চৈত্রের শেষ থেকেই বিভিন্ন গ্রাম গঞ্জে দেখা যায় সাইকেলে চেপে চলেছেন বোলানের শিব। পিছনে বসে পার্বতী। সন্ধ্যায় প্রধানত মন্দির চত্বরে আসর বসবে। উপরে চাঁদোয়া, নীচে চট পাতা। হারমোনিয়ামের সঙ্গে ঝুমুরের সঙ্গতের শব্দেই জেগে ওঠে গ্রামও। এক এক করে ভিড় বাড়তে থাকে। রাত গড়ালে চলে আসেন বাড়ির মহিলারাও। তিন দিক ঘিরে মানুষের সারি ক্রমশ বাড়তে থাকে। প্রথানুযায়ী বোলানে শুরুতে হয় শিবের প্রার্থনা। তারপরে পালার ব্যাখ্যা। সাধারণত ছড়ার আকারেই বলে দেওয়া হয় সেই ব্যাখ্যা। অভিনেতাদের সঙ্গে পরিচিত করে দেওয়া হয় দর্শকদের। আসরে কে কী বাজাচ্ছেন, তা-ও দর্শকদের বলে দেওয়া হয় তখনই। পালা এরপর শুরু হয়ে চলে দুই থেকে তিন ঘণ্টা। এখন কখনও কখনও একটি পালা শেষ হওয়ার পরে শুরু হয়ে যায় আর একটি পালা। এই ভাবেই চলে সারা রাত। সাধারণত এক একটি দল পায় হাজার থেকে বারোশো টাকা করে। সারা গ্রীষ্মই এই দৃশ্য দেখা যাবে।
এই টেলিভিশন, ভিডিওর যুগেও গ্রামে গঞ্জে বোলান যে এখনও এই ভাবে টিকে রয়েছে, তাতে অবশ্য অবাক নয় গ্রামীণ সমাজ। তাঁরা বলছেন, বোলান আসলে রূপ ফিরিয়েছে। এখন বোলান অনেকটাই গ্রামীণ যাত্রাপালার মতো হয়ে উঠেছে। সর্বাঙ্গপুরের বাসিন্দা বিকাশ মণ্ডল বলেন, “আমরা ছোটবেলায় হ্যারিকেন নিয়ে বোলানের আসর দেখেছি। তখন খোল, হারমোনিয়াম, খঞ্জনি ছাড়া কোনও বাদ্যযন্ত্র ছিল না। সাজপোশাকেরও তেমন ঘটা ছিল না। কিন্তু অভিনেতাদের গানের গলা ছিল খুব ভাল। এখনও যেন কানে সেই রেশ রয়ে গিয়েছে।”
বিকাশবাবুর কথায়, “তখন গ্রামে যাত্রাপালাও হত। তাতে অবশ্য আলো, বাদ্যযন্ত্র, পোশাক অনেক দামি ছিল। কিন্তু সেই জনপ্রিয় গ্রামীণ যাত্রা এখন উঠে গিয়েছে।”
বেলডাঙা শ্রীশচন্দ্র বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক বলরাম হালদার বলেন, “ওই গ্রামীণ যাত্রাপালাই যেন এখন বোলানের রূপ নিয়েছে। আগে দু’টি পৃথক শিল্প থাকলেও, এখন তাদের মধ্যে ফারাক কমে গিয়েছে।” বেলডাঙার কালীতলার অভিমন্যু মণ্ডল বলেন, “গ্রামীণ যাত্রাপালা তো একরকম উঠেই গিয়েছে। তবে বোলান রয়ে গিয়েছে। কারণ, যাত্রাপালার যে খরচ, তা ব্যয় করলে গ্রামের মানুষ চায় সিনেমা দেখতে বা অন্য কোনও ভাবে বিনোদনের ব্যবস্থা করতে। বোলানের খরচ কম বলেই সে টিকে রয়েছে। অনেক জায়গায় তাই সেই যাত্রার অভিনেতারাই গ্রীষ্মে বোলানের দল বার করেন। তাই বোলানের মধ্যেই রয়ে গিয়েছে গ্রামীণ যাত্রার স্পর্শ।”
বলরামবাবুর বক্তব্য, বোলানের দুর্গতি শুরু হয়েছে রচয়িতার অভাব থেকে। আগে অনেকেই চমৎকার বোলানের পালা লিখতেন। কিন্তু এখন লেখকের অভাব। কিন্তু তা হলে বোলান চলছে কী করে? বলরামবাবু বলেন, “গ্রামীণ পালার উপরেই নির্ভর করছে এখনকার বোলান। পৌরাণিক বা সামাজিক পালাগুলি এখনও বিভিন্ন জায়গায় লেখা হয়। তার বই পাওয়া যায়। সেগুলিই সংগ্রহ করেন বোলান শিল্পীরা।” তিনি বলেন, “অনেক সময় জনপ্রিয় পালাই বোলানের শিল্পীরা অভিনয় করে দেন, এমনও দেখা গিয়েছে।” কোথাও কোথাও এখনও বোলানের পালা নতুন করে লেখা হচ্ছে। তাতে সাম্প্রতিক নানা প্রসঙ্গও উঠে আসছে। তবে তা যথেষ্ট নয়। নওদার সুধীর মণ্ডল একটি বোলানের দলের কর্তা। তাঁর কথায়, “এখনকার বোলান আগের থেকে অনেকটাই পাল্টে গিয়েছে। এখন মাইক ব্যবহার করা হয়। পোশাকও অনেক ভাল। তবে পুরনো পালা আর চলে না। নতুন পালা লেখার লোক নেই। তাই যাত্রা পালাই আমাদের ভরসা।” |