছি তার অন্তর্বস্তুকে বাদ দিয়েই। কখনওই এ কথা ভাবিনি যে, উভয়েই বস্তুত ইউরোপীয় আলোকায়নের সন্তান। অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপ সমাজচিন্তায় যে যুক্তির প্রাধান্যকে স্বীকার করেছিল, তারই ফসল এক দিকে যেমন মার্ক্সবাদ, অন্য দিকে উদার গণতন্ত্র। আমেরিকার স্বাধীনতার যুদ্ধ, ফরাসি বিপ্লব, মার্কিন বিল অব রাইটস গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও রাজনৈতিক তর্কশীলতার এক একটি সোপান মাত্র।

মার্ক্স এই প্রসারকে বুর্জোয়া গণতন্ত্র আখ্যা দিলেও সভ্যতার অগ্রগতি হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। নাগরিক জীবনের অধিকারপ্রাপ্তিকে রাজনৈতিক মুক্তি হিসেবে সম্মানিত করেছিলেন তিনি। এই রাজনৈতিক মুক্তিই যে সর্বজনীন মানব মুক্তির পথ প্রশস্ত করবে, স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন তা-ও। সমাজতন্ত্রের একটি অবশ্যম্ভাবী শর্ত যে নাগরিক অধিকার ও রাজনৈতিক গণতন্ত্রের উপস্থিতি, সে বিষয়ে তত্ত্বগত ভাবে মার্ক্সীয় প্রজ্ঞায় কোনও বিরোধাভাস নেই। কে না জানে মার্ক্স স্বয়ং লিখেছেন একাধিক মূলস্রোতের সংবাদপত্রে এবং জীবন অতিবাহিত করেছেন ‘সুশৃঙ্খলিত’ বুর্জোয়া গণতন্ত্রের আবহে। ওই সভ্যতার যা-কিছু প্রাপ্তি, তাকে গ্রহণ করেই এগিয়েছেন তার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করার জন্য।
মার্ক্সের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ ভাবনার তাত্ত্বিক জন স্টুয়ার্ট মিলও আলোকায়নের সন্তান। সেই জন্যই তাঁর চিন্তাপ্রবাহে কখনওই ‘নিশ্চয়তা’ প্রাধান্য পায়নি। অবিরত প্রশ্ন করে গেছেন পারিপার্শ্বিক কাঠামোগত ব্যবস্থাদির সীমাবদ্ধতাকে। উদার গণতন্ত্রকে দু’হাত তুলে সমর্থন করলেও বারংবার সচেতন করেছেন যে, সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাবনাকে নিরন্তর প্রশ্নবিদ্ধ না করলে তা কালক্রমে স্বৈরাচারের জন্ম দেবে। ‘টাইরানি অব দ্য মেজরিটি’ বা সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচার যে উদার গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা, সে কথা উল্লেখ করে গেছেন প্রায় তাঁর সমস্ত রচনাতে। অন্যের শুভ চিন্তার দ্বারা সতত নিয়ন্ত্রিত জীবন অপেক্ষা নিজের ভুল চিন্তার দ্বারা অতিবাহিত জীবন যে অধিকতর মূল্যবান, উল্লেখ করেছেন সে কথা। নির্বোধের সন্তুষ্টির চাইতে সক্রেটিসের অসন্তুষ্টি যে মানবসভ্যতাকে অধিকতর সমৃদ্ধ করে, সে কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি।
মুশকিল হল, এক দিকে যেমন মুক্ত সমাজের নির্মাতা হিসেবে উদার গণতান্ত্রিক ভাবনা অগ্রসর হল, অন্য দিকে তেমনই মার্ক্সবাদ প্রযুক্ত হতে থাকল ‘রাজনৈতিক মুক্তি’র স্বাদ-না-পাওয়া সমাজকাঠামোয়। বিংশ শতাব্দী দেখল এক বিচিত্র দ্বন্দ্ব তত্ত্বের সঙ্গে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন পর্যবসিত হল ফ্যাসিবাদে, আর মার্ক্সীয় মানবমুক্তির দায়িত্ব নিল পার্টি। নাগরিক অধিকারের স্বপ্ন গোল্লায় গিয়ে নেতৃত্বের জয়গানই হয়ে উঠল তাবৎ বিপ্লববাদীদের পরিণতি। ফ্যাসিবাদের সঙ্গে বিধ্বংসী লড়াইয়ে উদার গণতন্ত্র জয়লাভ করলেও পার্টি নিয়ন্ত্রিত সমাজতন্ত্র কণ্ঠরোধ করে গেছে, করে চলেছে আজও পৃথিবীর কোনায় কোনায়। নাগরিক অধিকার সমৃদ্ধ রাজনৈতিক মুক্তি যে সমাজতন্ত্রের পূর্বশর্ত, কমিউনিজম যে গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ রূপ এই সব মার্ক্সীয় আলোকপ্রাপ্ত বাতুলতা নির্বাসিত হয়েছে ক্ষমতার বেয়নটের খোঁচায়। যে প্রাচ্যের ‘ওরিয়েন্টাল ডেসপটিজম’কে মার্ক্স এত ভয় পেতেন, তা-ই গ্রাস করেছে তাঁর তত্ত্বকে।
আমাদের দেশেও ক্ষমতা ও তত্ত্বের দ্বন্দ্বকে নানা ভাবে দেখেছি। উদার গণতান্ত্রিক কাঠামোকে গ্রহণ করলেও প্রায়শই রক্তের মধ্যে এক ভিন্নতর আধিপত্যের জীবাণু মাথাচাড়া দেয়। সেই জীবাণু লুকিয়ে আছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের অভ্যন্তরে ক্ষমতার বহুস্তরীয় বিন্যাসের মধ্যে। তা কখনও শিশুকন্যাকে হত্যা করতে শেখায়, কখনও বা শিল্পীর ইজেল চুরমার করে তাঁকে দেশত্যাগী হতে বাধ্য করে। সামাজিক ক্ষমতার সঙ্গে আপস করে রাজনৈতিক ব্যবস্থা। উচ্চবর্ণের বাহিনীকে পর্যুদস্ত করতে তৈরি হন নিম্নবর্ণের মসিহা, জাতীয় দলের আধিপত্যে তিতিবিরক্ত প্রান্তিকতা জন্ম দেয় আঞ্চলিক দলের। সিপিএমের পাল্টা হয়ে উঠে আসে তৃণমূল।
উঠে আসে বটে, কিন্তু যে আধিপত্য তাকে জন্মলাভে বাধ্য করেছে, তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকে সে। তার কাছ থেকে শিখে নেয় কী ভাবে প্রভাব ধরে রাখতে হয়, কী ভাবে প্রশ্নবাণকে প্রতিহত করতে হয়। সমাজ নেতা তৈরি করে। সামাজিক জীবন যদি বিশ্বাসে স্থির থাকে, সংশয়ে ব্যাকুল না হয়, তবে নেতার কী দায় সেই সমাজকে পাল্টানোর! তাই ক্ষমতার যতই রং পাল্টাক, ধরন একই থাকে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের দায় ক্রমাগত প্রশ্ন করে ক্ষমতার অচলায়তনকে ভেঙে দেওয়া, যাতে সেখানে মুক্ত বাতাস ঢুকে শাসকের কর্মকুশলতাকে সমৃদ্ধ করে। সে দায় আমাদের সবার। সমাজের। সাধারণত কাল প্রবহমান। মানুষ যা করে, করে তার উত্তর-প্রজন্মের জন্য। তবে ক্ষেত্রবিশেষে পূর্বপ্রজন্মের জন্যও কিছু করা যায়।

এক প্রবল অত্যাচারী জমিদারের ইন্তেকাল আসন্ন। তিনি তাঁর একমাত্র পুত্রকে ডেকে বললেন, ‘‘শোনো বাবুসোনা, আমি চলে গেলে তুমি জমিদার হবে। পিতার ঋণ শোধ কোরো। আমি জীবনে কোনও প্রশংসাই পাইনি। তুমি প্রথম থেকেই এমন বিচিত্র অত্যাচার শুরু করবে যে লোকে দু’হাত তুলে বলবে ‘এর বাপটা ভাল ছিল’, তবেই আমার আত্মার শান্তি হবে।’’

বঙ্গবাসী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.