এক পরিবারের চার জনের ক্ষতবিক্ষত দেহ উদ্ধার
রিজেন্ট পার্কের পরে এ বার নদিয়ার হরিণঘাটা। স্থানীয় নগরউখড়া বাজারে পাত্র পরিবারে চার জনকে নৃশংস ভাবে খুনের ঘটনার তদন্তে নেমে দিনভর খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজার মতো অন্ধকারে হাতড়াল পুলিশ। দফায় দফায় আত্মীয়-পরিজন, প্রতিবেশীদের জেরা করেও রাত পর্যন্ত কোনও সূত্র মিলল না। নিয়ে আসা হয়েছিল পুলিশ কুকুর। ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরাও গিয়েছিলেন ঘটনাস্থলে।
ওই বাজারে রবীন্দ্রনাথ পাত্রের (৩৫) দোতলা বাড়ি। নীচের তলায় দু’টি দোকান। একটি ওষুধের, একটি চায়ের। দোতলার দু’টি ঘরে থাকতেন রবীন্দ্রনাথবাবু, তাঁর স্ত্রী সুমিতাদেবী ওরফে মাম্পি (২৫) ও মেয়ে রিনি (৬)। পাশের ঘরে থাকতেন রবীন্দ্রনাথবাবুর মা রিনাদেবী (৫৫)। রিনাদেবীই বাড়ির নীচের চায়ের দোকানটি চালাতেন। মঙ্গলবার সকালে ওই বন্ধ চায়ের দোকানের মেঝে থেকে উদ্ধার হয় রবীন্দ্রনাথবাবুর ক্ষত-বিক্ষত দেহ। বাড়ির পাশেই একটি মিষ্টির দোকানে কাজ করতেন রবীন্দ্রনাথবাবু।
কান্নায় ভেঙে পড়েছেন নিহত রবীন্দ্রনাথ পাত্রের বোন (মধ্যে)। নিজস্ব চিত্র
মা-ছেলের সামান্য আয়ে তাঁদের সংসার চলত। তাঁর বোন সোমা দেবনাথই প্রথম তাঁর দাদা ও পরিবারের অন্যদের দেহ দেখতে পান। পাশের গ্রাম মহাদেবপুরে তাঁর শ্বশুরবাড়ি। সোমাদেবী জানান, তিনি নিয়মিত দাদা ও মা’য়ের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। এই দিনও সকাল সাড়ে ছ’টা নাগাদও গিয়েছিলেন। তখনই মা’র চায়ের দোকান বন্ধ দেখে তাঁর সন্দেহ হয়। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, রবীন্দ্রনাথবাবুও তখনও ওই মিষ্টির দোকানে যাননি। সোমাদেবী বলেন, “এরপরে চায়ের দোকানের ঝাঁপ তুলতেই দেখি মেঝেতে একটা কাঁথা চাপা দেওয়া দেহ। কাঁথা সরিয়েও প্রথমে দাদার দেহ চিনতে পারিনি, এতটাই ক্ষত-বিক্ষত ছিল। তারপরে ছুটে উপরে উঠতে গিয়ে দেখি সিঁড়িতে পড়ে রয়েছে মা’র রক্তাক্ত দেহ। দোতলায় দাদার ঘরে গিয়ে দেখি মেঝেতে অর্ধনগ্ন অবস্থায় বৌদির দেহ পড়ে রয়েছে। বিছানার উপরে ভাইঝির দেহ। দু’জনকেই কোপানো হয়েছে।”
দোকানের মেঝে, সিঁড়ি বা সুমিতাদেবীর ঘরেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রক্তের দাগ পাওয়া গিয়েছে। রিনাদেবীর ঘরের জিনিসপত্র লণ্ডভন্ড করা। খুনের সময় যে ধস্তাধস্তি হয়েছে, মৃতদের পোশাক ও বিছানার অবস্থায় সেই ছবি স্পষ্ট। কিন্তু কেন তাঁদের এই ভাবে খুন করা হল, পুলিশের কাছে তার কোনও পরিষ্কার সূত্র নেই। পুলিশের ধারণা, আততায়ীরা সংখ্যায় অনেকে ছিল। খুনের পাশাপাশি বাড়ির দলিলের মতো গুরুত্বপূর্ণ কোনও নথি হাতিয়ে নেওয়ার মতলব ছিল কি না, তা পুলিশ খতিয়ে দেখছে। এই ঘটনায় রবীন্দ্রনাথবাবুর ভাই যতীন্দ্রনাথ ও ভগ্নীপতি গৌরাঙ্গ দেবনাথকে বিকালে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়। নদিয়ার পুলিশ সুপার সব্যসাচীরমণ মিশ্র বলেন, “খুনের কারণ নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। তবে সম্পত্তি নিয়ে পারিবারিক বিবাদের জেরেই ওই পরিবারের চার জনকে খুন করা হয়েছে বলে প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দু’জনকে আটক করা হয়েছে।” পুলিশ জানিয়েছে, পেশাদার খুনিরা এই ঘটনায় জড়িত রয়েছে কি না, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তবে দুষ্কৃতীদের কোনও সন্ধান রাত পর্যন্ত মেলেনি।
স্থানীয় সূত্রে খবর, রবীন্দ্রনাথবাবুদের দু’টি বাড়ি। নগরউখড়ার শীতলাতলা এলাকায় তাঁদের পুরনো এক তলা বাড়িতে থাকেন যতীন্দ্রনাথ। নগরউখড়া বাজারের দোতলা বাড়ির নীচের তলার একটি ঘরও যতীন্দ্রনাথকে দিয়েছিলেন রিনাদেবী। সেই ঘরটিতে দোকানভাড়া দিয়েছিলেন যতীন্দ্রনাথবাবু। সেখানে ওষুধের দোকান রয়েছে। তবে দুই ভাই এবং তাঁদের বোনের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। বাজারের দোতলা বাড়িটি তাই বিক্রির কথাবার্তা উঠেছিল। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, সম্প্রতি বাড়িটি বিক্রি করার প্রস্তাব দেন যতীন্দ্রনাথ ও সোমাদেবীর স্বামী গৌরাঙ্গ দেবনাথ। দাম ওঠে পঁচিশ লক্ষ টাকা। কিন্তু বাড়ি বিক্রিতে সম্মতি ছিল না রবীন্দ্রনাথবাবু এবং রিনাদেবীর। আর তাই নিয়েই দুই ভাইয়ের মধ্যে বিবাদ বেধেছিল।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, দিন কয়েক আগে কয়েকজন দালালকে বাড়ি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন যতীন্দ্রনাথ। তখনও দাদা-ভাইয়ের মধ্যে বচসা হয়। যতীন্দ্রনাথবাবু অবশ্য এই ঘটনা অস্বীকার করে বলেন, “বাড়ি বিক্রির কথা উঠেছিল। তবে তা নিয়ে দাদা-মা’র সঙ্গে আমার কোনও বিরোধ ছিল না।” তাঁর কথায়, “আমি কলকাতায় একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করি। সামান্য আয়। কিন্তু কারা দাদাদের খুন করল কিছুই জানি না।” সোমাদেবী বলেন, “দাদা ও মা বাড়ি বিক্রি করতে রাজি ছিল না। আমি ও আমার স্বামীও চেয়েছিলাম, তাড়াহুড়ো না করতে। তবে আমাদের ছোট ভাই যতীন্দ্রনাথ চেয়েছিল বাড়ি বিক্রি করতে।” সেই সঙ্গেই তাঁর বক্তব্য, “বাড়ি বিক্রি নিয়ে খুনোখুনি হতে পারে বলে ভাবতে পারছি না।” গৌরাঙ্গবাবুও বলেন, “আমি চাই দোষীদের কড়া শাস্তি হোক।”
এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবিতে পুলিশের সামনে বিক্ষোভ দেখান স্থানীয় বাসিন্দারা। রবীন্দ্রনাথবাবুর জ্যাঠতুতো দাদা বাপি পাত্র খুনের কিনারার দাবিতে লিখিত অভিযোগ দায়ের করলেও নির্দিষ্ট ভাবে কাউকে অভিযুক্ত করেননি। বাসিন্দারা পুলিশ কুকুর আনার দাবিতে মৃতদেহ আটকে রেখে পুলিশকে ঘেরাও করেন। শেষ পর্যন্ত পুলিশ কুকুর এলেও বাড়ির মধ্যে বাইরে প্রায় একশো মিটার ঘুরপাক খেয়ে ফিরে যায়। ঘটনাস্থলে যান পুলিশের পদস্থ কর্তারা। দুপুরেই হাজির হন রাজ্যের খাদ্য ও প্রক্রিয়াকরণ মন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস ও স্থানীয় বিধায়কেরা। উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করে দেহগুলি ময়নাতদন্তে পাঠানো হয়।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.