২০০৭ এবং ২০১০-এর পরে ২০১২। রাজ্যে আবার জয়েন্ট কেলেঙ্কারি।
পরীক্ষায় বসার দরকার নেই। মোটা টাকা দিলেই জয়েন্ট এন্ট্রান্স বৈতরণী পার করিয়ে দেওয়ার জন্য আন্তঃরাজ্য দুষ্টচক্র হাজির। সেই চক্র দীর্ঘদিন ধরে জালিয়াতি চালিয়ে গেলেও তাদের যে কিছুতেই পুরোপুরি কব্জা করা যাচ্ছে না, এ বার আট জনকে গ্রেফতারের পরে ফের সেটা টের পেলেন গোয়েন্দারা। রবিবার সকালে রাজ্যে জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা ছিল। তার আগে, শনিবার সন্ধ্যায় শহরে ‘ভুয়ো’ পরীক্ষার্থীর একটি দল ধরা পড়ে। মধ্য কলকাতার দু’টি হোটেলে হানা দিয়ে পাঁচ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। চক্রের এক পাণ্ডাও ধরা পড়েছে। এ দিন দুপুরে ভবানীপুরে একটি পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে এক তরুণী এবং বজবজের আইটি কলেজের পরীক্ষা কেন্দ্রে এক ভুয়ো পরীক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়।
পুলিশের দাবি, মোটা টাকার বিনিময়ে নাম ভাঁড়িয়ে ‘আসল’ পরীক্ষার্থীদের হয়ে জয়েন্ট দিতেই বিহার থেকে তরুণ-তরুণীরা শহরে ঢুকেছিল। ডিসি (সাউথ) দেবেন্দ্রপ্রকাশ সিংহ বলেন, “ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের দু’টি হোটেলে ধৃত পাঁচ যুবকই বিহারের। তারা হল চন্দন কুমার, দিলীপ কুমার, অভিজিৎ কুমার, রাজীব কুমার ও সানি। |
ধৃত এক ভুয়ো পরীক্ষার্থী। নিজস্ব চিত্র |
বয়স ২০-২৫ বছর। বিএসসি-র পড়ুয়া। কাদের হয়ে পরীক্ষায় বসার জন্য তারা শহরে ঢুকেছিল, তাদের কাছে পাওয়া অ্যাডমিট কার্ডগুলির সূত্র ধরে সেটা যাচাই করা হচ্ছে।” পুলিশ জানায়, ভবানীপুরের একটি স্কুলের পরীক্ষা কেন্দ্রে ধরা পড়া তরুণীর নাম খুশবু। তার বাড়ি বিহারের নালন্দায়। পূজা সিংহ নামে এক পরীক্ষার্থীর হয়ে জয়েন্টে বসেছিল সে।
পুলিশ জানায়, বজবজের পরীক্ষা কেন্দ্রে ধৃত ভুয়ো পরীক্ষার্থীর নাম সুদীপ্ত পাল। সে বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি (বেসু)-র মেকানিক্যালের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। বেসু সূত্রের খবর, এতে নজিরবিহীন শাস্তি হতে পারে। বহিষ্কারও করা হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। দুষ্টচক্রের সঙ্গে তার যোগ আছে কি না, তদন্ত করছে পুলিশ।
২০০৭ বা ২০১০ সালেও জয়েন্ট পরীক্ষার সময় এই ধরনের জালিয়াতির কারবারিদের ধরতে হিমশিম খেয়েছিল পুলিশ। চক্রের চাঁইদের কয়েক জন তখন ধরাও পড়ে। আবার এ বারের জয়েন্টে ঠগদের আবির্ভাব ঘটল। এ বার যে-চক্রটির কথা পুলিশ জানতে পেরেছে, তাদের সঙ্গে আগেকার চক্রের যোগসাজশ আছে কি না, যাচাই করা হচ্ছে।
ভবানীপুরের পরীক্ষা কেন্দ্রে ধৃত খুশবুকে নিয়ে ধন্দে রয়েছে পুলিশ। তারা জানায়, পূজা সিংহ নামে এক ছাত্রীর হয়ে খুশবু জয়েন্ট দিতে গিয়েছিল। কিন্তু নিজের অ্যাডমিট কার্ড নিয়ে পূজা সিংহও পরীক্ষা কেন্দ্রে চলে আসে। খুশবুর হাতে ছিল নেট থেকে ‘ডাউনলোড’ করা অ্যাডমিট কার্ড। তাতে ‘পূজা সিংহ’ নামটি স্পষ্ট লেখা থাকলেও ছবিটি ছিল অস্পষ্ট। ‘আসল’ ও ‘ভুয়ো’ পরীক্ষার্থী দু’জনেই পরীক্ষা কেন্দ্রে এল কেন? জবাব খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশও। তাদের দাবি, পূজা বলে, তার হয়ে পরীক্ষা দিতে আসা ভুয়ো পরীক্ষার্থীর বিষয়টা সে জানতই না। পূজা সব প্রশ্নের উত্তর লিখেছে। অথচ খাতায় তেমন কিছুই লেখেনি খুশবু। পুলিশের ধারণা, ধরা পড়ে যাবে বুঝেই উত্তর লেখেনি খুশবু। কার নির্দেশে সে ‘ভুয়ো পরীক্ষার্থী’ হিসেবে পরীক্ষা কেন্দ্রে ঢুকেছিল, সেই রহস্য ভেদ করতে পারেনি পুলিশ।
চক্রের মাথাদের ধরতে পুলিশ কত দূর এগোল? ডিসি জানান, সদানন্দ বর্মন নামে ওই চক্রের এক পাণ্ডাকে তার পাটুলির বাড়ি থেকে ধরা হয়েছে। হোটেলে ধৃত বিহারের পাঁচ যুবক পুলিশকে জানিয়েছে, একটি এজেন্সির মাধ্যমে তারা কলকাতায় পরীক্ষা দিতে এসেছিল। সদানন্দই ওই এজেন্সির কর্তা। লেনিন সরণিতে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা সংক্রান্ত একটি অফিসে বসে কারবার চালায় সে। এক পুলিশকর্তার কথায়, “ধৃতেরা জেরায় স্বীকার করেছে, সদানন্দই তাদের মোটা টাকা পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে পরীক্ষায় বসতে বলেছিল। যদিও সেই টাকা এখনও তাদের হাতে আসেনি। তবে ‘আসল’ পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে এক লক্ষ টাকা করে নেওয়া হয়েছে বলে তাদের আশ্বাস দেওয়া হয়।” সদানন্দ ছাড়াও চক্রের আরও কয়েক জন রাঘববোয়াল আছে বলে পুলিশের সন্দেহ। তাদের আশা, আসল পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বললেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
২০০৭ ও ২০১০ সালে জাল-জয়েন্ট চক্রের মাথাদের সন্ধান মিলেছিল ‘আসল’ পরীক্ষার্থীদের সূত্র ধরেই। ২০১০ সালে দেখা গিয়েছিল, পটনার এক চায়ের দোকানে আলাপ হয় দুই যুবকের। দু’জনের নামই রঞ্জিত। তবে পদবি আলাদা। প্রথম জন ইলাহাবাদের একটি কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছিল। দ্বিতীয় রঞ্জিতই ইঞ্জিনিয়ার রঞ্জিতকে কলকাতায় গিয়ে মোটা টাকার বিনিময়ে বিহারের প্রসূন কুমার নামে এক জনের হয়ে জয়েন্টে বসার প্রস্তাব দেয়। দ্বিতীয় রঞ্জিতই যে দুষ্টচক্রের মাথা, জানা যায় তখনই। তবে শনিবার যারা গ্রেফতার হয়েছে, তাদের অ্যাডমিট কার্ডের ছবি বদলানো হয়নি। পুলিশের দাবি, নাম ভাঁড়ালেও অন্য লোকের ছবি সাঁটা অ্যাডমিট কার্ড নিয়েই পরীক্ষা দিতে যাচ্ছিল তারা। তাই পুলিশের ধারণা, এই চক্রটি কিছুটা আনকোরা। |