নাগরিক ঠিক কত দূর স্বাধীন? ইহার উত্তর কৌটিল্য হইতে তোকভিল পর্যন্ত বিভিন্ন মনীষী বিভিন্ন সময় দিয়াছেন। কালের প্রেক্ষিতে স্বাধীনতার সংজ্ঞাও বদলাইয়াছে। সাম্প্রতিক কালে আন্তর্জাল, পরিভাষায় ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব-এর যুগে সেই সংজ্ঞা ভিন্নতর মাত্রা পাইয়াছে। ‘সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট’ গোত্রের কিছু ঠিকানায় যে কোনও ব্যক্তি অবাধে তাঁহার বক্তব্য পেশ করিতে পারেন। সেই বক্তব্য প্রযুক্তির সাহায্যে তৎক্ষণাৎ বিশ্বময় ছড়াইয়া পড়িতে পারে। ইহাও স্বাধীনতার এক নূতন সংস্করণ। ওয়েব সংস্করণ। প্রযুক্তির সহায়তায় গণতন্ত্র এক্ষণে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত নামিয়া আসিয়াছে। ইহা গণতন্ত্র অনুশীলনের একটি প্রত্যক্ষ রূপ। সরাসরি ব্যক্তি তাঁহার মত জানাইতেছেন। লোকমত, স্বাভাবিক ভাবেই, ভিন্নরুচি, এবং সেই ভিন্নতা বজায় রাখিবার সম্পূর্ণ অধিকার বিদ্যমান এই সব ‘সাইট’-এ। কোনও জ্যাঠামহাশয়ের কাঁচি নামিয়া আসিবে না। বক্তব্য অসার বা কুরুচিকর হইলে তাহা উপেক্ষিত, এমনকী ধিক্কৃত হইবে। আরও যাঁহারা সেই ওয়েব ঠিকানায় আছেন, তাঁহারাই উপেক্ষা করিবেন বা ধিক্কার দিবেন। প্রতিবাদ করিবেন। সেই ব্যক্তি ক্রমে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িবেন। কোনও বহির্বর্তী খবরদারি লাগিবে না। জনতার, জনতার দ্বারা এবং জনতার জন্য গণতন্ত্র অনুশীলনের ইহা এক বিস্ময়কর পথ।
ইহার প্রভাব ঠিক কত দূর বিস্তৃত? অনতিঅতীতের ‘আরব বসন্ত’ই তাহার প্রমাণ। কিংবা, আন্তর্জালের উপর কঠোর খবরদারিতে অভ্যস্ত চিন। পাছে লোকে কিছু বলে, পাছে সেই বক্তব্য ক্রমে জনস্তরে সমর্থন খুঁজিয়া পায়, তাই চিনা প্রশাসন জনতার ওয়েব-চর্যাকেও শিকল পরাইয়া রাখিয়াছে। চিন গণতন্ত্র অনুশীলন করে না। ভারত করে। অথচ, ভারতেও জনতার ওয়েব-স্বাধীনতার প্রতি অসহিষ্ণুতা ক্রমেই বাড়িতেছে। অনতিঅতীতে কেন্দ্রীয় স্তরে কংগ্রেস-নেতৃত্বাধীন প্রশাসন, সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার ওয়েব-এ প্রকাশিত জনমতের উপর খবরদারি করিবার সিদ্ধান্ত লইয়াছে। হাতে একটি শস্ত্রও হাজির। তথ্যপ্রযুক্তি আইন। ইহার উৎপত্তি ২০০০ সালে, পরে ২০০৮-এ সংশোধনী আসে, এবং পরবর্তী কালে তাহা কার্যকর করা হয়। ইহার পরিধি কার্যত এমনই ব্যাপক যে তাহার আওতায় যে কোনও ব্যক্তির ওয়েব-কণ্ঠকে রুদ্ধ করিয়া দেওয়া চলে। সংক্ষিপ্ত একটি দৃষ্টান্ত, এই আইনের বলে যাহা কিছু ‘মানহানিকর’ বা ‘আপত্তিকর’, তাহার জন্যই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া চলে।
‘মানহানি’ বা ‘আপত্তি’র বিষয়টি কিন্তু নিতান্তই ব্যক্তিসাপেক্ষ। অবস্থানসাপেক্ষও। প্রশাসন যদি মনে করে, যে কোনও বক্তব্যকেই ‘মানহানিকর’ বলিয়া দাগাইয়া দিতে পারে। পরিণাম ইহাই যে, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে ব্যক্তির মতপ্রকাশের স্বাধীনতাটি বিপন্ন। আন্তর্জাল ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ একটি জন-পরিসর হিসাবে উঠিয়া আসিতেছে। সেখানে মত প্রকাশের, মত বিনিময়ের সুযোগ অবাধ। এই পরিস্থিতিতে ভারত কী ভাবে এমন একটি গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধকারী বিধি মান্য করিয়া চলে, তাহাই বিস্ময়ের। বিশেষত, ভারতীয় গণতন্ত্র বহুমতের সহাবস্থানের জন্যই সুখ্যাত। সেই দেশে কে কোন ওয়েবসাইট-এ কোন রঙ্গচিত্র আঁকিল, বা কোনও মস্করা করিল, তাহা পিছু ধাওয়া করিয়া রুখিবার বস্তু নহে। কার্যত, ইহা প্রশাসনের কর্তব্যকর্মও নহে। জনমনের দরওয়ান হওয়া ছাড়া প্রশাসনের আরও নানাবিধ কাজ আছে। সেইগুলি যথাযথ রূপে চালনা করাই প্রশাসনের কাজ। বিপরীতে প্রশাসন যদি রঙ্গচিত্রকারীর শাস্তিবিধানে অগ্রসর হয়, তাহাতে উল্টা ফল হইবার সম্ভাবনাই সমধিক। |