মর্মান্তিক হারের আলোড়নের মধ্যে সৌরভ
পাচ্ছেন না বোলিংয়ের প্রধান ভরসাকেও
ফিশপে পাশাপাশি বসা ওঁরা দু’জন। না আছে কাছাকাছি কোনও ফোটোগ্রাফার। না কোনও টেলিভিশন ক্যামেরা। আনন্দবাজার প্রতিনিধি বাদ দিয়ে কোনও মিডিয়ারও ছায়াপাত ঘটেনি সেখানে। তাজ করমণ্ডল হোটেলের প্রায় ফাঁকা সন্ধের কফিশপে তাই ওঁরা পেশাদারের মুখোশ পরেও নেই। মনের স্ক্যান করা গেলে যে বিভ্রান্ত, উস্কোখুস্কো মেজাজটা বার হত, সেটাই খুলে বসা।
জাম্প কাটে যেন আচমকা চিন্নাস্বামীর মঙ্গলবার রাত এগারোটা চলে এল। যখন ম্যাচের শেষ ডেলিভারিটা হওয়ার আগে মহাউদ্বিগ্ন অধিনায়ক তাঁর বহু বছরের বিশ্বাসী বাঁ হাতি পেসারের পাশে দাঁড়িয়ে ফিল্ড সাজাচ্ছিলেন। পরামর্শ দিচ্ছিলেন এখন ঠিক কোন বলটা করা উচিত।
জাম্প কাটে ভিড় করছিল এ দিনের দুপুর-বিকেলও। যখন ফেসবুক-সহ সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে এঁদের এক জনের ছবি দিয়ে চরম বিদ্রুপাত্মক স্লোগান লেখা হচ্ছিল, ‘৩৭ রান ছয় বলে? ভয় কী? ম্যায় হু না! আশিস নেহরা।’
আইপিএলের মোক্ষম মুহূর্তে শেষ বলে ছক্কা খেয়ে রাতারাতি জাতীয় বিদ্রুপের পাত্র এখন নেহরা। তা খাওয়ার অর্ডার দিয়ে সামনে পড়ে থাকা খবরের কাগজটা টানতে যাচ্ছেন, হাত বাড়ালেন পাশে বসা তাঁর অধিনায়ক। “ছাড় না, কাগজ পড়ে কী হবে?” আর বাংলায় নিচু গলায় এই সাংবাদিককে বললেন, “লাভ কী? কাগজে তো ওর সম্পর্কে ভাল কিছু নিশ্চয়ই লেখেনি!”
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ঝোড়ো চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কী আলোড়ন একটা রাত্তিরে বয়ে গিয়েছে। একে টানা পাঁচ ইনিংসে রান নেই। তার ওপর এমন অপ্রত্যাশিত ম্যাচ হার। সৌরভ মুষড়ে পড়েছেন বললে কিছুই বলা হয় না। যেন সাইক্লোন অজান্তে এসে তাঁর পুণের সযত্ন নির্মিত সৌধকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। বারবার বলছেন, “এই ম্যাচ কী করে পিছলে যেতে পারে! কোনও দিন যায়!” রাত সাড়ে তিনটে অবধি কাল জাগা ছিলেন। আজ দুপুরে ৫০ মিনিটের ফ্লাইট ধরে চেন্নাই পৌঁছনোর পরেও অস্থিরতা কাটছে নাকী ম্যাচটাই না চলে গেল!
ম্যাচের খলনায়ক হিসাবে চিহ্নিত নেহরাতিনিও গভীর অনুশোচনাগ্রস্ত। “ভারতীয় ক্রিকেটে টি-টোয়েন্টি আর ওয়ান ডে মিলিয়ে আমার চেয়ে বেশি লাস্ট ওভার কেউ বল করেনি। অপোনেন্টের জেতার জন্য মাত্র ৬ রান দরকার, এ রকম অবস্থাতেও জিতিয়েছি। কিন্তু কাল যে কী হল! শেষ ওভারে ২১ রান দেওয়াটা জঘন্য। শেষ বলটা করতে গেলাম ইয়র্কার। কোথায় পড়ে গেল। খুব খারাপ। খুব খারাপ।” সৌরভ তখন বলছেন, “তোকে বললাম স্লোয়ার কর।” নেহরা একমত নন। “দাদি তাতেও কিছু হত না। গেইল দেখলি তো, স্লোয়ারেও মিস হিটে ছয় মেরে দিল।”
একে তো মর্মান্তিক হারের হ্যাংওভার। তার ওপর বোলিংয়ের প্রধান ভরসাকেই বৃহস্পতিবার খেলাতে পারছে না পুণে। গোটা শিবির যা নিয়ে আতঙ্কিত। এমনকী যাঁরা টিমে নেই তাঁরাও। রণদেব বসুযাঁর সঙ্গে অশোক দিন্দার উত্তপ্ত গণ্ডগোল থামাতে স্বয়ং সিএবি প্রধানকে উদ্যোগী হতে হয়েছিল, তিনিও দেখলাম গভীর দুশ্চিন্তায়। “কী ভাল বল করছিল দিন্দা। ওর চোট মানে যা-তা হল।” কিছু পরে সৌরভ জানালেন, পাঁজরার কাছাকাছি চোট থাকা দিন্দা অন্তত আগামী দু’ম্যাচ বাইরে। চেন্নাইতে চেন্নাই। আর দিল্লিতে দিল্লি। গোদা বাংলায় ধোনির বিরুদ্ধে পাওয়া যাবে না। সহবাগের জন্যও না। তাঁর পরিবর্ত হয়তো আলফান্সো টমাস। কেউ কেউ পার্নেলের নামও করছেন।
এমনিতে ধোনির নামও দিন্দার মতোই ঠান্ডা ঘরে থাকার কথা। তাঁর তো আরও কঠিন জায়গায় চোটহ্যামস্ট্রিংয়ে। পুণে প্রাথমিক খবর নিয়ে জেনেছে ঋদ্ধিমান সাহা খেলছেন। তার মানে কি ধোনি খেলছেন না? নাকি ব্যাটসম্যান হিসাবে তাঁকে খেলিয়ে ঋদ্ধিকে কিপ করাবে সিএসকে? সাংবাদিকেরা যত বার জানতে গেলেন তাঁদের একটা আন্দাজ দেওয়া হল, ধোনিকে নিয়ে আবার সমস্যা কীসের! কিন্তু সেটা সত্যি তাই? না মনস্তাত্বিক চাপ রাখতে চাওয়া? রাত এগারোটাতেও চেন্নাই কর্পোরেট মহলের লোকজন বললেন, সিএসকে টুইট করে বলছে ধোনি কাল খেলবে। তার মানেই কোথাও কোনও টেনশন আছে। সত্যি কী, চেন্নাইয়ের কুয়াশার মতোই পরিষ্কার নয়। সৌরভ বললেন, “ও ঠিক খেলবে।” কারও কারও আবার তৃতীয় সম্ভাবনার কথা মনে হচ্ছে যে, চেন্নাই ব্যাটিংয়ের স্তম্ভ অ্যালবি মর্কেল দক্ষিণ আফ্রিকায় তাঁর বন্ধু খুন হওয়ার খবর পেয়ে ঝটিতি দেশে ফিরে গিয়েছেন। তাই ধোনিকে দিয়ে হয়তো মরিয়া চেষ্টা করা হবে। টিমের অবস্থাও এমনি ভাল নয়। পুণে যেখানে দুটো হেরেছে, চেন্নাই সেখানে তিনটে।
চেন্নাই শহরের হালফিল মেজাজের সঙ্গে আইপিএল টিমের অবস্থান কোথাও যেন খাপ খেয়ে যায়। এমনিতে প্রভূত সম্পদশালী অথচ অসন্তোষ বিদ্ধ হয়ে রয়েছে।
চেন্নাইয়ে এখন ফাইভ স্টার হোটেলের সংখ্যা ২৬। সব ক’টা সারা বছর ভর্তি থাকে। বিশাল সব ফ্লাইওভার। ঝকঝকে রাস্তা। নতুন নতুন শিল্প। গাড়ি আর আইটি তো রমরম চলছেই। সে জয়ললিতা সরকারে থাকুন বা করুণানিধি, তফাত কিছু হয় না। বিদেশি শিল্পোদ্যোগীরা নিয়মিত আসছেন। সবচেয়ে বেশি অধুনা জাপানিরা। শুনলাম চেন্নাই অবস্থিত জাপানি কোম্পানির সংখ্যা এখন ১৮৬। নরেন্দ্র মোদীর গুজরাতের মতোই শিল্প সম্ভাবনায় জ্বলজ্বল করছে তামিলনাড়ু। অথচ তার খাস-শহরের বাসিন্দারা অনেকেই প্রবল অস্বাচ্ছন্দ্যে। একে তো বিটকেল গরম পড়েছে। তাপমাত্রা ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তার মধ্যে মেট্রোর লাইন তৈরি হচ্ছে বলে শহরের প্রধান রাস্তা মাউন্ট রোডের জায়গায়-জায়গায় খোঁড়া আর ওয়ান ওয়ে। যানজটে রোজই তাই মুম্বইকে ধরে ফেলছে চেন্নাই। আর অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছেন যাত্রীরা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রোজ বাধ্যতামূলক দু’ঘণ্টা লোডশেডিং। প্রতিদিন নিয়ম করে নির্ধারিত এলাকায় যা হচ্ছে। শুনলাম ক্রমবর্ধমান শিল্পের জন্য যে পরিমাণ বিদ্যুৎ দরকার তার যোগান নেই। তাই বাধ্য হয়ে গৃহস্থের ঘাড়ে থাবা বসছে।
চেন্নাই সুপার কিংসও কি শহরেরই প্রতীকী? দু’বারের আইপিএল চ্যাম্পিয়ন। এক বারের ফাইনালিস্ট। এক বার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ী। অথচ খেলায় সেই হেভিওয়েটের পুরনো মস্তানি কোথায়? স্থানীয় সান টিভির ফোন ইন প্রোগ্রামে ক্রিকেটভক্তরা রীতিমতো বিলাপ করছেন, কোথায় গেল আমাদের সেই টিম। এক ক্রিকেট সমর্থক উত্তেজিত ভাবে বললেন, “টিমের খেলা দেখে নাওয়াখাওয়া বন্ধ করে দিতে হচ্ছে।” প্রাক্তন ক্রিকেটার সদাগোপান রমেশ ছিলেন অনুষ্ঠানে। তিনি আশ্বস্ত করলেন, “আরে এত ভেঙে পড়বেন না। আমরা চিরকালই দেরিতে জাগি। তারপর এক বার জেগে গেলে টুর্নামেন্টটা ধরে নিই।”
ওমলেটের সঙ্গে সম্বর মিশিয়ে একটা বিচিত্র কম্বিনেশন গলাধঃকরণ করতে করতে নেহরা বলছিলেন, “আমাদের বাকি এগারো ম্যাচে জিততে হবে পাঁচটা। তা হলেই সেমিফাইনাল। বেঙ্গালুরু জিততে যখন পারিনি চেন্নাইটা জিততেই হবে। ভীষণ ইম্পর্ট্যান্ট।” চেন্নাই-- তারাও অঙ্ক করছে। সেমিফাইনাল মডেল কীসে কত যানজটহীন হতে পারে? অনুমান করছি এত ম্যাচ হারা না থাকলে ধোনিকে খেলানোর ব্যাগ্রতা থাকত না।
সবে দু’সপ্তাহ গড়িয়েছে আইপিএল। কিন্তু টিমগুলোর ওপর এখনই এমন শিরশিরানি যে, ব্যক্তি বনাম ব্যক্তি অদৃশ্য। লড়াইটা পুরোপুরি দল বনাম দল। কারও মুখে যে এক বারও শুনলাম না যে, ম্যাচটা আবার সেই সৌরভ বনাম ধোনি!




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.