গায়ে জড়ানো উত্তরীয়। পরনে সাদা ধুতি। কণ্ঠে হরিনাম।
মঙ্গলবার রাতে বারাসতে তৃণমূল কর্মী বিনয় বিশ্বাস-সহ একই পরিবারের তিন জনকে খুনের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত পুরনো দুষ্কৃতী প্রভাস ঢালির ইদানীং এই ছিল ‘বহিরঙ্গ’!
গাইঘাটার মানিক-হিরা গ্রামের বাসিন্দা গোপাল মাঝিকে খুনের দায়ে ন’বছর জেল খেটে বছর পঁয়তাল্লিশের প্রভাস ছাড়া পায় ২০১১-র ফেব্রুয়ারিতে। বনগাঁ, বারাসত এলাকার এক সময়ের ‘ত্রাস’ প্রভাসকে নিয়ে ‘জনশ্রুতি’, এ পর্যন্ত যত খুন-জখমে নাম জড়িয়েছে তার থেকে অনেক বেশি ‘অপরাধ’ করেছে সে। পুলিশের একাংশ এবং স্থানীয় মানুষ জানাচ্ছেন, এক সময়ে সিপিএমের ‘ছত্রচ্ছায়ায়’ থাকা প্রভাসের ইদানীং ‘ঘনিষ্ঠতা’ বেড়েছিল তৃণমূলের সঙ্গে। সে কথা অবশ্য মানেননি দু’পক্ষের কোনও নেতাই।
|
প্রভাস ঢালি। নিজস্ব চিত্র |
পুলিশ সূত্রের খবর, নব্বই দশকের মাঝামাঝি সাইকেল চুরি দিয়ে অপরাধ জগতে ‘হাতেখড়ি’ মানিক-হিরা গ্রামেরই বাসিন্দা প্রভাসের। পরে সে শুরু করে ছোটখাট চুরি-ছিনতাই। ঠাকুরগনরে এক বার ধরা পড়ে জনতার হাতে মারও খায়। ভিড়ে যায় সুটিয়া-গণধর্ষণ কাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত সুশান্ত চৌধুরী নামে এক দুষ্কৃতীর দলে। ডাকাতির বখরা নিয়ে দু’জনের বিবাদ বাধে অচিরে। সুশান্তর দলের সঙ্গে মারামারিতে চোট লেগে প্রভাসের ডান হাতের কর্মক্ষমতা কমে যায়। তবে ‘দৌরাত্ম্য’ কমেনি। গাইঘাটাকে কেন্দ্র করেই ছিল প্রভাসের ‘সাম্রাজ্য’। লোকে সে সময়ে তাকে ডাকত ‘মহারাজ’ বলে। ২০০০ সাল নাগাদ নদিয়ার গাংনাপুর থেকে শুরু করে বনগাঁ, চাঁদপাড়া, ঠাকুরনগরে প্রভাসের বিরুদ্ধে তোলাবাজি, খুন-জখমের অসংখ্য অভিযোগ উঠলেও পুলিশের কাছে বেশির ভাগ সময়েই তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পেতেন না মানুষ। তবে উত্তর ২৪ পরগনার বিভিন্ন থানায় তার নামে গোটা দ’শেক খুনের অভিযোগ আছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ-কর্তারা। গ্রামে কারও বাড়িতে বিয়ে বা অন্য কোনও অনুষ্ঠান হলেও প্রভাসকে ‘নজরানা’ দিতে হত বলে অভিযোগ। গাইঘাটার ডুমা বাওরে বড়সড় বজরা ভাসিয়ে বেশিরভাগ সময় ঘুরে বেড়াত প্রভাস। এলাকার লোক বলত ‘জাহাজবাড়ি।’ মানিক-হিরা গ্রামের নানা জায়গায় প্রভাসের সশস্ত্র সঙ্গীরা থাকত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। তাদের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ‘মাছিটুকুও’ গ্রামে ঢোকার সাহস পেত না বলে জানান এলাকার মানুষ।
তৃণমূল নেতাদের দাবি, সে সময়ে সিপিএম নেতৃত্বের একাংশের ‘মদতেই’ প্রভাসের এমন রমরমা হয়েছিল। ২০০১-এ বিধানসভা ভোটের পরে গাইঘাটার তৎকালীন তৃণমূল বিধায়ক, বর্তমানে রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের গাড়ি লক্ষ করে গুলি চালায় এক দল দুষ্কৃতী। ওই ঘটনাতেও অভিযোগ ওঠে প্রভাস ও তার দলবলের বিরুদ্ধে। ২০০২ সালের জুন মাসে খুনের দায়ে জেল হয় প্রভাসের। ন’বছর জেল খেটে বাইরে এসে গাইঘাটার গ্রামগুলিতে ফের ‘প্রভাব’ বাড়াতে থাকে প্রভাস। মানিক-হিরা গ্রামে তার এক স্ত্রী, ছেলে আছে। যদিও জেল থেকে বেরিয়ে ফের বিয়ে করে সে।
ছাড়া পাওয়ার মাস চারেকের মধ্যেই বনগাঁ আদালত চত্বর থেকে গুলি-ভর্তি পাইপগান-সহ পুলিশ প্রভাসকে ধরে। তবে ওই মামলায় জামিন পেয়ে গাইঘাটার পাশাপাশি আরও কিছু জায়গায় আস্তানা গাড়ে সে। বিরাটি, বাগুইআটি ছাড়াও বারাসতের কেমিয়া খামারপাড়া পঞ্চায়েতের নওপাড়াতেও ডেরা গাড়ে। সেখানে কিছু আত্মীয়ের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল প্রভাসের। সেই সুবাদেই কেমিয়া খামারপাড়ায় জমি কেনাবেচার ব্যবসায় দ্রুত ঢুকে পড়ে সে। কিছু সঙ্গী জুটিয়ে বারাসতে নামগানের দলও গড়ে। ওই এলাকায় তার পরিচিতি ছিল ‘পুরোহিত’ নামে। নওপাড়ার অনেকেই বললেন, “লোকটার ব্যবহার ভাল। গানের গলাও বেশ ভাল। কিন্তু ওর সম্পর্কে নানা কথা শোনা যায়। তাই চট করে কেউ ওর কাছে ঘেঁষতে চাইত না।” |