ভয়াবহ রকমের দুঃসাহসী অভিযানের মধ্য দিয়া আফগানিস্তানের তালিবানরা জানাইয়া দিল, তাহারা আগের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী হইয়াছে। একই সঙ্গে রাজধানী কাবুল ছাড়াও পূর্ব আফগানিস্তানের তিনটি প্রদেশে সুসমন্বিত জঙ্গি হানা এবং পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে জেল ভাঙিয়া প্রায় চার শত তালিবান বন্দিকে ছিনাইয়া লওয়ার রোমহর্ষক সাফল্য মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর ভঙ্গুরতা এবং আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর অপ্রস্তুত দশাও প্রকট করিয়া দিয়াছে। লক্ষণীয়, আক্রমণগুলি কোনও অরক্ষিত, নিরীহ, প্রতিরোধের সম্ভাবনা বর্জিত অঞ্চলে ঘটে নাই, ঘটানো হইয়াছে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সবচেয়ে কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টনীর অভ্যন্তরে। আফগান পার্লামেন্ট, ন্যাটোর সদর দফতর কিংবা পাকিস্তানের জেলখানা কোনওটিই অরক্ষিত লক্ষ্যবস্তু নয়। এই আক্রমণকে ঘিরিয়া উদ্বেগ তাই সঙ্গত ও স্বাভাবিক।
তালিবান মুখপাত্র জানাইয়াছেন, ইহাই তাঁহাদের ‘বসন্ত অভিযান’-এর সূচনা এবং অতঃপর আফগানিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে অনুরূপ আক্রমণ আছড়াইয়া পড়িবে। এই হামলায় তালিবানের তরফে আত্মঘাতী ফিদাইনরাই অংশ লইয়াছে। নিহত ৪৭ জনের মধ্যে ৩৬ জনই তালিবান। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রায় আঠারো ঘণ্টা ধরিয়া তাহারা লড়াই দিয়াছে, তাহাদের জীবন্ত পাকড়াও করাও যায় নাই। এ ধরনের সুসমন্বিত আক্রমণ যে ভবিষ্যতেও সংগঠিত হইতে পারে, সেই হুমকি তালিবান দিয়াছে, আফগান ও পাক রাজনৈতিক মহলেও অভিন্ন আশঙ্কাই ব্যক্ত করা হইয়াছে। এই তালিবানদের মোকাবিলা করা কিংবা ক্ষমতা হইতে দূরে সরাইয়া রাখা যে হামিদ কারজাইয়ের পুতুল সরকার ও তাহার পুলিশ-রক্ষীদের কর্ম নয়, এমন আশঙ্কা স্বাভাবিক। মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী কাবুল ছাড়িলেই (যাহা আজ না হউক কাল তাহাদের করিতেই হইবে) তালিবানরা যে ঝড়ের গতিতে আফগানিস্তান পুনর্দখল করিয়া লইবে, তাহাও সম্ভব। তাই তালিবানদের সহিত আলোচনা ও দর কষাকষির ভিত্তিতে একটি ‘জাতীয় ঐকমত্য’-এর সরকার কাবুলে কায়েম করাই শ্রেষ্ঠ পন্থা বলিয়া মনে হয়। আর সেই দরাদরিতে বিভিন্ন তালিবান গোষ্ঠীর নেতৃত্বকে দর হাঁকিতে দেওয়া ছাড়া মার্কিন প্রশাসনের কাছে বিকল্পই বা কী আছে?
পাকিস্তান তালিবানদের এই আক্রমণের নিন্দা করিয়াছে, সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের কড়া বিরুদ্ধতার অঙ্গীকারও পুনরুচ্চারিত। এ কথা সত্য যে, একদা পাকিস্তানের দেওবন্দি মাদ্রাসাগুলিতেই তালিবানদের মতাদর্শগত দীক্ষা ও সামরিক প্রশিক্ষণ সম্পূর্ণ হয়। এ কথাও ঠিক যে সর্বশেষ এই আক্রমণ সংগঠিত করার জন্য যাহারা দায়ী বলিয়া সন্দেহ, সেই হক্কানি গোষ্ঠী পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশেই ঘাঁটি গাড়িয়াছে। কিন্তু ইসলামাবাদ তালিবানদের হাতেই আফগানিস্তানকে তুলিয়া দিবার পক্ষপাতী, ইহা ধরিয়া লওয়া অতি-সরলীকরণ হইবে। তালিবান জঙ্গিরা ইসলামাবাদের কাছেও বিরাট শিরঃপীড়া। আফগান তালিবানের পাশাপাশি যে পাক তালিবান বিকশিত হইয়াছে, তাহারা পাকিস্তানের রাজনীতি ও সমাজজীবনকে গুপ্তহত্যা, ফিদাইন হামলা ও মানববোমার বিস্ফোরণে সতত সন্ত্রস্ত করিয়া চলিয়াছে। ইহা যে পাকিস্তানের উন্নয়ন ও বিকাশের সম্ভাবনাকে স্থগিত করিতেছে, পাক রাজনীতিকরা তাহা বিলক্ষণ উপলব্ধি করিতেছেন। কাবুলে একটি জেহাদি তালিবান আধিপত্যের সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা তাই তাঁহাদের অভিপ্রেত হইতে পারে না। ভারতের পক্ষেও পরিস্থিতিটি আদৌ স্বস্তিকর নয়। গৃহযুদ্ধবিক্ষত আফগানিস্তানের পুনর্নির্মাণ ও পরিকাঠামো উন্নয়নে ভারতের ভূমিকা আদৌ তালিবানদের পছন্দ নয়। আফগানিস্তান পুনর্দখল করিলে কাশ্মীরের দিকেও তাহাদের আগ্রহ বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। এই পরিস্থিতিতে ইসলামাবাদের সহিত বন্ধন দৃঢ়তর করার বিষয়টি নয়াদিল্লির বিবেচ্য হইতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো কী করিবে, সেটা তাহাদের ব্যাপার। হাজার হোক, আফগানিস্তান তো তাহাদেরই স্বখাত সলিল! |