ব্যতিক্রমী ভাটোরা
উন্নয়নে এক সিপিএম-তৃণমূল-কংগ্রেস
মাটিতে কোদালের কোপ পড়ছে ঝপাঝপ। ঝুড়িভর্তি মাটি উঠে যাচ্ছে মজুরদের মাথায়। ফেলা হচ্ছে রাস্তার উপরে। সেই মাটির উপর পড়ছে লাল মোরাম। ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে সর্বদলীয় কমিটির তত্ত্বাবধানে রাস্তা তৈরির কাজ চলছে হাওড়ার ভাটোরা গ্রাম পঞ্চায়েতে।
এমন ভাবেই তো চলে উন্নয়নের কাজ? তা হলে ভাটোরা গ্রাম পঞ্চায়েত আলাদা কীসে?
আলাদা। কারণ, এখানে সর্বদলীয় কমিটি আক্ষরিক অর্থেই সর্বদল। সেখানে সিপিএম-কংগ্রেস-তৃণমূলের সমান সংখ্যক প্রতিনিধি রয়েছে। যাঁদের তত্ত্বাবধানে থেমে যাওয়া উন্নয়নের কাজ আবার শুরু হয়েছে।
উন্নয়নের স্বার্থে রাজনীতি বিসর্জন দিয়েছে নরেন্দ্র মোদীর গুজরাত। প্রবল রাজনৈতিক বিরোধিতা সত্ত্বেও রাজ্যের উন্নয়নে সেখানে হাত মেলায় কংগ্রেস-বিজেপি। এ রাজ্যে বিগত বাম সরকারের আমলে সেই সংস্কৃতি যেমন দেখা যায়নি (বাম নেতারা অবশ্য বলবেন, প্রধান বিরোধীদল তৃণমূলই তাঁদের সঙ্গে ‘সহযোগিতা করত না’), তেমনই বর্তমান সরকারের আমলে উদয় হয়েছেন মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। যিনি সিপিএমকে ‘ঘৃণা’ করার রাজনীতিতে বিশ্বাসী। নিজের জেলা উত্তর ২৪ পরগনার দলীয় কর্মীদের তিনি তেমনই নির্দেশ দিয়েছেন। পাশে পেয়েছেন দলের অঘোষিত দু’নম্বর নেতা তথা রেলমন্ত্রী মুকুল রায়কেও।
‘দৃষ্টান্ত’ গড়ে হাওড়ার ভাটোরা পঞ্চায়েত এর একেবারে উল্টো রাস্তায় হাঁটছে।
হাতে হাতে। সর্বদলীয় কমিটির তত্ত্বাবধানে ১০০ দিনের
কাজের প্রকল্পে তৈরি হচ্ছে রাস্তা। ছবি: হিলটন ঘোষ
সিপিএম শাসিত এই পঞ্চায়েতে প্রধান এবং উপপ্রধানের বিরুদ্ধে থানায় দুর্নীতির অভিযোগ দায়ের হওয়ায় দু’জনেই ফেরার হয়ে গিয়েছিলেন। অচল হয়ে পড়েছিল পঞ্চায়েত। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল উন্নয়ন। অগত্যা ‘উন্নয়নের স্বার্থে’ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা হাতে-হাত মিলিয়ে তৈরি করেন ‘সর্বদলীয় গ্রামোন্নয়ন কমিটি’। সেই কমিটির তত্ত্বাবধানেই ‘সচল’ হয়েছে পঞ্চায়েত। শুরু হয়েছে উন্নয়ন। বিডিও পিনাকী সেনগুপ্ত জানিয়েছেন, গত জানুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ পর্যম্ত ওই কমিটির মাধ্যমে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে ১৯ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। আরও বহু টাকা খরচের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
বরাবর সিপিএমের ‘শক্ত ঘাঁটি’ বলে পরিচিত এই এলাকায় ২০০৮-এর নির্বাচনেও পঞ্চায়েত দখল করেছিল সিপিএম। ১০টি আসনের মধ্যে ৮টি পায় সিপিএম। ২টি কংগ্রেস। পঞ্চায়েতের কাজ নিয়ে সিপিএম-কংগ্রেসের চাপান-উতোরে পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছিল। কংগ্রেস ও তৃণমূলের তরফে সিপিএমের প্রধান ও উপপ্রধানের বিরুদ্ধে আমতা-২ ব্লকের বিডিও-র কাছে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বিডিও দু’জনের বিরুদ্ধে থানায় এফআইআর করেন। এর পরেই ফেরার হয়ে যান প্রধান ও উপপ্রধান। সমস্যা শুরু হয় পঞ্চায়েতের কাজ চালানো নিয়ে।
সেই অবস্থায় ব্লক প্রশাসন সিপিএমেরই এক গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য বাসুদেব দলুইকে প্রধান মনোনীত করে। তাতেও সমস্যা মেটেনি। কারণ পঞ্চায়েতে সিপিএমের বেশিরভাগ সদস্যই আসতেন না। উন্নয়ন নিয়ে কোনও আলোচনাও হত না। ফলে গ্রামোন্নয়নের কাজে বরাদ্দ টাকা খরচ করতে পারছিলেন না প্রধান। এই পরিস্থিতিতে গত অক্টোবরে বন্যায় ত্রাণসামগ্রী বিলি নিয়ে সমস্যায় পড়ে প্রশাসন। সেই সমস্যা মেটাতেই ব্লক প্রশাসনের তরফে পরীক্ষামূলক ভাবে সর্বদলীয় কমিটি গড়ে ত্রাণ বিলি করা হয়। কমিটির কাজের ‘সাফল্য’ দেখে রাজনৈতিক দলগুলি একমত হয় গ্রামোন্নয়নের সব কাজই ওই কমিটির মাধ্যমে করা হোক। তার পরেই সিপিএম, কংগ্রেস এবং তৃণমূল থেকে চার জন করে মোট ১২ জন সদস্য নিয়ে তৈরি হয় ‘সর্বদলীয় গ্রামোন্নয়ন কমিটি’। যদিও পঞ্চায়েতে তৃণমূলের কোনও সদস্য ছিলেন না। কিন্তু কংগ্রেস নেতা অশোক গায়েন বলেন, “উন্নয়নের গুরুত্ব উপলব্ধি করে প্রতিটি দল থেকেই প্রতিনিধি নেওয়া হয়।”
জানুয়ারি মাসে কমিটি গঠনের পর থেকে ১০০ দিনের প্রকল্পে কোন কোন এলাকায় কাজ হবে, সে বিষয়ে এবং অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজ নিয়ে ইতিমধ্যেই কমিটির একাধিক বৈঠক হয়েছে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক যাবতীয় উন্নয়নের কাজ হচ্ছে বলেই ব্লক প্রশাসন সূত্রের খবর। যেমন ৫৪ লক্ষ টাকা ব্যয়ে তৈরি হচ্ছে মোরাম রাস্তা। ছ’কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তাটি তৈরি হলে রূপনারায়ণ ও মুণ্ডেশ্বরী নদী দিয়ে ঘেরা ভাটোরার মানুষ সহজে শহরে যাতায়াত করতে পারবেন। গোলাবাড়ি এলাকার মন্টু আড়ি, সুদর্শন আড়িদের কথায়, “মাসচারেক আগে পর্যন্ত উন্নয়নের কোনও কাজই দেখা যায়নি। কমিটির নেতৃত্বে রূপনারায়ণের বাঁধে গোলাবাড়ি এলাকায় হানা মেরামত হয়েছে। আমরা বন্যার হাত থেকে বাঁচলাম। এখন আবার রাস্তার কাজও চলছে। রাজনৈতিক দলাদলির বাইরে গিয়ে এ ভাবেই উন্নয়নের কাজ হোক।” কমিটির পক্ষে কংগ্রেসের অশোক গায়েন, সিপিএমের মোজায়েদ আলি, তৃণমূলের শরাফত আলি মল্লিকেরা বলেন, “সব স্তরের মানুষের উৎসাহ পেয়েছি। প্রধান এবং গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে আইন মেনেই আমরা কাজ করছি।”
উন্নয়নের স্বার্থে ভাটোরায় সিপিএমের সঙ্গে ‘হাত মেলানোয়’ শরাফত আলি মল্লিক-সহ স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের তাঁরা শাস্তি দেবেন নাকি? হাওড়া জেলা তৃণমূল সভাপতি ও রাজ্যের কৃষি বিপণনমন্ত্রী অরূপ রায় বলেন, “তা কেন হবে? আমি নিজেও সিপিএমের সঙ্গে সম্পর্ক না-রাখার কথা কর্মিসভায় বলেছি। তবে ভাটোরার বিষয়টি আলাদা। গ্রামোন্নয়নই সেখানে গুরুত্ব পেয়েছে। ব্যক্তিস্বার্থে নয়, উন্নয়নের স্বার্থেই দলের স্থানীয় নেতৃত্ব সিপিএম-সহ অন্য দলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রশ্নই নেই!”
মুকুল-জ্যোতিপ্রিয় শুনছেন?



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.