গল্পের বই পড়ো, তবে পড়া ফেলে নয়
একটা ব্যাপারে আমার প্রচুর অসুবিধা হয়। ব্যাপারটা একটু অন্য ধরনের। মানে, আমি প্রচুর উপন্যাস পড়ি এবং পড়তে ভালওবাসি। ক্লাসের বই ছাড়া বাইরের সাত-পাঁচ ধরনের বই পড়তে আমার অসীম আগ্রহ। আমি ক্লাস এইটে পড়ি, ফলে র্যাঙ্ক ধরে রাখার একটা চাপও থাকে পড়াশোনায়। কিন্তু যত ক্ষণ একটা উপন্যাস পড়া চলে, তত ক্ষণ বইয়ের পড়ায় মন বসে না। ফলে পড়াশোনা নষ্ট হয়। একটা উপন্যাস শেষ হলেই আবার আর একটা পড়তে ইচ্ছে করে। এতে রেজাল্ট খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মা-বাবার অমতেই আমি পড়ি। মা বলে, এই সব বই এই বয়সে পড়লে ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাবে। প্রথমে রেজাল্ট ভাল করা চাই, তার পর অন্য কিছু। আর একটা কথা হচ্ছে, কবিতা-গল্প লেখার ঝোঁকও আমাকে চেপে ধরেছে। এই সব সাহিত্য নিয়েই আমি বেশি সময় থাকি। এর ফলে পড়াশোনার ক্ষতি তো হয়ই, মা-বাবার কাছেও বকুনি খেতে হয়। এই সব পড়লে কি সত্যি-সত্যিই ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাবে? আমি কোনও কবি-সাহিত্যিক হতে চাই না, একটা সুষ্ঠু প্রফেশনাল লাইফ বেছে নিতে চাই। আমার কি ক্লাসের বই ছাড়া অন্য বই পড়া বন্ধ করে দেওয়া দরকার? এক দিকে মা-বাবার ভয় ও ক্লাসের পড়াশোনা, অন্য দিকে নানান ধরনের বই পড়ার আগ্রহ এই নিয়ে প্রচুর সমস্যায় পড়তে হয় আমাকে। কী করলে ভাল হবে এবং ভাল ভাবে ভবিষ্যৎ গড়তে পারব?
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
তোমাকে বলছি
তুমি লিখেছ যে, র্যাঙ্ক ধরে রাখার একটা চাপ তোমার ওপর আছে। তার মানে, তুমি তোমার ক্লাসে বেশ ওপরের দিকেরই ছাত্র। গল্প-উপন্যাস পড়ে, পড়ার বইয়ের বাইরে আরও পাঁচ রকম বই পড়েও যখন ভাল রেজাল্টই করো, তা হলে এত ঘাবড়াচ্ছ কেন?
তোমার চিঠিটা পড়ে বেশ ভাল লাগল। প্রথম কথা হল, তুমি বেশ গুছিয়ে লিখতে পারো। দ্বিতীয়ত, তোমার ‘সমস্যা’ কী, সে বিষয়ে তোমার একটা স্পষ্ট ধারণা আছে। প্রথমেই বলি, এই গুছিয়ে ভাবতে পারা, বলতে পারা একটা গুণ। লেখাপড়ার ক্ষেত্রে এই গুণটা খুবই কাজে লাগে, অল্প সময়ের মধ্যেই যে কোনও বিষয়ে একটা পরিষ্কার ধারণা তৈরি হয়ে যায়। ফলে অন্যদের তুলনায় সম্ভবত তোমার পড়া তৈরি করতে কম সময় লাগে। মানে, তোমার হাতে একটু বাড়তি সময় থাকেই। সে সময়টা তুমি কী ভাবে ব্যবহার করবে, সেটা তোমার ব্যাপার। গল্প-উপন্যাস পড়ে বাড়তি সময় ব্যয় করাটা, সাধারণ ভাবে বললে, খুবই ভাল ব্যবহার।
আমাদের মনটা আসলে একটা বেলুনের মতো। যদি তাতে হাওয়া না ভরো, সেটা চুপসে ছোট্ট হয়ে থাকে। কিন্তু যত হাওয়া ভরবে, বেলুনটা ততই বড় হতে থাকবে। এটাকে মনের প্রসার বলে। সাহিত্যপাঠে মনের যতখানি প্রসার হয়, তেমনটা আর কিছুতে নয়। যত পড়বে, দেখবে ততই তোমার চিন্তাভাবনা প্রসারিত হচ্ছে, বড় করে ভাবতে পারছ, নতুন নতুন বিষয়ে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। আর পাঁচ জনের চেয়ে অন্য ভাবে ভাবতে পারছ। তোমার স্কুলের পড়াশোনার ওপরও এর প্রত্যক্ষ সুপ্রভাব পড়বে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি এর পরোক্ষ প্রভাব। আমি এক অসাধারণ পণ্ডিত মানুষকে চিনি। ইতিহাসে তাঁর অগাধ জ্ঞান। তাঁর ইতিহাস পড়ার ইচ্ছে কিন্তু স্কুলের বই পড়ে হয়নি, হয়েছিল শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস পড়ে। সেই উপন্যাস কি সত্যিই অক্ষরে অক্ষরে ইতিহাস মেনে লেখা? মোটেই নয়। কিন্তু, মনের মধ্যে ইতিহাসের সুর বেঁধে দিয়েছিল সেই উপন্যাস। সাহিত্য না পড়লে এই সুরটা তৈরিই হত না।
তোমায় হয়তো এই কথাগুলো না বললেও চলত, কারণ তুমি যখন পড়তে ভালবাসো, তখন তুমি নিজেই জানো যে কী ভাবে এই পড়া তোমায় সাহায্য করছে। কিন্তু, তোমার এখন একটা অন্য সমস্যা। তোমার চিঠি পড়ে মনে হচ্ছে, তুমিও একটা দ্বিধায় আছো এই গল্পের বইয়ের প্রতি আকর্ষণ তোমার লেখাপড়ার ক্ষতি করবে না তো? তুমি যেমন কেরিয়ার চাও, সেটার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না তো? আশঙ্কাটা যে একেবারে অমূলক, তা বলব না। গল্পের বই যাদের টানে, তারাই জানে যে সেই টান কত জোরদার। কাজেই, তোমায় লেখাপড়া আর বাইরের বই পড়া এই দুটোর মধ্যে একটা ভারসাম্য আনতে হবে। সেটা করার অনেক উপায় হতে পারে। আমি একটা পরামর্শ দিই। ধরো, একটা উপন্যাস পড়ছ। সেটা পড়ার পর পরের উপন্যাসটা তখনই ধরে ফেলো না। দিন তিনেক অপেক্ষা করো। সেই ফাঁকে শুধু লেখাপড়া করো। নিজের জন্য টার্গেট ঠিক করে নাও। নিজেকে বলো, ইতিহাসের দুটো অধ্যায়, অঙ্কের দুটো অধ্যায় শেষ করার পর, তার উত্তর তৈরি করার পর আবার পরের উপন্যাসটা ধরব। নিজেকে ফাঁকি দিও না। পড়া তৈরি হওয়ার পরেই আবার গল্পের বইয়ে হাত দাও। যেহেতু গল্পের বই পড়ার জন্য তোমার তীব্র ইচ্ছে হবে, সেই ইচ্ছেটাই তোমার লেখাপড়াকেও এগিয়ে নিয়ে যাবে।
নিজের জন্য পুরস্কার আর শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারলে, আর সেই ব্যবস্থা মেনে চলতে পারলে দারুণ হয়। ধরো তুমি ঠিক করলে, সামনের পরীক্ষায় অঙ্কে অন্তত ৯৫ পেতেই হবে। যদি পাও, তা হলে নিজেকে একটা বাড়তি বই পড়ার সুযোগ দেবে। আর যদি না পাও, তবে গল্পের বইয়ের তালিকা থেকে একটা বই কাটা যাবে সেই সময়টা পড়াশোনার জন্য ব্যবহার করবে। নিজেকে মোটিভেট করতে পারা খুব জরুরি। এটা যে যেমন ভাবে পারে, করে। তুমি গল্পের বই পড়াটাকেই নিজের মোটিভেশন হিসেবে ব্যবহার করতে পারো।
তবে, পড়ার অভ্যাসটা ছেড়ো না যেন। আজকের পড়া তোমার ভবিষ্যতে প্রচুর কাজে লাগবে। তোমার চারপাশের লোকজনের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকবে তুমি।
বাবা-মাকে বলছি
একটা চমৎকার ছেলে পেয়েছেন আপনারা। এখন বেশির ভাগ মা-বাবাই ছেলেকে একটা বই পড়াতে নাজেহাল হয়ে যান। আপনাদের ছেলে নিজেই পড়তে ভালবাসে। ওকে উৎসাহ দিন। সারা দিন যারা স্কুল-কলেজের লেখাপড়ায় মুখ গুঁজে থাকে, তারা ধীরে ধীরে একটু ভোঁতা হয়ে যায়। আপানাদের ছেলে বেশ বুদ্ধিমান, কাজেই ও স্কুলের পড়াকে অবহেলা করবে না। আপনাদের উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ অবশ্য আছে। আশার কথা, ছেলে এই কারণটা বোঝে এবং গুরুত্ব দেয়। ওর স্কুলের পড়া আর বাইরের পড়ার মধ্যে যাতে একটা ভারসাম্য থাকে, সেটা আপনারা নিশ্চয়ই দেখবেন। শুধু গল্প-উপন্যাস পড়াটাও কোনও কাজের কথা নয়। কিন্তু ওর মনের এই দিকটা যাতে খোলা থাকে, সেটাও আপনাদেরই দেখতে হবে। ওর সঙ্গে বরং একটা চুক্তি করুন পরীক্ষায় আপনাদের মনোমত ফল করতে পারলে ওকে ভাল ভাল কয়েকটি বই কিনে দিন, ও যাতে বুঝতে পারে, পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য বই পড়ার ক্ষেত্রে আপনারা ওর শত্রুপক্ষ নন তাতে আপনাদেরও সমর্থন আছে। এটা কিন্তু নির্দ্বিধায় সমর্থন করার মতোই একটা অভ্যেস।
ছেলেমেয়েকে নিয়ে মা-বাবার সমস্যা? নাকি মা-বাবাকে নিয়ে ছেলেমেয়ের সমস্যা? পড়ার খরচ
নিয়ে অভিভাবকের দুশ্চিন্তা? দূরের শহরে পড়তে যাওয়ার নামে মেয়ের গায়ে জ্বর আসা? যে
মুশকিলই হোক না কেন, পরিবারের সবাই মিলেই সমাধানে পৌঁছতে হবে। এ বার থেকে
‘প্রস্তুতি’-ও কথা বলবে গোটা পরিবারের সঙ্গেই। অভিভাবকদের বা সন্তানের যে কোনও দুশ্চিন্তার
কথা আমাদের জানান (এবং জানাও) নিজেদের সমস্যা। সুচিন্তিত উত্তর দেবেন বিশেষজ্ঞরা।

ইমেল: prastuti@abp.in বিষয়: Haate Haat।

অথবা, চিঠি পাঠান (এবং পাঠাও) এই ঠিকানায়:
হাতে হাত, প্রস্তুতি,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
এ বি পি প্রাঃ লিঃ,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা ৭০০ ০০১


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.