মোটা রাজস্ব আদায়ের সুযোগ হেলায় হারাতে চলেছে রাজ্য সরকার !
কেবল টিভি ব্যবসায় যুক্ত মাল্টিপল সিস্টেম অপারেটর (এমএসও )-দের থেকে কেন্দ্রীয় সরকার পরিষেবা -কর আদায় শুরু করার পরে রাজ্য সরকারও জানিয়েছিল, কেব্লের গ্রাহকপিছু তারা প্রমোদকর নেবে। কিন্তু কর আদায়ের নিয়মকানুন এবং যথাযথ পরিকাঠামোর অভাবে কেবল -ব্যবসা থেকে রাজস্ব আদায়ের ওই উদ্যোগটি পশ্চিমবঙ্গে কার্যত বিজ্ঞপ্তির পর্যায়েই রয়ে গিয়েছে।
তার বাস্তবায়নের কোনও উদ্যোগই সরকারি তরফে চোখে পড়েনি।
সম্প্রতি কেবল -দর্শকদের সেটটপ বক্স লাগানো বাধ্যতামূলক করা সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় নির্দেশের ফলে এই ব্যবসা থেকে আয়ের একটা সুযোগ ফের এসেছে রাজ্যের সামনে। নির্দেশটি কার্যকর করলে রাজ্য দু’ভাবে লাভবান হত। প্রথমত, সেটটপ বক্স বিক্রি বাবদ মিলত মোটা বিক্রয়কর। উপরন্তু সেটটপ বক্সের প্রযুক্তির দৌলতে কেব্লের গ্রাহকসংখ্যা সঠিক জানা যেত, ফলে এমএসও -দের থেকে গ্রাহকপিছু প্রমোদকর আদায়ও সহজ হতো। সব মিলিয়ে বছরে বাড়তি অন্তত দু’শো কোটি টাকা রাজ্যের কোষাগারে আসার সম্ভাবনা ছিল বলে জানিয়েছেন অর্থ দফতরের একটি সূত্র।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার সেই পথে না -হেঁটে কেন্দ্রীয় নির্দেশের বিরোধিতা করেছে। রাজ্যের পুর -নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম মঙ্গলবার দিল্লিতে গিয়ে কেন্দ্রীয় তথ্য -সম্প্রচার মন্ত্রককে জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা এখনই পশ্চিমবঙ্গে সেটটপ বক্স বাধ্যতামূলক করার পক্ষপাতী নন। কেন?
মন্ত্রীর যুক্তি : কেবল টিভি পরিষেবাকে উন্নত পরিকাঠামো -নির্ভর করতে গেলে (ডিজিট্যালাইজেশন ) যত সেটটপ বক্স দরকার, বাজারে তত নেই। যদিও রাজ্য সরকারেরই আর এক মহলের খবর : কেবল অপারেটরদের একাংশ নতুন ব্যবস্থায় নারাজ। সরকার তাদের চটাতে চায় না। পাশাপাশি এতে এক শ্রেণির গ্রাহকও ক্ষুব্ধ হতে পারেন ভেবে রাজ্য এখনই সেটটপ বক্সে সায় দিচ্ছে না।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৯৫ -এর কেবল টেলিভিশন নেটওয়ার্কস আইনের ৭ নম্বর ধারা মোতাবেক কেবল -পরিষেবায় কন্ডিশনাল অ্যাকসেস সিস্টেম (সংক্ষেপে ক্যাস ) চালু করার নির্দেশ দিয়েছিল, ২০০৬ -এর ৩১ ডিসেম্বরে। তখনই মুম্বই -দিল্লি -কলকাতা -চেন্নাইয়ে তা চালু হওয়ার কথা হয়। সেই মতো কলকাতাকে চারটি ‘জোনে’ ভাগও করা হয়। তার পরেই কেবল অপারেটরদের প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়ে তদানীন্তন বামফ্রন্ট সরকার উদ্যোগটি থেকে পিছিয়ে আসে। এ বারও কার্যত তারই পুনরাবৃত্তি হল। তবে এ বার কেবল শিল্পে ‘ডিজিট্যালাইজেশন’-এর কেন্দ্রীয় প্রয়াসের বিরোধিতা এসেছে খোদ রাজ্য সরকারেরই তরফে।
নতুন ব্যবস্থায় সরকারের আয় না হয় বাড়ত। গ্রাহকদের কী সুবিধা হতো?
সরকারি -সূত্রের বক্তব্য : তখন গ্রাহক নিজের পছন্দমতো সব ধরনের চ্যানেল দেখতে পারতেন। স্থানীয় কেবল অপারেটরের উপরে নির্ভর করতে হতো না। পাশাপাশি কেবল -কারবারে সরকারের কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আসত। এখন রাজ্যে কত লোক কেবল সংযোগ নিয়েছেন, তা জানার উপায় নেই। কিন্তু সেটটপ বক্স বাধ্যতামূলক হলে প্রযুক্তির সুবাদেই গ্রাহকের সঠিক সংখ্যাটা পরিষ্কার হয়ে যেত। সে ক্ষেত্রে প্রমোদকর আদায়ে অনেক সুবিধা হতো। |
কেবল টিভি যে ভাবে চলে |
• সম্প্রচারকারী সংস্থা ডিশ অ্যান্টেনায় স্যাটেলাইট থেকে চ্যানেলের সিগন্যাল নেয়। সেখান থেকে কেবল মারফত তা যায় গ্রাহকের বাড়ি। |
সুবিধা |
• গ্রাহকের খরচ তুলনায় কম।
• গ্রাহকসংখ্যা থেকে বণ্টন, নিয়ন্ত্রণ কেবল সম্প্রচারকারীর হাতে। |
অসুবিধা |
• কম চ্যানেল দেখা যায়
• অ্যানালগ (সংখ্যাবিহীন ) পদ্ধতির দরুণ ছবি -শব্দ তেমন স্পষ্ট নয়।
• গ্রাহকসংখ্যা ঠিক না -জানায় ন্যায্য দর পেতে চ্যানেল -মালিকের সমস্যা |
সেট টপ বক্স থাকলে |
• গ্রাহকদের বক্স কিনতে হবে। সম্প্রচারকারীর কেবল জুড়বে বক্সে । সেখান থেকে তার জুড়বে টিভিতে।
• গ্রাহকের পছন্দসই চ্যানেলের ‘প্যাকেজ’ অনুযায়ী সেটটপ বক্সের ‘রিসিভার -ডিকোডার কার্ড’ টিউনিং করে দেবে সম্প্রচারকারী সংস্থা। মাসে মাসে টাকা দেবেন গ্রাহক। অথবা নির্দিষ্ট চ্যানেলের জন্য নির্দিষ্ট ‘রিসিভার -ডিকোডার কার্ড’ সম্প্রচারকারীর কাছ থেকে কিনবেন (বা রিচার্জ করবেন )। |
সুবিধা |
• প্রতিটি সেট টপ বক্সের নিজস্ব কোড মারফত চ্যানেল -মালিকেরা জেনে যাবেন, তাঁদের চ্যানেল কত টিভিতে দেখা হচ্ছে।
• ডিজিট্যাল সম্প্রচারের সুবাদে ছবি -শব্দ অনেক পরিষ্কার।
• এক সঙ্গে অনেক বেশি চ্যানেল দেখার সুযোগ।
• বিষয়ভিত্তিক চ্যানেলগুলো (যেমন খবর, খেলা, বিনোদন ইত্যাদি ) পর পর। |
অসুবিধা |
• কেবল সংস্থার বদলে সম্প্রচার নিয়ে শেষ কথা চ্যানেল -মালিকের।
• খরচ বাড়তে পারে। |
ডিশ টিভি বা ডিরেক্ট টু হোম সার্ভিস (ডিটিএইচ ) কী? |
• গ্রাহকই পছন্দসই সংস্থার ডিশ অ্যান্টেনা ও সেটটপ বক্স কিনবেন। কতগুলো চ্যানেল দেখবেন, তা ঠিক করে মাসে -মাসে টাকা দেবেন সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে। কিংবা নির্দিষ্ট চ্যানেল -প্যাকেজের জন্য নির্দিষ্ট ‘রিসিভার -ডিকোডার কার্ড’ কিনবেন বা রিচার্জ করবেন। |
সুবিধা |
• ছবি -শব্দ আরও পরিষ্কার।
• পছন্দমতো চ্যানেল আগে -পরে করে দেখা যাবে। |
|
নব মহাকরণে রাজ্যের প্রমোদকর আদায় বিভাগের আধিকারিকেরা জানাচ্ছেন, বর্তমানে কলকাতার কেবল অপারেটরদের গ্রাহকপিছু মাসে ১০ টাকা এবং জেলায় গ্রাহকপিছু ৫ টাকা প্রমোদকর জমা দেওয়ার কথা। “কিন্তু গ্রাহক যতই থাক, পুরসভায় গিয়ে কেবল অপারেটরেরা বছরে এক বারই সাড়ে তিন হাজার টাকা জমা দিয়ে দেন। ব্যাস, ওই পর্যন্তই।” বলেন অর্থ দফতরের এক অফিসার।
অভিযোগ, কেব্লের গ্রাহকসংখ্যা ঠিকঠাক জানার উপায় নেই বলেই বছরের পর বছর এই অনিয়ম চলে আসছে। অর্থ দফতরের কাছে কলকাতায় ১,৩০০ ও জেলায় ১,৪০০ অপারেটরের তালিকা রয়েছে। এক চ্যানেলের কর্তা জানাচ্ছেন, কোনও অপারেটরের চারশো গ্রাহক থাকলে তিনি ৫০ -৬০ জনের নাম দেন। অপারেটরেরা আবার বরাত দেন সাব -অপারেটরদের। সাব অপারেটরেরাও অপারেটরদের সব সময়ে ঠিক তথ্য দেন না বলে অভিযোগ। ফোরাম অফ কেবল অপারেটর্স -এর সুভাষ নাগের আক্ষেপ, “বহু সাব -অপারেটরের থেকে গ্রাহকের সঠিক সংখ্যা জানা যায় না। সুতরাং তারা যা বলে, সেটাই আমরা এমএসও -দের জানাতে বাধ্য হই।” আর এমএসওদের থেকে কর আদায় যদি শুরুও হয়, সেটটপ বক্স না -থাকলে এই কারণেই প্রাপ্য অঙ্কের অনেক কম টাকা রাজ্যের ভাঁড়ারে আসবে বলে জানিয়েছেন অর্থ দফতরের এক সূত্র।
অর্থাৎ, প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিকে সঙ্গী না -করার ফলে বাড়তি রাজস্ব আদায়ের সুযোগ রাজ্যের হাতছাড়া হচ্ছে। একই ভাবে গ্রাহকও বঞ্চিত হচ্ছেন চ্যানেল নির্বাচনের স্বাধীনতা থেকে। অর্থ দফতরের অফিসারদের একাংশের মতে, কেবল ব্যবসা থেকে রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে রাজ্যেরই বিশেষ উৎসাহ নেই। কেবল -কর ফাঁকি দিলে ব্যবস্থাও নেওয়া হয় না। ফলে অসংগঠিত শিল্পের মতো এই কারবার এমন ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, যার উপরে সরকারেরই নিয়ন্ত্রণ নেই !
সরকার কী বলছে? অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের দাবি, তাঁরা কেবল ব্যবসায় নির্ধারিত রাজস্বের আদায় বাড়াতে চাইছেন। তাঁর কথায়, “এখন কর দেওয়ার জন্য নাম নথিভুক্ত করতে বা রিটার্ন জমা দিতে কোথাও ঘুরতে হবে না। আমরা তথ্যপ্রযুক্তি -ভিত্তিক ই -ট্যাক্স ব্যবস্থা চালু করেছি।”
তবে তাতেও বিশেষ আশার আলো দেখছেন না অর্থ দফতরের অফিসারদের অনেকে। |