অম্বিকেশ মহাপাত্রের ঘটনা থেকে যার সূত্রপাত, তাকে আরও ‘এগিয়ে নিয়ে যেতে’ সক্রিয় হল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।
সেই সূত্রেই ইন্টারনেটে ক্রমাগত ছড়াতে থাকা মুখ্যমন্ত্রীর বিভিন্ন ‘ব্যঙ্গচিত্র’ মুছতে সোমবার সিআইডি সরাসরি চিঠি দিয়েছে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ফেসবুক-কে। তাতে বলা হয়েছে, ব্যঙ্গচিত্রের উৎস খুঁজে বার করতে হবে। আগামী দিনে মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে ফেসবুকে কুরুচিকর কিছু থাকলে তা ‘সেন্সর’-ও করতে হবে।
যাদবপুরের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র একটি ই-মেল পাঠানোয় প্রথমে তৃণমূল কর্মীদের হাতে হেনস্থা হন। পরে গ্রেফতারও হন। সঙ্গে গ্রেফতার হন তাঁর প্রতিবেশী সত্তরোর্ধ্ব সুব্রত সেনগুপ্ত। পরে অবশ্য জানা যায়, এর পিছনে সিন্ডিকেট-চক্রের স্বার্থও কাজ করেছে।
অম্বিকেশবাবুকে হেনস্থা ও গ্রেফতারের ঘটনায় বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। প্রশ্ন ওঠে, তাঁদের বিরুদ্ধে পুলিশ যে সব অভিযোগ এনেছে, তা কতটা যুক্তিযুক্ত? আইনজীবী মহলের বক্তব্য ছিল, এর আইনগত দিকটি খুবই দুর্বল। এ বারে সরাসরি ফেসবুক থেকে ব্যঙ্গচিত্র মুছতে সিআইডি যে উদ্যোগী হয়েছে, সে প্রসঙ্গেও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। বলা হচ্ছে, কাকে ছেড়ে কাকে ধরবে পুলিশ? সাইবার আইন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল আইনজীবীদের মতে, এ ধরনের ব্যঙ্গচিত্রকে ‘বেআইনি’ প্রমাণ করা কঠিন। বস্তুত, সোমবার এই খবর মেলার পর রাতের মধ্যেই ফেসবুকে আরও বহু ব্যঙ্গচিত্র ছড়িয়ে পড়েছে। এ ভাবে ফেসবুক থেকে ব্যঙ্গচিত্র মুছে দেওয়ার এই ‘সরকারি’ প্রচেষ্টা কতটা সফল হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে গোয়েন্দাদের মধ্যেই।
গোয়েন্দা সূত্রের বক্তব্য, ব্যঙ্গচিত্রের ‘উৎস’ জানতে চাওয়ার অর্থ, যে ব্যক্তি ওই ব্যঙ্গচিত্র তৈরি করেছেন, তাঁকে চিহ্নিত করে সতর্ক করা বা শাস্তি দেওয়া। কিন্তু, এই ধরনের সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে এত লোক এমন ব্যঙ্গচিত্র চালাচালি করছেন, প্রশ্ন উঠেছে তাতে পুলিশ কাকে ধরবে আর কাকে ছাড়বে?
বস্তুত, অম্বিকেশবাবুর ঘটনা থেকেই পুরো বিষয়টিকে সাইবার অপরাধ হিসেবে গণ্য করার পক্ষে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। শুক্রবার ঘটনার দিন তিনি দুর্গাপুরে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, “অপরাধ করলে অ্যারেস্ট হতে হবে।” রাজ্য মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্যও ইন্টারনেটে এই ধরনের ব্যঙ্গচিত্র ছড়ানোকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেন। এ দিন রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কথাতেও তার ইঙ্গিত মিলেছে। সোমবার সল্টলেকে একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “আমরা ফেসবুকের উপরে নজর রাখছি।” আইন মেনে এই নজরদারি কী ভাবে সম্ভব? পার্থবাবু বলেন, “আমরা যা করব, তা সাইবার আইন মেনেই করব।”
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, অম্বিকেশবাবুর গ্রেফতারের পর থেকে বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ব্যঙ্গচিত্র ছড়ানোর ঘটনাও বেড়ে গিয়েছে। ব্যঙ্গচিত্র নিয়ে গ্রেফতারের প্রতিবাদ ফুটে উঠছে নানা ধরনের ব্যঙ্গচিত্রে। এর পরে আরও নড়েচড়ে বসে রাজ্য সরকার। সোমবারেই সিআইডির ডিজি ভি ভি থাম্বি এবং রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশের এডিজি বাণীব্রত বসু এ নিয়ে দীর্ঘক্ষণ বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ফেসবুক কর্তৃপক্ষ কি সিআইডি-র কথা মতো তথ্য দিতে এবং ‘সেন্সরশিপ’ চালাতে বাধ্য? সাইবার আইন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল আইনজীবীরা জানিয়েছেন, ফেসবুক কর্তৃপক্ষ কিন্তু সিআইডি-র এমন কিছু কথা মানতে বাধ্য নয়। তাঁদের বক্তব্য, আমেরিকা থেকে নিয়ন্ত্রিত ফেসবুক-এর নিয়ম-কানুন ওই দেশের আইন মোতাবেকই চলে। ওই ‘সাইট’ থেকে পাওয়া তথ্যেও বলা হয়েছে, আইনি পথে অনুরোধ করা হলে এবং ফেসবুক কর্তৃপক্ষ মনে করলে যে কোনও ধরনের তথ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তাঁরা দিতেই পারেন। সে ক্ষেত্রে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে জালিয়াতি বা অন্য কোনও ধরনের বেআইনি কার্যকলাপের নির্দিষ্ট প্রমাণ থাকতে হবে। কিন্তু, ব্যঙ্গচিত্র সেই ধরনের অপরাধের পর্যায়ে পড়ে কি না, প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও।
রাজ্য সরকার অবশ্য সাইবার-অপরাধের বিষয়টি কেন্দ্রীয় স্তরের আলোচনাতেও নিয়ে গিয়েছে। সোমবার দিল্লিতে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিষয়ক মুখ্যমন্ত্রীদের সম্মেলনেও পশ্চিমবঙ্গের তরফে ‘সাইবার-অপরাধ’ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। মমতার যে লিখিত বিবৃতি এ দিন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র পাঠ করেছেন, সেখানে এ বিষয়ে একটি আলাদা অনুচ্ছেদই রয়েছে।
সেই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গোটা দেশেই সাইবার-অপরাধ বাড়ছে। এ ব্যাপারে সিআইডি-র ডিজি-র নেতৃত্বে একটি নির্দিষ্ট সেল কাজ করছে। কলকাতায় একটি সাইবার পুলিশ থানা ও সাইবার ‘ল্যাবরেটরি’ তৈরি হয়েছে। ন্যাসকম ও ডেটা সিকিউরিটি কাউন্সিল এ বিষয়ে রাজ্যকে সাহায্য করেছে। সংশ্লিষ্ট অফিসারদের প্রশিক্ষণের জন্য গাজিয়াবাদের সিবিআই অ্যাকাডেমিতে পাঠানো হচ্ছে। মমতার যুক্তি, সাইবার-অপরাধ দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল করে দিতে পারে। তাই যোগাযোগ মন্ত্রকের উচিত, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এ বিষয়ে সাইবার-অপরাধ রুখতে যথাযোগ্য পদক্ষেপ করা।
ওই বৈঠকে দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল করার মতো গুরুতর কথা বলা হলেও সামান্য ব্যঙ্গচিত্রের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক, তার ব্যাখ্যা অবশ্য দিতে পারেননি তদন্তকারী সিআইডি কর্তারা।
সনিয়া গাঁধী এবং মনমোহন সিংহকে নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র আটকাতে টেলি যোগাযোগমন্ত্রী কপিল সিব্বল ডিসেম্বরে বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের বিরুদ্ধে সরব হন। এই ধরনের ব্যঙ্গচিত্র ও ‘প্ররোচনামূলক’ ও ‘অবমাননাকর’ বক্তব্য আটকাতে সরাসরি ফেসবুকের মতো সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট এবং গুগল, ইয়াহু-র মতো সার্চ ইঞ্জিন সংস্থার কর্তাদের নির্দেশ দেন তিনি। এই নির্দেশের বিরুদ্ধেও সমালোচনার ঝড় ওঠে দেশ জুড়ে। বলা হয়, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে সরকার। তখনও প্রশ্ন উঠেছিল, বৃহত্তম গণতন্ত্রে সরকার এ ধরনে নৈতিক নজরদারি চালাতে পারে কি? এখন রাজ্য সরকারের এই উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত কতটা সফল হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। |