এত আলোড়ন, সমালোচনা, প্রতিবাদের পরেও এবং আইন বিশেষজ্ঞরা অম্বিকেশ মহাপাত্রের গ্রেফতার নিয়ে প্রশ্ন তুললেও পুরমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম ঘটনাটিকে প্রকারান্তরে সমর্থনই করেছেন। তিনি এ দিন বলেছেন, কারও ছবি দিয়ে চিহ্নিত করে তাঁকে ‘অপমান’ করাটা আইনত অপরাধ। বস্তুত, মহাকরণের একটি অংশও মনে করে, গোটা ঘটনাটি ‘সাইবার অপরাধ’ হিসেবে গণ্য করা উচিত এবং সেই সংক্রান্ত আইন মোতাবেকই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। শুধু ফিরহাদই নন, এই সংক্রান্ত অন্যান্য অভিযোগের মোকাবিলায় এ দিন ময়দানে নেমেছেন রাজ্যের আর এক মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ও। অম্বিকেশবাবুকে ‘হেনস্থার’ ঘটনায় তৃণমূল কর্মীদের জড়িত থাকার যে অভিযোগ উঠেছে, তার ‘জবাব’ দিয়ে সুব্রতবাবুর পাল্টা প্রশ্ন, ওরা যে তৃণমূল কর্মী তা কে বলল?
উল্টো দিকে, বিরোধী সিপিএমের নেতারা এ দিনও কার্টুন-কাণ্ডের প্রতিবাদে সরব হয়েছেন। প্রবীণ নেতা বিনয় কোঙার বলেছেন, কার্টুন-কাণ্ডে এক অধ্যাপককে যে ভাবে গ্রেফতার করা হয়েছিল, তার মধ্যে ‘ফ্যাসিস্তের হিংস্রতা’ আছে। সিপিএমের প্রাক্তন মন্ত্রী গৌতম দেব কটাক্ষ করলেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই কার্টুন হয়ে যাচ্ছেন!
প্রধান বিরোধী দল সিপিএমের নেতাদের বক্তব্যেই পরিষ্কার, কার্টুন-কাণ্ড ঘিরে বিতর্ককে তাঁরা মুখ্যমন্ত্রী মমতার বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানোর ‘হাতিয়ার’ হিসাবে ব্যবহার করছেন। দলের একটি গণসংগঠন আদিবাসী ও লোকশিল্পী সঙ্ঘের একটি সিডি প্রকাশের অনুষ্ঠানের অবসরে কার্টুন-কাণ্ড নিয়ে প্রশ্নের জবাবে রবিবার প্রবীণ কৃষক নেতা বিনয়বাবু সরাসরিই বলেন, “অনেকে একে ছ্যাবলামো বলছেন! কিন্তু ছ্যাবলামো বললে ঘটনাকে লঘু করা হয়। এর মধ্যে ফ্যাসিস্তের হিংস্রতা আছে। দলবদ্ধ ভাবে প্রতিবাদ না-করলে এই হিংস্রতা থেকে কেউ বাঁচব না। আমরা নিরাপদ নই, আপনারাও (সংবাদমাধ্যম) নন!”
ঘটনাচক্রে, রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র কার্টুন-কাণ্ডকে রাজ্য সরকারের তরফে ‘হাস্যকর ঘটনা’ বলে প্রাথমিক ভাবে অভিহিত করেছিলেন। এ দিন মুর্শিদাবাদে দলের যুব সংগঠনের সমাবেশে তিনি বলেছেন, “ওই শিক্ষক ওই রঙ্গচিত্র তাঁর কয়েক জন বন্ধু-বান্ধবকে পাঠিয়েছিলেন মাত্র। এতেই তৃণমূল কর্মীরা তাঁকে হেনস্থা করেন। মারধরও করা হয় তাঁকে। তাঁকে জোর করে লিখিয়ে নেওয়া হয়েছে যে, তিনি সিপিএম কর্মী। এটাকে যদি সুশাসন বলা হয়, তা হলে সুশাসন!”
বিনয়বাবু এ দিন কুট্টির কার্টুনের কথা তুলেছিলেন। তাঁর বক্তব্য, “রাজীব গাঁধীকে নিয়ে কার্টুন করা হয়েছিল, যেখানে দেখানো হয়েছিল রাজীবের নাক লম্বা হতে হতে কী ভাবে বফর্স কামান হয়ে গেল! সে বার নির্বাচনে রাজীবের পরাজয়ে সেই কার্টুনের বড় ভূমিকা ছিল। তার বিরুদ্ধে কি কেউ ব্যবস্থা নিতে গিয়েছিল? এই পশ্চিমবাংলাতেও কত কার্টুন হয়েছে!” কুট্টির কার্টুনের প্রসঙ্গ এনেই আবার পাল্টা যুক্তি দিয়েছেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ। মহাজাতি সদনে এ দিন ফিরহাদ বলেন, “কার্টুন আঁকা আইনের চোখে অপরাধ নয়। কুট্টি যেমন অনেক নেতা-নেত্রীকে নিয়ে কার্টুন আঁকতেন। অনেক মনীষী, এমনকী মমতাকে নিয়েও কার্টুন হয়েছে। কিন্তু কারও ছবি দিয়ে তাঁকে চিহ্নিত করে অপমান করাটা আইনত অপরাধ।” তবে যাদবপুরের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যে রঙ্গচিত্র ‘ফরওয়ার্ড’ করেছিলেন, সেই ঘটনায় আইন আইনের পথে চলবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
অম্বিকেশবাবুকে ‘হেনস্থা’র ঘটনায় তৃণমূল কর্মীরা জড়িত বলে যে অভিযোগ উঠেছে, তা নিয়ে আবার ভিন্ন মত পোষণ করেছেন মন্ত্রী সুব্রতবাবু। এই বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে তাঁর বক্তব্য, “ওই ঘটনায় তৃণমূলের কর্মীরা জড়িত ছিল কি না, তা কী করে জানা যাচ্ছে? যাঁরা শিক্ষককে মারধর করেছে, তারা তৃণমূল করে কি না বা দলের সঙ্গে তাদের কোনও যোগাযোগ আদৌ রয়েছে কি না, আমার সন্দেহ আছে।”
উল্টো দিকে, ছেড়ে কথা বলেননি সিপিএমের গৌতমবাবু! অশোকনগরে এক স্মরণসভায় সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক গৌতমবাবু বলেন, “একটা লোক ছবি এঁকেছে, আর তাকে জেলে ঢুকিয়ে দিল! মুখ্যমন্ত্রী না-বললে কারও জেলে ঢোকানোর সাহস ছিল?” পরে মঞ্চ থেকে নেমে তাঁর মন্তব্য, “উনি (মমতা) নিজেই কার্টুন হয়ে যাচ্ছেন! মানসিক ভাবে সুস্থ নন মমতা! না-হলে এমন কাণ্ড করেন?”
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির আর এক সদস্য মদন ঘোষ শিশুমৃত্যু থেকে কৃষক আত্মহত্যা, গ্রন্থাগারে নির্দিষ্ট সংবাদপত্র রাখার ‘ফতোয়া’ থেকে কার্টুন-কাণ্ড যাবতীয় ঘটনাকেই ‘অসুস্থ প্রবণতা’ বলে অভিহিত করেছেন। মোর্তাজা হোসেন, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, অনির্বাণ চৌধুরীদের নেতৃত্বে বাম শরিক ফরওয়ার্ড ব্লকের একটি মিছিল এ দিনই বারাসতের সুভাষ লাইব্রেরির সামনে প্রতিবাদ সভা করে আনন্দবাজার-সহ ফতোয়ায় ‘নিষিদ্ধ’ সংবাদপত্র জনতার মধ্যে বিলি করেছে। পাশাপাশি, সিপিএমের কৃষক সভার রাজ্য সভাপতি মদনবাবু জানান, গ্রামীণ জনতার জীবন নিয়ে আদিবাসী সঙ্ঘের সিডি সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ‘আপলোড’ করা হবে। |