|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
গণতন্ত্রের পরীক্ষায় তবে সব্বাই ফেল |
ঘরে বাইরে ক্রমশই স্পষ্ট, ক্ষমতার ‘প্যারানয়া’-র জায়গাটায় কিন্তু গণতন্ত্র এবং
অ-গণতন্ত্রের মধ্যে আজ আর তেমন বড় কোনও ফারাক নেই। লিখছেন
সেমন্তী ঘোষ |
ব্যাপারস্যাপার দেখে গা দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছে। এই যখন অবস্থা, তবে তো আমাদের যে কারও উপরই যখনতখন চরম বিপদ নেমে আসতে পারে। সরকার তো আমাদের যে কাউকেই জেলে পুরতে পারে।
আতঙ্কের এই শীৎকার শোনা গেল না, কলকাতায় নয় খাস আমেরিকায়। প্রসঙ্গ না, অম্বিকেশ মহাপাত্র নয় জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। “দি অ্যাসাঞ্জ কেস মিনস্ উই আর অল সাসপেক্টস্ নাও”, মার্কিন সাংবাদিক জন পিলগার-এর মন্তব্য। অ্যাসাঞ্জের মামলার চূড়ান্ত পর্ব এখন চলছে সুইডেনে, যে শুনানির পর খুব সম্ভবত তাঁকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে সমর্পণ করা হবে, এবং সেখানে তাঁর অপেক্ষায় সম্ভবত সাজানো থাকবে যাবজ্জীবনের জেল। অ্যাসাঞ্জ ও তাঁর আর এক সঙ্গী সাংবাদিক ব্র্যাডলে ম্যানিং, এই দুই জনই যাকে বলে ‘হুইস্লব্লোয়ার’, দুর্নীতি ফাঁস করাই তাঁদের কাজ। মার্কিন রাষ্ট্র পাগলের মতো এঁদের তাড়া করে চলেছে ২০১০-এর শেষ থেকে। তাঁদের নাম শুনলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীনরা শিউরে ওঠেন, কেননা বিভিন্ন রাষ্ট্রের, বিশেষত আমেরিকার, গোপনতম অনলাইন নথিপত্র ফাঁস করে দিয়ে রাষ্ট্রকর্তাদের অভূতপূর্ব বিপাকে ফেলেছে ‘উইকিলিকস্’। অন্য দিকে, অ্যাসাঞ্জের নামে আতঙ্কে সচকিত হয়ে ওঠেন গণতান্ত্রিক আমেরিকার সাধারণ নাগরিকও, কেননা ‘উইকিলিকস্’-এর মধ্যে যেহেতু কোথাও কোনও বেআইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, কাগজে কলমে কোনও অনৈতিক কাজ করা হয়নি, উইকিলিকস্-কর্তা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে কোনও ব্যক্তিগত দুর্নীতি বা অন্যায়ের অভিযোগ আনা যায়নি, এবং সেই জন্য শেষ পর্যন্ত তাঁকে যে ভাবে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানোর চেষ্টা চলছে এত দিন ধরে এর মধ্যে নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার ভঙ্গের এক ভয়ঙ্কর নিদর্শন দেখছেন তাঁরা। |
|
যে মামলা হচ্ছে, সবটাই মোটের উপর ভিত্তিহীন, আসল কথাটা অত্যন্ত সরল, গোপন ইনডিক্টমেন্ট ও গোপন গ্রেফতারি পরওয়ানা নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্র প্রস্তুত, অ্যাসাঞ্জের তদন্ত-সাংবাদিকতা তাঁদের পক্ষে একটু বেশিই বিপজ্জনক। স্বভাবতই, কাকে বলে গণতন্ত্র, কাকে বলে মৌলিক অধিকার, এই প্রাথমিক প্রশ্নসমূহ নিয়ে তোলপাড় চলছে পশ্চিমি নাগরিক সমাজে।
তোলপাড় প্রাচ্যেও। সেই ভুবনেও একটি রাষ্ট্রে নাগরিকদের মধ্যে এই মুহূর্তে আত্মপ্রকাশের অধিকার নিয়ে তীব্র কিন্তু গোপন সংগ্রাম। যদিও সে রাষ্ট্র গণতন্ত্র নয়, যদিও সে রাষ্ট্রের বাসিন্দাদের এখনও খাতায়-কলমে ‘নাগরিক সমাজ’ বলে ভূষিত করা শক্ত। হ্যাঁ, চিনে সরকারি তদারকিতে চলছে ‘ইন্টারনেট-হান্টিং’, অগুনতি বারের পর আরও এক বার। কেন? কেননা, এর মধ্যে সে দেশে একটা গুরুতর ঘটনা ঘটে গিয়েছে। চিনা কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম বড় নেতা বো জিলাই ও তাঁর স্ত্রীকে একটি হত্যাকাণ্ডে যুক্ত থাকার অভিযোগ এনে দল থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। এত বড় নেতার এমন রাতারাতি বহিষ্কার? স্বভাবতই প্রশ্নে প্রশ্নে উন্মুখ নাগরিকরা, উতলা উতরোল ওয়েব-এর মুক্ত পরিসরে। অনেকেরই অনুমান, মাও জে দং-এর অনুসরণে পুরনো ঘরানার সমাজতন্ত্রের ধুয়ো তুলছিলেন এই ‘কট্টর সমাজতন্ত্রী’ নেতা, এক ভিন্ন মতাদর্শের মুখ তৈরি করতে চাইছিলেন, আর তাই দলদ্রোহিতার শাস্তি দিতে মিথ্যা অভিযোগে ভূষিত করে তাঁকে সরিয়ে দিল সংস্কারপন্থী সদর দফতর। অনুমানমাত্রই। প্রকৃত ঘটনা অবশ্যই বেজিং-এর পার্টি অফিসের রুদ্ধদ্বারের ধূম্রজালে বন্দি। তবে সেই প্রকৃত ঘটনা যা-ই হোক না কেন, এমন গুরুতর বিষয় নিয়ে রাষ্ট্রবিরোধী (ও পার্টিবিরোধী) কানাঘুষো তো শুরু হবেই, এবং বেজিং-তন্ত্র তো তা দমন করবেই। কোমর বেঁধে নেমে দুই লক্ষেরও বেশি ‘পোস্ট’ ইন্টারনেট থেকে মুছে দিয়েছেন চিনা সরকারি কর্তারা, সেই সব পোস্ট-এ বো জিলাই কিংবা তাঁর স্ত্রী-র বহিষ্কার বিষয়ে নানাবিধ বক্তব্য ছিল। বেজিং-এর সঙ্গে ইন্টারনেট-এর সম্পর্ক কেমন, সবারই জানা। নতুন খবর এটুকুই, বছরখানেক ধরে তুলনামূলক ভাবে কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করছিলেন সে দেশের নাগরিকরা। গুগ্ল ইত্যাদি ব্যবহার করা যাচ্ছিল। সেই খোলা হাওয়ার ঝটকা চেপেচুপে রুদ্ধ করা হল।
|
এবং মধ্যবিশ্ব |
পশ্চিম ও পুবের সঙ্গে অবশ্যই রয়েছে মধ্য-পৃথিবী নামান্তরে মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া যেখানে বহু কাল ধরেই মুক্ত যোগাযোগ তথা ইন্টারনেট ব্যাপারটি অত্যন্ত সন্দেহভাজন ও বিপজ্জনক হিসেবে গণ্য। ‘আরব স্প্রিং’ আন্দোলনের পিছনে ইমেল ও টুইটার-এর বিরাট ভূমিকা নিয়ে রাশি রাশি প্রশংসা বর্ষিত হয়েছে, কিন্তু বলা হয়নি যে, কত দিকের কত আঁটুনির মধ্যে এই ফস্কা গেরোগুলি তাদের কাজ করে গিয়েছে। বলা হয়নি, কী প্রবল দাপটে বিভিন্ন পশ্চিম এশীয় দেশ মহাক্রোশে বার বার ঝাঁপিয়ে পড়ছে ওয়েব-দুনিয়ার উপর। ২০১১ সালে মিশরের প্রসিদ্ধ আন্দোলন শেষ হওয়ার পর যে দিন সে দেশে নির্বাচন হল, গণতন্ত্রের শুভারম্ভ নিয়ে বহু উচ্ছ্বাসের মধ্যে বিশেষ শোনা গেল না একটি তথ্য: নির্বাচনের অব্যবহিত আগে-পরের দিনগুলিতে গোটা দেশে ইন্টারনেট পুরোপুরি ‘শাট-ডাউন’ করা ছিল! ‘আরব স্প্রিং’-এর ‘সাফল্য’র অন্যতম সূচক, নিশ্চয়ই!
তবে সবাইকে ছাপিয়ে যায় ইরান। এই মুহূর্তে তুঙ্গে সে দেশের ইন্টারনেট পুলিশগিরি। গত মাসে দেশের পার্লামেন্ট নির্বাচনের সময়ে ‘জি-মেল’ পর্যন্ত বন্ধ করা হয়েছে। তেহরানের ‘প্যারানয়া’ এতটাই তীব্র যে রাষ্ট্রীয় নিষিদ্ধ তালিকায় জুড়ে গেছে ‘ম্যাপকোয়েস্ট’ বা ‘গুগ্লম্যাপ’-এর মতো সাইটও। সিরিয়াতেও চলছে ‘ইন্টারনেট ক্র্যাকডাউন’, একটার পর একটা ‘সাইট’ বন্ধ হচ্ছে। সিরীয় বা ইরানিদের অবশ্য এত করেও ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। সুকৌশলে তাঁরা নিয়মিত নিষিদ্ধ সাইটসমূহ ‘ভিজিট’ করে চলছেন। চলছে ইঁদুর-বেড়াল খেলা, ডালে ডালে পাতায় পাতায় চলা। শোনা গেল, ‘বালাটারিন’ নামে একটি সংবাদ-সাইট ইরানে নিষিদ্ধ, কিন্তু সেই সাইটে মাসে মাত্র তিন কোটি নিয়মিত ভিজিটরের চল্লিশ শতাংশেরও বেশি হলেন ইরানি বাসিন্দা! কী করে বেড়া ভাঙেন তাঁরা? হরেক উপায়, দেশি কিংবা বিদেশি, উদ্ভাবন কিংবা আমদানি। একটা উদাহরণ না দিয়ে পারা যাচ্ছে না। যে সব প্রোগ্রাম ব্যবহার করে নিষিদ্ধ সাইটে প্রবেশ করেন ইরানিরা, তার একটির নাম, আলট্রাসার্ফ। আমেরিকা থেকে আমদানি। উদ্ভাবক মার্কিন দেশের চিনা-রা, ফালুন-গং গোষ্ঠীর সদস্যরা। এই বিদ্রোহী ধর্মগোষ্ঠীটি চিনে নিষিদ্ধ, তাদের বিভিন্ন ওয়েবসাইটও নিষিদ্ধ, কিন্তু যাতে সমমর্মী চিনা নাগরিকরা নিষেধের বেড়া পেরিয়ে এই সব সাইট মনের সুখে ‘অ্যাক্সেস’ করতে পারেন, অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন, তার জন্য আলট্রাসার্ফ প্রোগ্রামটি তৈরি করেছেন তাঁদেরই মার্কিন-প্রবাসী সহযোদ্ধারা। অধিকার-হরণের বিরুদ্ধে অধিকার-স্থাপনের সংগ্রাম। সেই সংগ্রাম এ ভাবেই পশ্চিম-পুবে সঞ্চরমাণ হতে হতে মধ্যপথেও মুক্তির ধারা বর্ষণে নিরত। ধন্য প্রতিবাদের ওয়েবায়ন।
|
স্বীকার করাই ভাল |
ইন্টারনেটের উপর দুনিয়া-জোড়া হামলার এই সব নানা ঘটনা থেকে একটা কথা স্পষ্ট। ক্ষমতার কাছে ইন্টারনেট চূড়ান্ত বিভীষিকাময়। প্রধানত দুটো কারণে। এক, ক্ষমতার প্রাথমিক কাজ ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ রাখা, এবং তার প্রাথমিক উপায়, সংবাদ নিয়ন্ত্রণ। দুই, জনসাধারণের মধ্যে সংযোগ যদি সত্যিই অবাধ হয়, তা হলে বিরোধ-বিক্ষোভের প্রবণতা বেশি ছড়ায়, ক্ষমতার পদে পদে অঙ্কুশিত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। তাই, ‘ওয়েব ফ্রিডম ফেসেস গ্রেটেস্ট থ্রেট এভার’: গুগ্ল-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সের্গেই ব্রিন সম্প্রতি একটি ব্রিটিশ পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে যেমনটা বলেছেন।
যেটা ক্রমশই লক্ষণীয় হয়ে উঠছে, ক্ষমতার এই ‘প্যারানয়া’-র জায়গাটায় কিন্তু গণতন্ত্র এবং অ-গণতন্ত্রের মধ্যে আজ আর বড় কোনও ফারাক নেই। গণতান্ত্রিক আমেরিকা ও কর্তৃত্ববাদী চিন আজ একই ভয়ে ভীত: নাগরিক চক্ষুর ভয়। অবশ্যই সে ভয়ের রকমফের আলাদা, ব্যবহারিক বহিঃপ্রকাশ আলাদা। চিন বা ইরানের মতো ওয়েব-দুনিয়ার উপর সরাসরি কোনও নিষেধাজ্ঞা শুরু হবে না আমেরিকায়, সেখানে কেবল নজরদারিই বাড়বে। অ্যাসাঞ্জের মতো দুটো-একটা দৃষ্টান্ত বেছে নিয়ে শাস্তির বন্দোবস্ত হবে, বৃহত্তর নাগরিক সমাজকে শিক্ষা দেওয়া হবে। কিন্তু এক হিসেবে এ সবই একই পথের যাত্রা। একই অনৈতিকতার কম-বেশি প্রকাশ। নাগরিক অধিকারে রাষ্ট্রের অন্যায় হস্তক্ষেপ। কোনও অপরাধ না করেই যদি অ্যাসাঞ্জ আন্তর্জাতিক অপরাধী নির্ধারিত হন, পিলগার তবে ঠিকই বলছেন, আমরা যে-কেউ যে-কোনও দায়ে অপরাধী সাব্যস্ত হতে পারি যে কোনও দিন। চিন বা ইরান বা আমেরিকা বা সুইডেন কিংবা পশ্চিমবঙ্গ সর্বত্র। কোনও ক্ষমতা রাষ্ট্রিক কূটনীতির গোপন তথ্য নাগরিক জেনে ফেললে তাকে অপরাধী বানিয়ে ছাড়ে, কোনও ক্ষমতা শাসকসমাজের কাজে নৈতিকতার প্রশ্ন তুললে প্রশ্নকর্তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করে। কোনও ক্ষমতা আবার আরও কয়েক কাঠি বাড়া, শাসককে নিয়ে রঙ্গরসিকতা করলেই রসিককে সে অপরাধী ঠাউরায়।
আসল কথা, গণতন্ত্র, আমাদের সাধের গণতন্ত্র, বড় মুখ করে যে বাক্স্বাধীনতার নীতির কথা বলে, সেই নীতিটি খুব সহজমান্য নয়। অনেক দাম ধরে দিতে হয় তার জন্য। অনেক ঝামেলা পোয়াতে রাজি থাকতে হয়। অন্যের কথা ভাল লাগলেই তাকে বলতে দেব, ভাল না লাগলে চুপ করিয়ে দেব, এই সুবিধেবাদী বাক্স্বাধীনতার নীতি দিয়ে ‘গণতন্ত্র’ হয় না।
আর একটা কথা। গণতন্ত্র নিয়ে মাঝামাঝি কোনও আপস চলে না। হয় গণতান্ত্রিক অধিকার আছে, নয়তো নেই। ‘আমাদের কুড়ি বা চল্লিশ শতাংশ গণতন্ত্র আছে, ওদের তো তা-ও নেই’, এই সব হিসেব অর্থহীন, অন্যায়ের অজুহাতমাত্র। নাগরিকের আত্মপ্রকাশের স্বাধীনতা আইনি অধিকার। যতক্ষণ না আইনের চৌহদ্দির বাইরে যাচ্ছে, ততক্ষণ সেই আত্মপ্রকাশের ঠেলায় যদি ক্ষমতার গদি টলমলও করে, তা হলে গদিটারই মেরামতি দরকার, স্বাধীনতায় হাত দেওয়া চলবে না। এইটুকু যদি নিশ্চিত না করা যায়, তা হলে স্বীকার করাই ভাল: যে সব অগণতান্ত্রিক দেশের দুর্ভাগ্যে মথিত হয় আমেরিকার কিংবা পশ্চিমবঙ্গের প্রগতিশীল হৃদয়, তারাও কিন্তু সেই সব দেশের সঙ্গে একই দলে পড়ে। গণতন্ত্রের অ্যাসিড-টেস্টে তারা সব্বাই ফেল। |
|
|
|
|
|