লক্ষ লক্ষ টাকার ‘ভুয়ো’ বিল। সঙ্গে শতাধিক ফাঁকা প্লট, যার বাজারমূল্য প্রায় পঞ্চাশ কোটি!
আর এখান থেকেই নিউ গড়িয়া উন্নয়ন সমবায় আবাসনে সাম্প্রতিক ‘নেট-রঙ্গে’র সূত্রপাত বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের দাবি। যাঁদের অভিযোগ, ইমারতি-পণ্যের ‘ভুয়ো’ বিল পাশের তাগিদ ও মহার্ঘ জমি নিয়ে ‘দালালি’র সুযোগ আদায়ের উদ্দেশ্যেই বৃহস্পতিবার রাতে মারধর করে থানায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল আবাসনের সম্পাদক সুব্রত সেনগুপ্ত ও সহ-সম্পাদক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে। পুরো ঘটনাটির পিছনে সেই ‘সিন্ডিকেট চক্রের’ই কারসাজি দেখছেন বাসিন্দাদের এই মহল।
গত ২৭ নভেম্বর বাগুইআটিতে সিন্ডিকেট-বিবাদের জেরে খুন হয়েছিলেন তৃণমূলকর্মী স্বপন মণ্ডল। স্থানীয় তৃণমূলকর্মীদের অনেকে এর জন্য দলেরই অন্য গোষ্ঠীর দিকে আঙুল তুলেছিলেন। তার পরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করে দেন, তৃণমূলের কোনও নেতা-কর্মী সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবেন না। মুখ্যমন্ত্রী তখন পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন, সিন্ডিকেট করতে হলে পার্টি ছেড়ে দিতে হবে।
কিন্তু দলনেত্রীর হুঁশিয়ারিতে যে বিশেষ কাজ হয়নি, নিউ গড়িয়ার ঘটনায় তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে বলে ওখানকার বাসিন্দাদের একাংশ মনে করছেন। তাঁদের অভিযোগ, নিউ গড়িয়ার সিন্ডিকেট-সদস্যেরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতেই অম্বিকেশবাবু ও সুব্রতবাবুকে ‘শিক্ষা’ দিতে চেয়েছিল। আর এই কাজে তারা ‘হাতিয়ার’ করেছিল খোদ মুখ্যমন্ত্রীর ব্যঙ্গচিত্রটিকে। তৃণমূলের উপর তলার নেতাদের তারাই খবর দেয়, মুখ্যমন্ত্রীকে ‘অশ্লীল ব্যঙ্গচিত্রে’র সাহায্যে অপমান করেছেন অম্বিকেশবাবুরা।
|
অম্বিকেশ মহাপাত্র |
কিন্তু অম্বিকেশবাবুদের ‘শিক্ষা দেওয়া’র দরকার পড়ল কেন?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে প্রথমে দেখতে হবে, অম্বিকেশবাবুদের আবাসনটি ‘স্বর্ণখনি’ হয়ে উঠল কী ভাবে।
১৯৭৬-এ ১৩৭ বিঘে জমি নিয়ে গড়ে ওঠে নিউ গড়িয়ার ওই সমবায় আবাসন। সমবায়ে মোট ৫৫৮টি প্লট। কোনওটা তিন, কোনওটা সওয়া তিন কাঠার। আবাসন-সূত্রের তথ্য, এ পর্যন্ত সাড়ে চারশো প্লটে বাড়ি উঠেছে, ১০৮টি এখনও ফাঁকা। এ দিকে আবাসনের পায়ে হাঁটা দূরত্বে চালু হয়ে গিয়েছে মেট্রো রেলের কবি সুভাষ স্টেশন। ফলে ওই তল্লাটে জমির দাম আকাশ ছুঁয়েছে। সমবায়ের এক সদস্যের কথায়, “এখন এখানকার এক-একটা প্লটের বাজারদর কম করেও পঁয়তাল্লিশ লাখ টাকা!”
অর্থাৎ সমবায়ে প্রায় ৫০ কোটি টাকার প্লট এখনও ফাঁকা পড়ে রয়েছে। আবাসনের সদস্যদের অনেকের ধারণা, ফাঁকা প্লটগুলোর একটা বড় অংশ শিগগিরই হাতবদল হবে। এবং সেই সম্ভাব্য ‘দালালি’-র বখরা যাতে হাত ফস্কে না-যায়, সে জন্যই অম্বিকেশবাবু-সুব্রতবাবুকে হেনস্থা করা হল বলে ওঁদের অভিযোগ।
কেন? আবাসন-সূত্রের বক্তব্য: সমবায়ের নিয়ম অনুযায়ী, সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত কমিটিই প্লটের কেনা-বেচা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। বাসিন্দাদের অনেকের দাবি, বর্তমান কমিটির আমলে এলাকার সিন্ডিকেট-সদস্যেরা প্লট কেনাবেচায় বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারেনি। এক বাসিন্দার কথায়, “পূর্ত দফতরের অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার সুব্রতবাবু এবং যাদবপুরের রসায়নের অধ্যাপক অম্বিকেশবাবু কমিটির মাথায় থাকায় সিন্ডিকেট এখানে নাক গলাতে চেয়েও পারেনি। এ বার তাই ওঁদের কমিটি থেকে সরাতে উঠেপড়ে লেগেছে।” উল্লেখ্য আগামী ২০ মে আবাসন-কমিটির নির্বাচন। সুব্রতবাবু-অম্বিকেশবাবু যাতে ভোটে দাঁড়াতে না-পারেন, সেই উদ্দেশ্যেই দু’জনকে মামলায় জড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে বলে বাসিন্দাদের অনেকের দাবি।
দু’জনকে কমিটি থেকে সরানোর পিছনে সিন্ডিকেটের আরও একটি ‘উদ্দেশ্যের’ কথাও শোনা গিয়েছে। আবাসন-সূত্রের খবর: সিন্ডিকেটের দেওয়া ১৭ লক্ষ টাকার বিল অম্বিকেশবাবু-সুব্রতবাবুরা আটকে দিয়েছিলেন। তাঁদের অভিযোগ ছিল, বিলগুলো ভুয়ো। সিন্ডিকেটও বুঝে গিয়েছিল, হাউজিংয়ে নতুন কমিটি ক্ষমতায় না-এলে বিল পাশ করানো যাবে না। এই কারণেও অম্বিকেশবাবু-সুব্রতবাবুকে সরানোটা তাদের পক্ষে জরুরি হয়ে পড়েছিল বলে মনে করেছেন বাসিন্দাদের একটি মহল।
কিন্তু ১৭ লক্ষ টাকার ‘ভুয়ো’ বিল জমা পড়ল কী ভাবে? আবাসনের কোষাধ্যক্ষ কার্তিক সিংহরায় বলেন, “১৯৯৯ থেকে ২০০৫-এর মধ্যে আমাদের কো-অপারেটিভ হাউজিংয়ে আটটা বাড়ি তৈরির ইমারতি মালপত্র দিয়েছিল স্থানীয় সিন্ডিকেট।” আবাসন-সূত্রের খবর, তখনই অরূপ মুখোপাধ্যায়, নিশিকান্ত ঘড়াই, শেখ মুস্তাফারা মালের দাম বাবদ কয়েক লক্ষ টাকার বিল পেশ করেছিলেন। এ দিকে সে সময়ে আবাসনের কাজকর্ম নিয়ে নানান অভিযোগ ওঠে। এমনকী, তদানীন্তন আবাসন-কমিটির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের প্রেক্ষিতে রাজ্য ওই সমবায় পরিচালনায় প্রশাসক নিয়োগ করে। তৎকালীন সম্পাদক শান্তনু বসুকে বরখাস্ত করা হয়। সমবায়ের একটি প্লট (ডি-৮) কেনা-বেচায় দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। শান্তনুবাবু রবিবার সে অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “দুর্নীতি নয়, কাজ করতে গিয়ে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়েছিল।”
সরকার-নিযুক্ত প্রশাসকই ২০০৫ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত নিউ গড়িয়ার সমবায় আবাসনটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। ২০০৯-এর জুনের পরে কমিটির নির্বাচন হয়। তাতে পদাধিকারী হন সুব্রতবাবু-অম্বিকেশবাবু। বর্তমান সেই কমিটির চেয়ারম্যান নেপালশঙ্কর চৌধুরী বলছেন, “আমরা ক্ষমতায় আসার পরে প্রায় ১৭ লক্ষ টাকার বকেয়া বিলের জন্য পাওনাদারেরা তাগাদা শুরু করে। কিন্তু বিলগুলোর স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় কমিটি টাকা মেটায়নি।” আবাসন-সূত্রের খবর, সুব্রতবাবুরা ক্ষমতায় আসার পরেই আগের আমলের বিভিন্ন বিলের ‘অডিট’ শুরু করেছিলেন। সে কারণেও তাঁরা সিন্ডিকেটের রোষে পড়েছেন বলে বাসিন্দাদের একাংশ মনে করছেন।
আবাসনের অধিকাংশ সদস্যের বক্তব্য, অম্বিকেশবাবুর স্বচ্ছ ভাবমূর্তি রয়েছে। তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী সমবায় সমিতিরও চেয়ারম্যান। ওঁরা জানাচ্ছেন, অম্বিকেশবাবু ও সুব্রতবাবুকে সরানোর সক্রিয় উদ্যোগ শুরু হয় ক’মাস আগে। তখন আবাসনে ‘একটি পরিবর্তনের উপস্থাপনা’ শীর্ষক লিফলেট বিলি করে বলা হয়েছিল, “এই আবাসন রত্নভাণ্ডার। বর্তমান বোর্ড সে দিকে নজরদারি করছে না।” কারা ছড়িয়েছিল লিফলেট?
এর পিছনে নাম জড়িয়েছে যে সংগঠনের, সেই ‘নিউ গড়িয়া সমবায় আবাসন উন্নয়ন মঞ্চ’ এর মাধ্যমে সিন্ডিকেট-সদস্যদের নামই ফের সামনে চলে আসছে। এবং বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, অম্বিকেশবাবুদের মারধরের ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া মূল অভিযুক্ত অরূপ মুখোপাধ্যায়ই রয়েছেন সিন্ডিকেটের এই ‘দাপটের’ নেতৃত্বে। এলাকার তৃণমূল নেতা অরূপবাবুর বাড়ি অম্বিকেশবাবুদের হাউজিংয়ের ঠিক পাশে। তিনি ইমারতি দ্রব্য ও জমি-জমার কারবারী। নিশিকান্ত ও মুস্তাফাও তা-ই।
অরূপবাবুর কী বক্তব্য? অরূপবাবু সব অভিযোগ নস্যাৎ করে বলেন, “সিপিএমের স্থানীয় নেতারা আমার বিরুদ্ধে পরিকল্পিত অপপ্রচার করছেন। ওই সমবায় আবাসন-কমিটির কিছু অস্বচ্ছতা নিয়ে আমি প্রশ্ন তুলেছিলাম। তাই আমার বিরুদ্ধে লেগেছেন ওঁরা।”
কিন্তু তিনি তো আবাসনে থাকেন না! তা হলে আবাসন-কমিটির ‘অস্বচ্ছতা’ নিয়ে মাথা ঘামালেন কেন?
অরূপবাবু জবাব দেননি। |