দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদের ঘণ্টাটা একাই বাজিয়েছিলেন তিনি। আর ‘মৌমাছির চাকে’ ঢিল পড়তেই কোর্ট মার্শাল হয়ে সম্মান, পদ, সব খুইয়েছিলেন। সেই অপমানের বোঝা বয়ে বেড়িয়েছেন টানা ছ’বছর। তবে সম্মান পুনরুদ্ধারের জন্য লড়াই ছাড়েননি। ‘শৌর্য’ ফেরত আনার লড়াইয়ে অবশেষে জিতে গেলেন ভারতীয় সেনার বাঙালি কর্নেল অভিজিৎ মিশ্র। ফৌজে নিম্নমানের গাড়ি খরিদের অভিযোগ ঘিরে দেশজুড়ে যখন আলোচনা, তখনই এই ঘটনাটি সেনাবাহিনীতে ‘দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত’ সংক্রান্ত বিতর্কে ভিন্ন মাত্রা জুড়েছে। কী করেছিলেন কর্নেল মিশ্র?
সেটা ২০০৬। অরুণাচলপ্রদেশে ভারত-চিন সীমান্তের অতি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ‘প্রায় ভেঙে পড়া’ সেনা-নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং রেজিমেন্টের রেশন ও টাকা ‘নয়ছয়’ নিয়ে অভিযোগ জানিয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে একাধিক চিঠি দিয়েছিলেন তিনি। পরিণাম? উল্টে ওঁরই বিরুদ্ধে অর্থ-রেশন তছরুপ এবং কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ‘দুর্বিনীত’ ব্যবহারের অভিযোগ আনা হয়। কোর্ট মার্শাল হয় তাঁর। এক বছরের কারাদণ্ডও ভোগ করেন।
এত কাণ্ডের পরেও হাল ছাড়েননি জলপাইগুড়ির পাণ্ডাপাড়ার ছেলে অভিজিৎ। প্রতিবিধান চেয়ে আইনের দ্বারস্থ হয়েছেন। আর্মড ফোর্সেস ট্রাইবুন্যালের কলকাতা বেঞ্চ শেষ পর্যন্ত তাঁকে যাবতীয় অভিযোগ থেকে মুক্তি দিয়েছে। বিচারপতি সাধনকুমার গুপ্ত এবং লেফটেনান্ট জেনারেল কে পি ডি সামন্তের বেঞ্চ গত ১৭ এপ্রিলের রায়ে জানিয়েছে, কর্নেল অভিজিৎ মিশ্রকে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে তাঁর আগের পদমর্যাদাতেই সসম্মানে পুনর্বহাল করতে হবে। চাকরির যাবতীয় আর্থিক সুযোগ-সুবিধাও তিনি পাবেন। রায়ের ৯০ দিনের মধ্যে আদেশটি কার্যকর করতে বলা হয়েছে।
কিন্তু যে ‘অনিয়মের’ কথা কর্তৃপক্ষের গোচরে আনতে গিয়ে অভিজিৎবাবুকে ‘রোষে’ পড়তে হল, সে সম্পর্কে ট্রাইবুন্যালের কী বক্তব্য?
বস্তুত ভারত-চিন সীমান্তের অতি স্পর্শকাতর এলাকায় (যেখানে যে কোনও মুহূর্তে শত্রুবাহিনী আক্রমণ হানতে পারে) নিরাপত্তা-পরিকাঠামোর ফাঁকগুলো সামনে আনতে গিয়েই যে অভিজিৎবাবুর এই হেনস্থা, বেঞ্চের রায়ে তেমনই অভিমত প্রকাশ পেয়েছে। যাতে বলা হয়েছে, কর্নেল অভিজিৎ ওই অঞ্চলে প্রহরা বাড়াতে বাড়তি সেনা চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন ফৌজের জন্য উন্নতমানের রাস্তা ও রেশন। এবং তিনি এ ভাবে ‘হুইস্ল ব্লোয়ার’-এর ভূমিকা নেওয়ায় বাহিনীর কয়েক জন সিনিয়র অফিসারের স্বার্থে ঘা লেগেছিল বলে মনে করছে ট্রাইবুন্যাল। অভিজিৎবাবুর আইনজীবী মৈত্রেয়ী ত্রিবেদী দাশগুপ্তের অভিযোগ, কোর্ট মার্শালে তাঁর মক্কেলকে আত্মপক্ষ সমর্থনের বিন্দুমাত্র সুযোগ দেওয়া হয়নি। ফলে আইন সোজা পথে হাঁটতে পারেনি। ট্রাইবুন্যালের রায়েও সেটাই বলা হয়েছে বলে আইনজীবীর দাবি।
ন’বছর বয়সে পুরুলিয়া সৈনিক স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন অভিজিৎ মিশ্র। সেখান থেকে ন্যাশন্যাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমি হয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী। দক্ষতার জন্য একাধিক পুরস্কারে ভূষিত সৈনিকটি মাত্র চল্লিশেই কমান্ডিং অফিসার। অরুণাচলের দুর্গম নামখাচু উপত্যকার জিমিথাঙে ২৬ রাজপুত রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার নিযুক্ত হলেন ২০০৩-এ। বাষট্টির চিনা অনুপ্রবেশ এখানেই ঘটেছিল। এবং অভিজিৎবাবুকে নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাতও এখানে, ২০০৬-এ। কী হয়েছিল?
টেলিফোনে অভিজিৎবাবু বলেন, “এত স্পর্শকাতর এলাকা, অথচ নিরাপত্তা-পরিকাঠামোর ৯৫ শতাংশই অকেজো! ঠিকঠাক প্রহরার জন্য সেনাকর্মী কম। উপযুক্ত যানবাহন কিংবা ফৌজি গাড়ি যাতায়াতের রাস্তা নেইা। আক্রমণ হলে মোকাবিলা করতে পারতাম না। উপরন্তু ফৌজের রেশন নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি চলছিল। লাখ লাখ টাকা খরচ করে যে খাবার আনা হচ্ছিল, তা অত্যন্ত খারাপ।” নামখাচু-র ব্রিগেডে পাঁচটা মেজর ব্যাটালিয়ন ও ১৪টি মাইনর ব্যাটালিয়ন ছিল (হেডকোয়ার্টার্স ছিল তাওয়াং)। অভিজিৎবাবুর অভিযোগ, “গেস্টহাউসে অনবরত ‘হোমড়া-চোমড়া’ অতিথিরা আসতেন। আর তাঁদের আপ্যায়ন করতে ভাগ বসতো ফৌজি রেশনে। এমনকী, অতিথিদের খুশি করতে ফৌজের টাকায় উপহার কিনে দেওয়া হতো।”
সেনা-কর্তৃপক্ষ কী বলছেন?
সেনাবাহিনীর ৪ কোরের জনসংযোগ অফিসার কর্নেল এনএন জোশীর দাবি, দুর্গম অঞ্চলে কিছু সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতা থাকে, আর প্রকৃতির রোষেই অরুণাচলের ওই অঞ্চলে রাস্তার মান উন্নত করা সম্ভব হচ্ছে না। তাঁর কথায়, “কোন সীমান্তে কত বাঙ্কার, ব্যাটালিয়ন থাকবে, তা কোনও এক জন অফিসার ঠিক করেন না। সরেজমিনে সমীক্ষা করে সেনা-কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেন।” ফৌজি-রেশনের ‘নিকৃষ্ট’ মান প্রসঙ্গে কর্নেল জোশীর মন্তব্য, “কলকাতা বা গুয়াহাটিতে যে রকম খাবার বা ফল পাওয়া যায়, দুর্গম সীমান্তে তেমনটা আশা করা হাস্যকর। তা ছাড়া সুসম্পর্ক বজায় রাখতে অনেক সময় ফৌজি-ক্যান্টিন থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের শুভেচ্ছা উপহার দেওয়া হয়। এর মধ্যে দুর্নীতির কিছু নেই।”
কিন্তু এটা মানতে পারেননি কর্নেল অভিজিৎ মিশ্র। বিষয়গুলো নিয়ে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখতে থাকেন। তাতেই কিছু অফিসারের স্বার্থে আঘাত লাগে বলে তাঁর অভিযোগ। অভিজিৎবাবু বলেন, “ওঁরা আমাকে দলে টানতে না-পেরে রেগে গিয়েছিলেন। শেষে আমাকে সরাতে এক জন সুবেদার মেজরকে দিয়ে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করালেন।” কোর্ট মার্শাল হল। কর্নেলের উদির্র্ থেকে পদমর্যাদাসূচক ব্যাচটা ছিঁড়ে নেওয়া হল সকলের সামনে।
সেটা পুনরুদ্ধারের জন্য কার্যত জীবনই বাজি রেখেছিলেন অভিজিৎ। মৈত্রেয়ীদেবী জানাচ্ছেন, ২০১১ সালে ইস্টার্ন কমান্ডের কলকাতা বেঞ্চে আইনি লড়াই শুরু করার ঠিক আগে পঞ্চাশ ছোঁয়া অভিজিৎবাবু তাঁকে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের নমিনি করে অনুরোধ করেছিলেন, মামলা চলাকালীন কোনও ভাবে তাঁর মৃত্যু হলে মৈত্রেয়ীদেবী-ই যেন অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে মামলা চালিয়ে যান!
অবিচারের শিকার হয়ে হারানো শৌর্যফলক ফিরে পেতে এতটাই ব্যগ্র ছিলেন যিনি, ট্রাইবুন্যালের রায় শুনে তাঁর প্রতিক্রিয়া কী?
টেলিফোনে অভিজিৎবাবু বলেন, “সম্মান ফেরত চেয়েছিলাম। দেরিতে হলেও পেরেছি।” |