|
|
|
|
প্রবন্ধ... |
পাঠক্রম নিয়ে অকারণ কচকচি বন্ধ হোক |
কথা শুরু হোক পড়ানোর পদ্ধতি নিয়ে। খুঁটিয়ে দেখা চাই, কেমন করে বাড়ানো যায়
শিক্ষকদের ভাল
পড়ানোর তাগিদ। কী কী করলে স্কুলে বসেই লিখতে-পড়তে, অঙ্ক কষতে শেখে আমাদের ছেলেমেয়েরা।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং স্বাতী ভট্টাচার্য |
ক্লাস সেভেনে পড়াশোনা ছেড়েছে বাবাই দাস। মুকুন্দপুর বাজারে বাবার দোকানে বসে চানাচুর-বিস্কুট বিক্রি করছিল। চানাচুর প্যাকেট কত করে, প্রশ্ন করতেই একটা তুলে পিছনের ঝাপসা বেগুনি কালির ছাপা লেখা পড়ে বলে দিল, ‘আড়াইশো ৩০ টাকা।’ এক কিলোগ্রাম কত হল তা হলে? ‘কেন, ১২০ টাকা?’ তখন পাশে একজন ২৮ টাকার জিনিস কিনে ৫০ টাকার নোট দিলেন, বাবাই ফেরত দিল ১৬ টাকা। ‘গত বারের ছ’টাকা বাকি ছিল না?’
রবি পড়ুয়ার বয়স ১৩, রিকসা চালায় পূর্বালোক কালীবাড়ি থেকে সিংহবাড়ি বাস স্টপ। পড়া ছেড়েছিস কবে? ‘অনেক দিন, সে-ই ক্লাস ফাইভ।’ ভাড়া আট টাকা, সকালটা স্ট্যান্ডে দাঁড়ালে সওয়ারি হয় গোটা বারো, নিজেদের রিকসা বলে ৯৬ টাকাই ঘরে নিয়ে যেতে পারে, প্যাডেলে চাপ দিতে দিতে বলে দিল রবি।
স্কুলের বাইরে এই ছেলেরা কী সুন্দর মুখে-মুখে অঙ্ক কষে। স্কুলে থাকলে আরও কত শিখত, তাই না?
না, শিখত না, সেই সম্ভাবনাই বেশি। ভারতে যে ছেলেরা যায় স্কুলে, তাদের দশ জনে চারজন চতুর্থ শ্রেণি পেরিয়েও সরল বিয়োগ কষতে পারে না, মাতৃভাষায় লেখা সরল বাক্য পড়তে পারে না। এমনকী অষ্টম শ্রেণি পাশ করে গিয়েও অন্তত ১৫ শতাংশ ছেলেমেয়ে এগুলো পারে না। পরপর কয়েক বছর একটি সর্বভারতীয় সমীক্ষা থেকে (ASER) এই ছবিটা বেরিয়ে আসছে।
আরও দেখা যাচ্ছে, ছেলেমেয়েরা যত উঁচু ক্লাসে উঠতে থাকে, তত তাদের শেখার সম্ভাবনা কমতে থাকে। দ্বিতীয় শ্রেণির উপযোগী লিখতে-কষতে না-পেরেই যত ছেলেমেয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে উঠেছিল, তাদের চারজনে মাত্র একজন তৃতীয় শ্রেণিতে সেই ক্ষমতা তৈরি করতে পারছে। শিশুটি যখন রয়েছে চতুর্থ শ্রেণিতে, তখনও হয়তো তার আশা আছে, কেউ খেয়াল করবে সে লিখতে-পড়তে পারছে না, তাকে শিখিয়ে দেবে। কিন্তু আবারও পিছিয়ে-পড়া ছাত্রদের চার জনে মাত্র একজন বিয়োগ কষতে, পড়তে-লিখতে শিখছে চতুর্থ শ্রেণিতে। শেষ অবধি দেখা যাচ্ছে, তিন জনে একজন শিশু প্রাথমিকে প্রায় পাঁচ হাজার ঘন্টা স্কুলে বসে থেকেও পড়তে-লিখতে, অঙ্ক কষতে শিখছে না। |
|
মজার পাঠ। যা পড়তে ভাল লাগে শিশুদের, তা-ই হোক পাঠ্য। ছবি: অনির্বাণ সেন |
লজ্জায়, বিরক্তিতে যারা স্কুল ছেড়ে দিচ্ছে, তাদের অনেকেই কিন্তু কাজ করতে গিয়ে হিসেব করছে দিব্যি, কাজ-চালানোর মতো পড়তে-লিখতেও পারে। যার কথাবার্তায় জড়তা নেই, মুখে-মুখে অঙ্ক করায় ভয় নেই, পাঁচজনের সঙ্গে মিশে নিজের কাজ হাসিল করার মতো জটিল কাজও যে করতে পারে, তার খাতায় বছর বছর কেন পড়ত লাল কালির দাগ? ওই খোকা-খুকুরা ফেল করছে, নাকি ফেল করছে শিক্ষা দফতরের বুড়ো খোকারা?
শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে তাকালে বোঝা যায়, ‘কী পড়ানো হবে,’ সেই প্রশ্নটা আলোচনার জমির প্রায় সবটা দখল করে বসে রয়েছে। এ রাজ্যে নতুন সরকার এসেই প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পাঠক্রমে কী কী পড়ানো হবে তাই নিয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করেছিল। তার নানা প্রস্তাবের মধ্যে কতগুলো সরকার গ্রহণ করেছে, কতগুলো করেনি, কমিটি থেকে কাদের বাদ দেওয়া হয়েছে, কারা ঢুকেছে তা নিয়ে মিডিয়াতে বিস্তর জলঘোলা হয়েছে। কিন্তু যেটা শিক্ষার একেবারে গোড়ার কথা--ছেলেমেয়েরা স্কুলে গিয়েও কেন বই পড়তে-অঙ্ক কষতে শিখছে না, সে প্রশ্নটা প্রায় না-ছোঁয়া রয়ে যাচ্ছে। দেখেশুনে শেয়ালকে সূপ খাওয়াতে বকের নেমন্তন্ন করার গল্প মনে পড়ে যায়। কুঁজোর ভিতরের বস্তুটি অতিশয় পুষ্টিকর হতে পারে, কিন্তু পাত্রটি এমনই যে শেয়াল বেচারিকে পাত্রের গা চেটে খিদে-পেটে ফিরতে হয়। আমাদের ছেলেমেয়েরাও তেমনি পাঁচ-আট-দশ বছর স্কুলে বসেও অঙ্ক-বাংলা-ইংরেজির নাগাল না পেয়ে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে।
এ বার ‘কী পড়ানো উচিত’ তা নিয়ে অকারণ কচকচি বন্ধ করে ‘কী করে পড়ানো উচিত’ সেই প্রশ্নে আসতে হবে। অক্ষর চিনে শব্দ, শব্দ জুড়ে বাক্য পড়তে শেখাটাই যদি প্রথম দরকার হয়, তা হলে কোন বই পড়ে শিশু তা শিখছে, সেটা অত কিছু জরুরি নয়। যদি ‘হাঁদা-ভোদা’ কমিকস পড়তে শিশুরা ভালবাসে, তা হলে তা থেকেই শিক্ষক প্রশ্ন করবেন না কেন? সব শিশুকে একই পাঠ্যবই থেকে পড়তে শিখতে হবে, এটাও জুলুম ছাড়া কিছু নয়। যা ভাল লাগবে, তা-ই পড়বে। ‘সহজ পাঠ’ যে সফল, তার কারণ রবীন্দ্রনাথের অসামান্য শব্দচয়ন শিশুদের কান, মন টেনে আনে অক্ষরগুলোর দিকে। তবু আজকের শিশুর কাছে যদি ‘বড় বৌ মেজ বৌ মিলে, ঘুঁটে দেয় ঘরের পাঁচিলে’ তেমন ইন্টারেস্টিং ছবি তৈরি না করে, তা হলে তাকে অন্য বই পড়াতে হবে। বাঁকুড়ায় যা পড়ানো হবে, জলপাইগুড়িতে তা পড়ানো না-ও হতে পারে। ‘কী পড়ল’ সেই ছুৎমার্গে না গিয়ে, কতটা শিখল, সেটাই দেখার দরকার শিক্ষা দফতরের। পড়তে যদি সে শেখে, পড়ার আগ্রহ যদি তার জন্মায়, তবে আখেরে সে পড়বে এবং জানবে অনেক বেশি। স্কুলের গোড়াতেই তার মগজে বিগ ব্যাং থেকে শ্রেণি সংগ্রাম পর্যন্ত সব গুঁজে দেওয়া অর্থহীন। অন্তত প্রাথমিকের ক্ষেত্রে শিক্ষা দফতর কেবল দক্ষতার ন্যূনতম মাপকাঠি স্থির করে দিলেই যথেষ্ট-- দ্বিতীয় শ্রেণিতে একটি ছাত্রকে কী কী পারতে হবে, তৃতীয় বা চতুর্থতে আরও কী কী তার করতে পারা দরকার। কোন কোন বই পড়ে, কতগুলো অনুশীলনী কষে সে ওই সব দক্ষতা আয়ত্ত করবে, সেটা শিক্ষক বুঝবেন। ‘কী কী জানল’ সেটা শিক্ষার মাপকাঠি নয়, ‘কী কী পারে,’ সেটাই মাপকাঠি।
কী পারছে, তা বুঝতে পরীক্ষা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু সেই পরীক্ষার দরকার শিক্ষাপদ্ধতির মূল্যায়ন করতে। ছাত্ররা কে কত পেল, সে তালিকা প্রকাশেরই দরকার নেই। দরকার শ্রেণির সাফল্য-ব্যর্থতার মোট ছবিটা তুলে ধরা। দ্বিতীয় শ্রেণির ৭০ শতাংশ ছেলেমেয়ে যদি ৬৪ থেকে ৩১ বিয়োগ করতে ভুল করে, কিংবা ৬০ শতাংশ ‘কাল ছিল ডাল খালি’ ছড়াটা গড়গড় করে পড়তে না পারে, তা হলে বাপ-মায়ের ‘চেতনার অভাব’ কিংবা শিশুর বেয়াড়াপনার উপর দায় চাপানো চলবে না আর। স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ক্লাসের পড়ানোয় গলদ আছে।
কেন পড়াশোনা হচ্ছে না, সেটা শিক্ষক ক্লাসে আসছেন না বলে, না কি ক্লাস ঘর নেই বলে, সে খবর শিক্ষা দফতরের রাখা চাই। ‘স্কুল ইনস্পেক্টর’ স্কুলগুলিতে গিয়ে নিয়মিত পরিদর্শন করার যে রীতি আগে প্রচলিত ছিল (যার জন্য স্কুলগুলোকে কত সাজগোজ করে তৈরি থাকতে হত তার বিবরণ বহু গল্পে পাওয়া যায়) এখন তা প্রায় উঠে গিয়েছে। অথচ নিয়মিত স্কুল পরিদর্শনের কোনও বিকল্প নেই। কী পড়া হবে, তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে, কেমন পড়ানো হচ্ছে তার খোঁজ রাখা শিক্ষা দফতরের কাছে অনেক জরুরি কাজ।
অন্য কাজটি হল, শেখার তাগিদ, শেখানোর তাগিদ কী করে বাড়ে, তার উপায় খোঁজা। সত্তর-আশির দশকে মনে করা হয়েছিল, যত বেশি স্কুল খোলা হবে, যত শিক্ষক রাখা হবে, যত বেশি শিশুদের আনা যাবে স্কুলে, তত প্রসার হবে শিক্ষার। গত দুই দশকে দক্ষিণ এশিয়া এবং আফ্রিকায় প্রচুর স্কুল খোলা হয়েছে, বহু দরিদ্র দেশে প্রায় ৯০ শতাংশ ছোট ছেলেমেয়ে স্কুলে যাচ্ছে। অথচ নানা সমীক্ষায় ধরা পড়ছে যে, ছেলেমেয়েরা শিখছে সামান্যই। কেবল স্কুল খুলে রাখলেই শিশুরা যথেষ্ট লেখাপড়া শিখবে না, সেটা এত দিনে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
তাই নানা দেশে-প্রদেশে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে, কী ভাবে শেখালে কাজ হয়। শিক্ষক-অভিভাবক-ছাত্রদের কী ধরনের পুরস্কার দিলে (বা শাস্তি দিলে) তারা পড়ায় আগ্রহী হবে। কীসে বিনিয়োগ করলে লাভ হবে বেশি-- স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ, নাকি পার্শ্বশিক্ষক নিয়োগ, নাকি শিক্ষকদের বাড়তি অনুদান? ছেলেমেয়েরা কত সামান্য শিখছে সে বিষয়ে বাবা-মাকে জানালে কি তাঁরা স্কুলের উপর চাপ তৈরি করেন? নাকি ভাল নম্বর-পাওয়া ছাত্রদের স্কলারশিপ দিলে বাবা-মা বেশি যত্ন নেবেন সন্তানের পড়াশোনায়? এ সব প্রশ্নের নানা উত্তর পাওয়া যাচ্ছে। ভাল পড়াশোনা শেখার সূত্র যদি বার করতে হয়, তবে হাতে-কলমে এমন সব কাজের থেকেই তা বেরোবে। রবীন্দ্রনাথ, মার্ক্স, বিবেকানন্দ কী বলে গিয়েছেন সেই ‘শিক্ষার আদর্শ’ থেকে নয়, কেরল মডেল বা ব্রিটিশ মডেল থেকে নয়, ‘আমরা তো এমন করেই শিখেছি’ গোছের আলগা বিশ্বাস থেকে নয়। কীসে কাজ হয়, তার সাক্ষ্য-প্রমাণ খুঁটিয়ে দেখে নীতি তৈরি করতে হবে।
সে কাজ হচ্ছেও। আফ্রিকার কিনিয়াতে দেখা গিয়েছে, অসুস্থতা শিশুদের স্কুল কামাই করার একটি বড় কারণ। বছরে দু-বার কৃমির ওষুধ খাওয়ালে স্কুল-কামাই কমে অন্তত ২৫ শতাংশ। এই তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্বের নানা দেশে স্কুলছাত্রদের কৃমির ওষুধ দেওয়ার কাজ চলছে, ভারতে প্রকল্প চলছে অন্ধ্র প্রদেশ এবং বিহারে। ছাত্রদের ফল অনুসারে শিক্ষকদের উৎসাহ ভাতা দেওয়ার পরীক্ষা হয়েছে অন্ধ্র প্রদেশে, তাতেও সুনির্দিষ্ট ফল পাওয়া গিয়েছে (বক্স দেখুন)।
নীতি যদি ক্লাসঘরের বাস্তব সমস্যাগুলোর দিকে না তাকায়, তা হলে শিক্ষা দফতরের কর্তাদের সদিচ্ছা জমে পাথর হবে কেবল। তাতে চাপা পড়বে বাবাই, রবির মতো শিশুদের লেখাপড়া শিখে গাড়িঘোড়া চড়ার স্বপ্ন।
|
কেমন করে নম্বর বাড়ে: অন্ধ্রপ্রদেশের একটি পরীক্ষা |
ছাত্রদের ফল ভাল হলে যদি শিক্ষকদের বাড়তি টাকা মেলে, তা হলে কি ছাত্ররা আরও ভাল শেখে? তা বুঝতে পাঁচ বছর ধরে অন্ধ্রপ্রদেশের তিনশোটি গ্রামীণ প্রাথমিক স্কুলে (প্রথম- পঞ্চম শ্রেণি) চলে একটি পরীক্ষা। নিয়ম হয়, ছাত্রদের গড় নম্বর এক শতাংশ বিন্দু বাড়লে শিক্ষকরা পাবেন ‘বোনাস’ ৫০০ টাকা। একশোটি স্কুলে দেওয়া হয় ‘গ্রুপ বোনাস’-- স্কুলের গড় নম্বর বাড়লে সব শিক্ষক সমান বোনাস পাবেন। অন্য একশোটি স্কুলে দেওয়া হয় ‘ব্যক্তিগত বোনাস’-- যে ছাত্রদের একজন শিক্ষক পড়াচ্ছেন, তাদের গড় নম্বর বাড়লে সেই শিক্ষক বোনাস পাবেন। শেষ একশোটি স্কুলে (‘কন্ট্রোল গ্রুপ’) কোনও বোনাস দেওয়া হয়নি।
• ব্যক্তিগত উৎসাহ ভাতা কাজ দিয়েছে সবচেয়ে ভাল। পাঁচ বছর পরে এই সব স্কুলের ছাত্ররা অন্য ছাত্রদের চেয়ে অঙ্ক এবং ভাষায় বেশি নম্বর পেয়েছে।
• ‘গ্রুপ বোনাস’ স্কুলের ছাত্ররা প্রথম বছর উন্নতি করলেও, পাঁচ বছর পর ‘কন্ট্রোল গ্রুপ’-এর ছাত্রদের মতোই নম্বর পেয়েছে।
• ব্যক্তিগত বোনাস কেবল অঙ্ক আর ভাষার নম্বরের জন্য দেওয়া হলেও, ওই স্কুলগুলোতে ছাত্রদের বিজ্ঞান এবং সমাজ বিজ্ঞানের নম্বরেও উন্নতি হয়েছে।
এই পরীক্ষার সিদ্ধান্ত, ছাত্রদের ফল অনুসারে শিক্ষকদের বেতনের কিছু অংশ দিলে, স্কুলে ছাত্রদের আরও ভাল শেখার সম্ভাবনা বেশি। দুর্বল ছাত্ররাও বেশি শিখছে এই ব্যবস্থায়।
|
|
আবদুল লতিফ জামিল পভার্টি অ্যাকশন ল্যাব-এর তরফে এই পরীক্ষাটি করেন কার্তিক মুরলীধরন। |
|
|
|
|
|