নির্মাণকাজ শুরু হয়ে যাওয়ার বছর চারেক পরে যাত্রাপথের একাংশ বদল করার ভাবনাচিন্তা শুরু হল ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোয়। পথ বদলের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে ফের সমীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য পরিবহণ দফতর। আগামী সপ্তাহে এই সংক্রান্ত সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি হতে পারে বলে মহাকরণ সূত্রে জানা গিয়েছে।
সল্টলেকের পাঁচ নম্বর সেক্টর থেকে হাওড়া ময়দান পর্যন্ত ওই মেট্রোপথ নির্মাণ শুরু হয় ২০০৮ সালে। চার বছর পরে পরিবহণ দফতরের এই সিদ্ধান্তকে ঘিরে তীব্র টানাপোড়েন শুরু হয়েছে রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ মহলে। মুখ্যসচিব-সহ রাজ্য সরকারের যে চার জন আইএএস অফিসার ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো রেল কর্পোরেশনের (কেএমআরসি) বোর্ডের সদস্য, তাঁরা কেউ এই ‘উদ্যোগ’-এর কথা জানেন না। সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টরও অন্ধকারে। তবে সকলেই বিষয়টি ‘শুনেছেন’ বলে ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন। অন্য দিকে, পরিবহণ দফতরের কর্তারাও বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে নারাজ।
ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর মোট ১৪.৫৮ কিলোমিটার পথে ১২টি স্টেশন হওয়ার কথা। এর মধ্যে রয়েছে সল্টলেকের পাঁচ নম্বর সেক্টর, করুণাময়ী, সেন্ট্রাল পার্ক, সিটি সেন্টার, বেঙ্গল কেমিক্যাল, ফুলবাগান, সল্টলেক স্টেডিয়াম, শিয়ালদহ, সেন্ট্রাল, মহাকরণ, হাওড়া এবং হাওড়া ময়দান। কেএমআরসি সূত্রের খবর, কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদনক্রমে জাপানের সংস্থা ‘জাইকা’ এই প্রকল্পে ঋণ দিয়েছে। ২০১৬ সালে এই মেট্রো চালু হওয়ার কথা। যৌথ ভাবে প্রকল্পের দায়িত্বে রয়েছে কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রক এবং রাজ্য সরকার। তবে নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের হাত থেকে প্রকল্পটি রেল মন্ত্রকের হাতে চলে যাবে বলে সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে।
এই প্রেক্ষিতে মূলত মধ্য কলকাতা এলাকায় নতুন মেট্রোর যাত্রাপথ পরিবর্তন করার ভাবনা শুরু হয়েছে। পরিবহণ দফতরের এক মুখপাত্র জানান, বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে নতুন মেট্রোর সুযোগ পৌঁছে দিয়ে এই প্রকল্পকে লাভজনক করার জন্যই পথ বদলের কথা ভাবা হয়েছে। তাঁর কথায়, “সমীক্ষা করা মানেই পরিবর্তন করা নয়। নতুন পথের সমীক্ষা এবং বাস্তব অবস্থা খতিয়ে দেখে তবেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। রেলের সংস্থা ‘রাইটস’-কে দিয়ে সমীক্ষা করানোর কথা ভাবা হয়েছে।”
প্রস্তাবিত সেই নতুন পথ কী? পরিবহণ দফতরের এক বিশেষজ্ঞ জানান, শিয়ালদহের পরে সেন্ট্রাল স্টেশনটি পরিবর্তন করে স্টেশন হবে হিন্দ সিনেমা হলের সামনের রাস্তায়। সেখান থেকে এস এন ব্যানার্জি রোড হয়ে ধর্মতলা ট্রামডিপোর কাছে হবে পরবর্তী স্টেশন। মহাকরণ স্টেশনটি হবে লালদিঘির ধারে। ধর্মতলা থেকে রাজভবনের পশ্চিম দিকের রাস্তা ধরে সোজা মেট্রো চলে যাবে লালদিঘির কাছে। এর অর্থ, মেট্রোর মোট স্টেশনের সংখ্যা বাড়িয়ে ১৩টি করা হবে। এবং এই পরিবর্তনে দেড় কিলোমিটার পথ বাড়বে মেট্রোর।
পরিবহণ দফতরের যুক্তি, সেন্ট্রাল স্টেশন এলাকায় তেমন যাত্রী হয় না। তার চেয়ে বেশি যাত্রী পাওয়া যাবে হিন্দ সিনেমা হলের এলাকায়। সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন হতে পারে ধর্মতলায়। কয়েক লক্ষ লোক প্রতিদিন সেখান দিয়ে যাতায়াত করেন। এর সঙ্গে আছেন ময়দান এলাকার যাত্রীরা। আবার, বর্তমান যাত্রাপথে ‘মহাকরণ’ স্টেশনটি রাখা হয়েছে বৌবাজার-ব্রেবোর্ন রোডে, খাস মহাকরণের প্রায় ২০০ মিটার দূরে। তার বদলে মহাকরণের উল্টো দিকে লালদিঘির ধারে স্টেশন হলে বিবাদী বাগ এলাকার লোকজন মেট্রোর সুবিধা পাবেন।
প্রশাসনের একটি অংশ এই যুক্তি মানতে নারাজ। তাঁদের বক্তব্য, শহরের নতুন মেট্রোর জন্য ‘রাইটস’ সমীক্ষা করে কয়েকটি যাত্রাপথের প্রস্তাব দিয়েছিল। তার পরে বাস্তব অবস্থা, সম্ভাব্য যাত্রীর সংখ্যা ও লাভের দিকটি মাথায় রেখেই এখনকার পথ চূড়ান্ত করা হয়, যা খতিয়ে দেখে ‘জাইকা’ ঋণ অনুমোদন করেছে। নতুন প্রস্তাবের কার্যত বিরোধিতা করে তাঁদের পাল্টা যুক্তি গড়িয়াহাট, হাতিবাগান-শ্যামবাজারের মতো এলাকায় বহু লোক যাতায়াত করেন। যাত্রী-সংখ্যার কথা ভাবলে ওই সব এলাকাও নতুন রুটের সঙ্গে যোগ করা উচিত।
কেএমআরসি-র দাবি, সেন্ট্রাল স্টেশন তৈরির জন্য লু-সুন সরণিতে একটি পাঁচতলা বাড়ি তৈরি করে উচ্ছেদ হওয়া দোকানদারদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুভাষ সরোবর এলাকায় একটি ইন্ডোর স্টেডিয়াম স্থানান্তরিত হয়েছে। কলকাতা পুরসভার কর্মীদের বসবাসের জন্য এখানেই পাকা বাড়ি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। হাওড়া ময়দানে স্টেশন করার জন্য শ্রীমার্কেটের ১২৯টি দোকানকে অস্থায়ী ভাবে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। এক মুখপাত্র জানান, মহাকরণ স্টেশনের জন্য বৌবাজারে কিছু ভাড়াটেকে নিয়ে সমস্যা রয়েছে। মেট্রোর যাত্রাপথের দু’দিকে টানেল তৈরিও শুরু হয়ে গিয়েছে। এই অবস্থায় পথ পরিবর্তন করলে সমস্যা হবে বলে মনে করা হচ্ছে। তাঁদের যুক্তি, এই প্রকল্পের সঙ্গে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার যুক্ত। ‘জাইকা’ বা যে নির্মাণ সংস্থা কাজ করছে, তারাও বেঁকে বসতে পারে। নতুন কিছু করতে গেলে প্রকল্পটাই না বানচাল হয়ে যায়।
পরিবহণ দফতরের কর্তাদের পাল্টা যুক্তি নতুন পথের জন্য আলাদা সংস্থাকে নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। আর যাত্রী-সংখ্যা ও লাভের কথা বোঝাতে পারলে ‘জাইকা’রও বাড়তি ঋণ দিতে রাজি না-হওয়ার কারণ নেই। দেড় কিলোমিটার নতুন রুটের জন্য বাড়তি লাগতে পারে ৪০০ কোটি টাকা। |