আসছে পুরভোট। ফিরছে রাজনীতির লড়াই। কিন্তু কেমন আছে দুর্গাপুর?
ওয়ার্ডে ঘুরে-ঘুরে খোঁজ নিচ্ছে আনন্দবাজার। আজ ওয়ার্ড ৫ ও ৬। |
দিন যায়।
কাউন্সিলর বলেন, ‘কাজ হচ্ছে।’ কিন্তু সে কাজ চোখে দেখা যায় না।
দুর্গাপুর পুরসভার ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডকে ‘যমজ’ বললে অত্যুক্তি হয় না। দেখতেই শুধু এক নয়, সমস্যাও ছত্রে ছত্রে এক। কিছুটা ডিএসপি টাউনশিপ আর তার লাগোয়া কম-বেশি সব জায়গায় বস্তি।
ডিএসপি টাউনশিপের মোটামুটি কেন্দ্রস্থলে ৫ নম্বর ওয়ার্ড। চন্ডীদাস, কাশীরাম, ডেভিড হেয়ার, সি-জোন ওল্ড এবং সি-জোন নিউ। এ ছাড়া কিছু সংলগ্ন বস্তি নিয়ে ওয়ার্ডের এলাকা। ডিএসপি এলাকায় পুরসভার কাজের সুযোগ তেমন নেই। বস্তি এলাকার ‘উন্নয়ন’ নিয়ে তরজা চলছে শাসক ও বিরোধী পক্ষের মধ্যে। ওয়ার্ডের মহিলা তৃণমূল সভাপতি রুমা ভট্টাচার্যের অভিযোগ, “সরকারি সুযোগ-সুবিধা কি আছে তা জানেনই না বস্তির বাসিন্দারা। কাউন্সিলরের টিকি দেখা যায় না।” কংগ্রেসের ১ ব্লক সভাপতি আশিস দে-র দাবি, গত কয়েক বছরে উন্নয়ন প্রায় হয়ইনি। ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁরা স্মারকলিপি দেওয়ার পরে নিকাশির কিছু কাজ হয়েছে। কিন্তু তা দায়সারা। তবে সিপিএম কাউন্সিলর লিলিবিতি মুর্মুর দাবি, “বস্তির উন্নয়ন হয়েছে ধারাবাহিক ভাবে।”
বস্তির বাসিন্দারা কিন্তু বহুবিধ সমস্যার কথা জানিয়েছেন। কাশীরাম বস্তিতে ইট পাতা রাস্তা হয়েছে বছর ১২ আগে। ইট বসে গিয়ে রাস্তায় চলাচল করা কষ্টদায়ক। বেশ কিছু বাড়িতে শৌচাগার গড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জলের ব্যবস্থা নেই। নিজেরাই মাটি খুঁড়ে বিপজ্জনক ভাবে কুয়ো বানিয়ে নিয়েছেন বস্তির বাসিন্দারা। |
|
|
বাঁ দিকে, ৫ নম্বর ওয়ার্ডে আঁস্তাকুড় ওপচানো আবর্জনা।
ডান দিকে, ৬ নম্বরে জঞ্জালে ভরা পুকুর। --বিকাশ মশান। |
|
উঁচু দেওয়াল না থাকায় যে কোনও সময় বাচ্চারা তলিয়ে যেতে পারে। সম্প্রতি রাস্তার ধারে অবশ্য কমিউনিটি শৌচাগার বানিয়ে দিয়েছে পুরসভা। সেখানে পাকা কুয়ো হয়েছে। কিন্তু গরম পড়তেই কুয়োর জলতল নামতে শুরু করেছে। বস্তির দুই প্রান্তে দুটি ট্যাপের ব্যবস্থা রয়েছে। সকাল-বিকাল দু’বেলা জল আসে। সেই জল সংগ্রহের জন্য ভোর থেকে বালতি, প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে লাইন পড়ে।
অন্য সমস্যাও আছে। টালির চালের ভগ্নপ্রায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে অন্নপূর্ণা বাউরি জানান, তাঁর পরিবারে তিন সদস্য। এক জনেরও রেশন কার্ড নেই। বুধন বাউরি বলন, “দেড় দশক আগে বাড়ি ভেঙে রেশন কার্ড নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আর নতুন কার্ড হয়নি।” বাসুদেব বাউরির অভিযোগ, বাড়ি ভেঙে পড়ার পরে সাহায্যের জন্য পুরসভায় আবেদন জানিয়ে একটি ত্রিপলও জোটেনি। সাত বছর আগে স্বামী মারা গিয়েছে ৭০ বছরের বোগলা বাউরির। তিনি বিধবা ভাতা পান না। প্রবীণ বাসিন্দা কেষ্ট সিংহ অভিযোগ করেন, ৫০ বছর ধরে বসবাস করছেন এই বস্তিতে। নতুন যাঁরা এসেছে তাঁদের অনেকের বিপিএল তালিকায় নাম উঠেছে। অথচ তাঁর পরিবারের নাম ওঠেনি। কাউন্সিলর অবশ্য জানিয়েছেন, বস্তিবাসীর উন্নয়নের জন্য তিনি সাধ্য মতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
চওড়া পিচ রাস্তা মহিস্কাপুর রোডের ধারে পুকুর পাড়ে ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মহিস্কাপুর বস্তি। শ’দুয়েক বাসিন্দার বাস। শহরের সিংহভাগ বস্তিতে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে গিয়েছে, ব্যতিক্রম তাঁরা। ইটের রাস্তা হয়েছিল এক দশকেরও বেশি আগে। তা বেহাল হয়ে যাওয়ার পরে সম্প্রতি পুকুর পাড় ধরে মোরাম বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। কুয়ো মজে গিয়েছে। বস্তির দুই মাথায় দু’টি ট্যাপ। জলের জন্য লম্বা লাইন পড়ে। কমিউনিটি শৌচাগার আছে। কিন্তু তা মজে গিয়েছে। নারী-পুরুষ বয়স নির্বিশেষে স্নান করেন সামনের পুকুরে। প্রাতকৃত্য সারতে যান ফাঁকা মাঠে। বিধবা অন্ন খাঁ অন্যের বাড়িতে রান্না করে সামান্য রোজগার করেন। ছেলে অন্যত্র আলাদা থাকেন। অন্নদেবী বললেন, “বিধবা ভাতা পেলে ভাল হতো।” ৮০ বছরের পারুল মাঝি উঠতে-হাঁটতে পারেন না। পাশেই থাকেন মেয়ে রিতা থান্ডার। তিনি দু’বেলা খেতে দেন। পারুলদেবীকে বিধবা ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা কেউ করে দেয়নি। পেশায় রাজমিস্ত্রি গোঁসাই মাঝির খেদ, “যাদের না পেলেও চলে তারা পেয়েছে। অথচ যাদের খুব দরকার তারা পাচ্ছে না।” মহিস্কাপুর ছাড়াও তিলক রোড, মার্কনি, জেএন সেনগুপ্ত, বিদ্যাসাগর, শরৎচন্দ্র রোড এবং কৃত্তিবাস, বঙ্কিম, আর্যভট্টের কিছু অংশ নিয়ে ৬ নম্বর ওয়ার্ড। বস্তি রয়েছে প্রায় সর্বত্রই। তৃণমূলের ওয়ার্ড সভাপতি শুভাশিস চৌধুরীর টিপ্পনী, “বস্তির বাসিন্দারাই জানেন কতটা উন্নয়ন হয়েছে!” এই ওয়ার্ডটিও কংগ্রেসের ১ ব্লক সংগঠনের অন্তর্গত। ব্লক সভাপতি আশিসবাবু বলেন, “বিদ্যাসাগর রোড বস্তির পরিস্থিতিও মহিস্কাপুরের মতোই। বস্তুত ওয়ার্ডের সব বস্তিতেই পরিস্থিতি কম-বেশি এক।” বিরোধীদের অভিযোগ নিয়ে অবশ্য চিন্তিত নন কাউন্সিলর সুপ্রিয়া গুপ্ত। তিনি জানান, বস্তি এলাকায় নতুন ১৫টি কমিউনিটি শৌচাগার গড়া হয়েছে। ১৩টির সংস্কার হয়েছে। ৬টি নতুন কুয়ো খোঁড়া হয়েছে। তাঁর দাবি, ওয়ার্ডের সমগ্র বস্তি এলাকায় কংক্রিটের রাস্তা তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। তাঁর আশ্বাস, “দিন কয়েকের মধ্যেই কাজ শুরু হয়ে যাবে।” |
নজরে নগর |
• বস্তিতে অনেক বাসিন্দাই আছেন যাঁদের কোনও ভোটার পরিচয়পত্র নেই
•
পানীয় জল অপ্রতুল
•
শৌচাগারের অভাব
• বস্তির বেশ কিছু অংশ বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি
• পানীয় জলের ট্যাপ দরকার
• বিধবা ভাতা, বার্ধক্য ভাতা মিলছে না।
•
বিপিএলে সব দুঃস্থের ঠাঁই হয়নি। |
বস্তি এলাকায় ১৫টি
কমিউনিটি
শৌচাগার,
৬টি নতুন কুয়ো হয়েছে।
সুপ্রিয়া গুপ্ত
সিপিএম কাউন্সিলর |
|
|
ধারাবাহিক ভাবে
বস্তিতে উন্নয়নমূলক
বিভিন্ন কাজ হয়েছে।
লিলিবিতি মুর্মু
সিপিএম কাউন্সিলর |
|
কাউন্সিলরের তো
টিকিই দেখা যায় না।
রুমা ভট্টাচার্য
মহিলা তৃণমূল
ওয়ার্ড সভাপতি |
উন্নয়ন যে আদৌ
হয়নি,
জানেন বস্তির
বাসিন্দারাই।
শুভাশিস চৌধুরী
ওয়ার্ড তৃণমূল সভাপতি |
|
|