|
|
|
|
সুবর্ণরেখা বাঁধ-প্রকল্প নিয়ে সংশয় বাড়ছেই |
বরুণ দে • মেদিনীপুর |
জমি অধিগ্রহণের ঝুঁকি নেবে না বলেই কি রাজ্যের নতুন সরকার সুবর্ণরেখা বাঁধ-প্রকল্প (ব্যারাজ) নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করছে না? এমন গুঞ্জন ক্রমেই বাড়ছে দুই মেদিনীপুরের বিভিন্ন মহলে। অথচ, এই প্রকল্প রূপায়িত হলে পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কমপক্ষে ১০টি ব্লকে কৃষির উন্নতি হত। বদলে যেত কেশিয়াড়ি, নয়াগ্রাম, দাঁতন, পটাশপুর, এগরা, ভগবানপুর-সহ বিস্তীর্ণ এলাকার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি। নতুন রাজ্য সরকার সুবর্ণরেখা নদীর উপর আলাদা করে সেতু তৈরির কথা ঘোষণা করায় সংশয় বেড়েছে। কেননা, বাঁধ-প্রকল্প রূপায়িত হলে সেতু এমনিই হত। কিন্তু আলাদা সেতুর সিদ্ধান্তে বাঁধ-প্রকল্পটির বিশ বাঁও জলে চলে যাওয়ার আশঙ্কাই বাড়ছে।
সুবর্ণরেখা বাঁধ-প্রকল্পের প্রাথমিক পরিকল্পনা তৈরি হয়েছিল ৩৪ বছর আগে, সেই ১৯৭৮ সালে। ওই বছর বিহার অধুনা ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সুবর্ণরেখা অববাহিকার জলসম্পদের আনুপাতিক বণ্টনের লক্ষ্যে সম্পাদিত একটি ত্রিপাক্ষিক চুক্তির প্রেক্ষিতে সুবর্ণরেখা বহুমুখী ব্যবস্থায় তিনটি বড় প্রকল্পের কথা ভাবা হয়। |
|
ভসরাঘাটে প্রস্তাবিত ব্যারাজের শিলা |
এই তিনটি প্রকল্প হল: তদানীন্তন বিহার অধুনা ঝাড়খণ্ডে সুবর্ণরেখা বহুমুখী প্রকল্প, এ রাজ্যে সুবর্ণরেখা বাঁধ-প্রকল্প ও ওড়িশায় সুবর্ণরেখা সেচ-প্রকল্প। ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশায় সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে। কিন্তু, এ রাজ্যে বাঁধ-প্রকল্পের কাজ সেই অর্থে শুরুই হয়নি! ফলে, জলসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারও সম্ভব হচ্ছে না। ওই ত্রিপাক্ষিক চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, সারা বছরে সুবর্ণরেখা অববাহিকার ৬.৯ লক্ষ একর ফিট জলসম্পদ ব্যবহার করতে পারত এই রাজ্য। কিন্তু সে সুযোগ হচ্ছে না।
প্রকল্প রূপায়িত করতে এই সময়ের মধ্যে বেশ কয়েক বার---কখনও রাজ্যস্তরে, কখনও বা জেলাস্তরে--বৈঠক অবশ্য হয়েছে। প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণের জন্য বিজ্ঞপ্তি জারির কথাও ভাবা হয়েছে। কিন্তু, কোনও ক্ষেত্রেই পরিকল্পনা মতো কাজ এগোয়নি বলে অভিযোগ। কেননা প্রকল্পের জন্য প্রায় ৩ হাজার ৭৭০ একর জমি প্রয়োজন। এর মধ্যে মূল ব্যারাজের জন্য ২৫৯ একর, ব্যারাজের বাম তীরের অ্যাফ্লাক্স ও গাইড বাঁধের জন্য ৫০০ একর, ব্যারাজের ডান তীরের অ্যাফ্লাক্স ট্যাগিং বাঁধের জন্য ১৯৩ একর, প্রধান খালের জন্য ৪৬০ একর, ২০.২০ কিলোমিটার প্রশাখা খালের জন্য ১৮৫ একর। প্রথম পর্যায়েই অন্তত ৯২৯.৯২ একর জমি অধিগ্রহণ প্রয়োজন। যার মধ্যে ২৫৯ একর প্রস্তাবিত ব্যারাজের জমি। কিন্তু ওই জমিই এখনও অধিগ্রহণ হয়নি। কয়েক বছর আগে প্রকল্প নিয়ে আলোচনা সামান্য গতি পেতেই প্রধানত পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াগ্রাম, কেশিয়াড়ি এলাকায় মূলত তৃণমূল ও কংগ্রেসের নেতৃত্বে জমি-রক্ষার আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছিল।
নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরের জমি আন্দোলনের পথে ক্ষমতায় আসা তৃণমূলের সরকার ভালই জানে, জমি নিয়ে কী পরিমাণ স্পর্শকাতরতা ইদানীং তৈরি হয়েছে এই বাংলায়। তাই জমি অধিগ্রহণ বা সামগ্রিক প্রকল্পটি নিয়েই নতুন সরকারের তেমন হেলদোল নেই বলে অভিযোগ।
সামান্য হলেও আগের আমলে কী ভাবে এগিয়েছিল প্রকল্পের কাজ? পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, ১৯৯২-’৯৩ আর্থিক বছরে রাজ্য সরকার প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ যেমন--পরিকাঠামো তৈরি, জমি জরিপ শুরুর সবুজ সংকেত দেয়। ’৯৪ সালে কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ দফতরের অনুমোদন এবং ’৯৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের যোজনা কমিশনের বিনিয়োগ ছাড়পত্র পায় প্রকল্পটি। সেই মতো ১৯৯৬ সালে ঘটা করে প্রকল্পের শিলান্যাসও হয়। ২০০১-’০২ সালে কেন্দ্রীয় সহায়তায় এআইবিপি-তে (অ্যাক্সিলারেটেড ইরিগেশন বেনিফিট প্রোগ্রাম) প্রকল্পটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু, তখন ব্যয়-ভার (২০ শতাংশ কেন্দ্র ও ৮০ শতাংশ রাজ্য) বহন করা সম্ভব নয় বুঝে রাজ্য সরকার পিছিয়ে আসে। পরে কেন্দ্রীয় সরকার এআইবিপি-র নির্দেশিকা পরিবর্তন করে ‘উপজাতি ও খরাপ্রবণ এলাকায় বৃহৎ সেচ প্রকল্পে’র জন্য ৯০ শতাংশ অনুদানের ব্যবস্থা চালু করে। |
|
কেশিয়াড়ির নেপোয় প্রকল্প-অফিস। |
যে দু’টি জেলায় প্রস্তাবিত সুবর্ণরেখা বাঁধ-প্রকল্পের সেচসেবিত এলাকা বিস্তৃত হওয়ার কথা, তার মধ্যে পশ্চিম মেদিনীপুরে উপজাতি জনসংখ্যার শতাংশ রাজ্যের উপজাতি জনসংখ্যার গড় শতাংশের থেকে দ্বিগুণেরও বেশি। ফলে, কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রকল্পে ৯০ শতাংশ অনুদান দেওয়ার কথা চিন্তাভাবনা করে। বাকি ১০ শতাংশ ব্যয় অবশ্য রাজ্যেরই বহন করার কথা।
সুবর্ণরেখা বাঁধ-প্রকল্প রূপায়িত হলে দুই মেদিনীপুরের নারায়ণগড়, দাঁতন ১ ও ২, মোহনপুর, এগরা ১, পটাশপুর ১ ও ২, কাঁথি ১, ভগবানপুর, কেশিয়াড়ি, নয়াগ্রাম এলাকার মানুষ উপকৃত হবেন। সব মিলিয়ে ১ লক্ষ ৩০ হাজার ১০ হেক্টর জমি সেচের সুবিধা পাবে। এর মধ্যে খারিফ-শস্য হয় ৯৯ হাজার ২৪৮ হেক্টর জমিতে। রবি-শস্য ৩০ হাজার ৭৬৬ হেক্টর জমিতে। ২০০৭-০৮ সালের মূল্যায়ন অনুযায়ী, সেচের ফলে ১ লক্ষ ৬৮ হাজার ৪০৮ মেট্রিক টন ফসল বাড়তি উৎপাদন হতে পারে। যার মূল্য ১০১.৮১ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের জন্য যে কাজ হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে মেদিনীপুরের খাসজঙ্গল ও কেশিয়াড়ির কাছে নেপো-য় প্রকল্পের অফিস তৈরি, ব্যারাজের জায়গা ভসরাঘাটে জমির উন্নয়ন, রাজ্য বন ও কৃষি দফতরের সহায়তায় ঝোড়বাঁধ তৈরির মাধ্যমে আংশিক ভূমিক্ষয় রোধ, বেলদা রেল স্টেশন থেকে নির্মাণ-সামগ্রী প্রকল্প এলাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য কুকাই থেকে হাসিমপুর পর্যন্ত রাস্তা তৈরি। কিন্তু ওই পর্যন্তই। মূল-কাজের জন্য যে জমি অধিগ্রহণ প্রয়োজন, তাই-ই হয়নি!
এরই মধ্যে গত অক্টোবরে জঙ্গলমহলে এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেন, সুবর্ণরেখা নদীর উপর নয়াগ্রামে সেতু তৈরি হবে। ইতিমধ্যে প্রস্তাবিত সেতুর শিলান্যাসও হয়েছে। এ জন্য ১৭০ কোটি টাকার প্রকল্প তৈরি হয়েছে। ফলে, সুবর্ণরেখা ব্যারাজ প্রকল্পের কাজ নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে সংশ্লিষ্ট সব মহলেই। ব্যারাজ তৈরি হলে এমনিতেই সেতু হত। তা হলে রাজ্য সরকার কেন ব্যারাজ-প্রকল্প রূপায়িত করতে তৎপর হচ্ছে না, সেই প্রশ্ন উঠেছে।
মেদিনীপুরের সাংসদ প্রবোধ পণ্ডার বক্তব্য, “সুবর্ণরেখা বাঁধ-প্রকল্পের কাজ শুরু করতে রাজ্য সরকারের উদ্যোগী হওয়া উচিত। প্রকল্প রূপায়িত হলে অন্তত ১০টি ব্লকে কৃষির উন্নয়ন হবে।” পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পরিষদের সভাধিপতি অন্তরা ভট্টাচার্য বলেন, “প্রকল্পের গতি অত্যন্ত শ্লথ। কৃষির উন্নয়নে ও কৃষিজীবী মানুষের জীবন ও জীবিকার স্বার্থে প্রকল্পের কাজ যত দ্রুত সম্ভব শেষ করা প্রয়োজন।” জেলা পরিষদের সেচ-কর্মাধ্যক্ষ সমীর হাজরা-রও বক্তব্য, “সুবর্ণরেখা বাঁধ-প্রকল্প রূপায়িত হলে এলাকার আর্থ-সামাজিক অবস্থাই পাল্টে যাবে। অথচ, এই প্রকল্পের কাজ শুরু নিয়ে কোনও তৎপরতা নেই!” নয়াগ্রামের তৃণমূল বিধায়ক দুলাল মুর্মুরও বক্তব্য, “মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে বাঁধ-প্রকল্প করতে হবে।”
জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, শুরুতে বাঁধ প্রকল্পের জন্য যে ব্যয় ধরা হয়েছিল, তা-ও এখন প্রায় দশগুণ বেড়েছে। শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ২১৫ কোটি টাকা। এখন ব্যয় ধরা হচ্ছে ২ হাজার ৩২ কোটি টাকা!
তা হলে কি ব্যারাজ-প্রকল্প চিরতরে জলে যেতেই বসেছে? |
ছবি-কিংশুক আইচ। |
|
|
|
|
|