ভারতীয় সংসদের ইতিহাসে অভূতপূর্ব ঘটনা! এই প্রথম কোনও শাসক দল ‘অভব্য আচরণে’র জন্য শাস্তি দিল দলীয় সাংসদদেরই। আর সেই কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে তারা সমর্থন পেল প্রধান বিরোধী দলের! বাজেট অধিবেশনের দ্বিতীয় পর্বে যে ‘সহযোগিতা’ যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে। লোকসভায় কংগ্রেসের আট সাংসদকে সাসপেন্ড করার ঘটনা ঘিরে আজ এই নজিরই তৈরি হল।
পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্যের দাবি নিয়ে স্লোগান তুলে লোকসভার কাজে বিঘ্ন ঘটানোয় আট কংগ্রেস সাংসদকে চার দিনের জন্য সাসপেন্ড করা হয়। মধুযাক্ষী গৌড়, পোন্নাম প্রভাকর-সহ এই আট জনই অন্ধ্রপ্রদেশের তেলেঙ্গানা অঞ্চল থেকে নির্বাচিত। তাঁরা পৃথক রাজ্যের দাবি নিয়ে স্লোগান তোলায় আজ লোকসভা দু’বার মুলতুবি করে দিতে হয়। তার পর লোকসভার বিরোধী দলনেতা সুষমা স্বরাজ, সপা নেতা মুলায়ম সিংহ যাদব, সিপিআই নেতা গুরুদাস দাশগুপ্তের সঙ্গে কথা বলেন সভার নেতা প্রণব মুখোপাধ্যায়। সংসদ সুষ্ঠু ভাবে চালানোর জন্য ওই সাংসদদের সাসপেন্ড করার প্রস্তাব দেন তিনি। সুষমারাও এতে সম্মতি দেন। পরে কংগ্রেস কোর গ্রুপের বৈঠকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। লোকসভায় প্রস্তাবটি ধ্বনি ভোটে পাশ হয়। বিতর্ক এড়াতে এনসিপি এবং তৃণমূল সাংসদরা অবশ্য সেই সময় লোকসভায় হাজির ছিলেন না।
প্রশ্ন হচ্ছে, কংগ্রেস এত কঠোর পদক্ষেপ করল কেন? সংসদের বাজেট অধিবেশনের প্রথম পর্বের শেষ কয়েক দিনও তেলেঙ্গানা নিয়ে সাংসদদের হইচইয়ের কারণেই লোকসভা বারবার মুলতুবি করতে হয়েছিল। আজ দ্বিতীয় পর্বের প্রথম দিন থেকে তারই পুনরাবৃত্তি শুরু হয়। তার পরেই সাসপেনশনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই মনে করছেন, কংগ্রেস পরিকল্পিত ভাবেই এই বার্তা দিল যে, সংসদের কাজে বিঘ্ন ঘটালে দলীয় সাংসদদেরও রেয়াত করা হবে না। ফলে এর পর বিজেপি সংসদ অচল করলে কংগ্রেসের পক্ষে তাদের সমালোচনা করা সহজ হবে।
তা হলে সেই পদক্ষেপে বিজেপি সহযোগিতা করল কেন? এ ছাড়া, প্রাথমিক ভাবে তেলেঙ্গানার মানুষ তো মনে করতে পারেন যে পৃথক রাজ্যের জন্য মুখ খোলাতেই সাংসদদের সাসপেন্ড হতে হয়েছে! ফলে তা সমর্থন করায় বিজেপি-রও রাজনৈতিক লাভ কিছু হবে না। কিন্তু লালকৃষ্ণ আডবাণী, সুষমা স্বরাজরা মনে করছেন, দু’বছর পরে যখন লোকসভা নির্বাচনে যেতে হবে, তখন বিজেপি যেন শুধু নেতিবাচক রাজনীতির ধ্বজাধারী হিসেবে পরিচিত না হয়। এটা যেন বলা যায়, সংসদে শৃঙ্খলারক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল বিজেপি। যদিও দলের অন্দরে এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। বিজেপি-র কট্টরপন্থী একটা অংশ এই সিদ্ধান্ত সমর্থনের ঘটনায় ক্ষুব্ধ। ওই অংশের মতে, এতে তেলেঙ্গানায় রাজনৈতিক ক্ষতি হতে পারে বিজেপি-র।
সংস্কারের প্রশ্নে বদ্ধ দশা কাটাতে বাজেট অধিবেশনের এই পর্বে বিজেপি-র সঙ্গে সহযোগিতার কৌশল নিয়েছে কংগ্রেস। রবীন্দ্রনাথের নামে আন্তর্জাতিক পুরস্কারের কমিটিতে সংসদে বিজেপি-র দুই প্রধান নেতা-নেত্রীকে রেখে স্বয়ং মনমোহন যে বার্তা দিতে চেয়েছেন। আবার সংস্কারের লক্ষ্যে বিভিন্ন বিল এবং শিক্ষা বিষয়ক বিল নিয়েও বিজেপির সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে কংগ্রেস। সেই সহযোগিতার ডাকে সাড়া দেওয়ার একটা নজিরই অনেকে বিজেপির আজকের পদক্ষেপে দেখতে পেয়েছেন। যদিও কংগ্রেসেরই একটা অংশ বিজেপি-কে কাছে টানার কৌশল নিয়ে দ্বিধায়। তাদের বক্তব্য, কংগ্রেসের সঙ্গে আঞ্চলিক দলগুলোর দূরত্ব বাড়লে বিজেপি যে ঘোলা জলে মাছ ধরতে নামবে না, তার নিশ্চয়তা কী? তবে এ দিনের সিদ্ধান্তের ফলে তেলেঙ্গানার কংগ্রেস নেতারা এলাকায় সহানুভূতি পাওয়ার সুযোগ পেলেন বলে রাজনীতিকদের একাংশ মনে করছেন। কারণ, তেলেঙ্গানায় প্রাথমিক ভাবে এই বার্তাই যাবে যে পৃথক রাজ্যের দাবি তোলাতেই তাঁদের সাসপেন্ড করা হয়েছে। তবে কংগ্রেসের তরফে আজ এ-ও বলে দেওয়া হয় যে, আট সাংসদকে সাসপেন্ড করার সঙ্গে পৃথক রাজ্যের দাবির সম্পর্ক নেই। |