বাবা, মা-সহ খুন তৃণমূল কর্মী, ফের কাঠগড়ায় জমির দালালি
দুষ্কৃতী হানায় আবার উত্তপ্ত বারাসত সংলগ্ন এলাকা। এ বার ঘটনাস্থল বারাসত থানার কেমিয়া খামারপাড়া পঞ্চায়েতের নওপাড়া গ্রাম। অভিযোগ, মঙ্গলবার রাতে গুলি করে, কুপিয়ে, বোমা মেরে সেখানে এক তৃণমূল কর্মীকে খুন করে জনা দশেক দুষ্কৃতীর একটি দল। তাঁকে বাঁচাতে এসে নৃশংস ভাবে খুন হন বৃদ্ধ মা-বাবাও। গুলিতে গুরুতর জখম হন ওই তৃণমূল কর্মীর স্ত্রী। বুধবার বিকেলে এক জনকে ধরেছে পুলিশ। মূল অভিযুক্ত প্রভাস ঢালি-সহ বাকিরা ‘ফেরার’ বলে জানিয়েছেন উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার চম্পক ভট্টাচার্য।
স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ দাবি করেছেন, জমির ‘দালালি নিয়ে বিবাদের’ জেরেই খুন হলেন তৃণমূল কর্মী বিনয় বিশ্বাস (৪০), তাঁর বাবা অমৃত বিশ্বাস (৭০) এবং মা তাপসী বিশ্বাস (৬০)। যদিও খুনের কারণ নিয়ে পুলিশ এখনও ধন্দে। জেলার পুলিশ সুপার বলেন, “তদন্ত চলছে।” স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের আরও দাবি, তৃণমূলের দুই ‘গোষ্ঠী’ এই ঘটনায় যুক্ত। একই দাবি সিপিএমেরও।
বারাসত হাসপাতালে নিহত বিনয় বিশ্বাসের স্ত্রী শিউলিদেবী।
বুধবার নওপাড়া গ্রামে যান তৃণমূল নেতা তথা রেলমন্ত্রী মুকুল রায়। ‘জমির দালালিকে কেন্দ্র করে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের’ অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে তিনি ‘সিপিএম-আশ্রিত দুষ্কৃতী’দেরই এই ঘটনায় দায়ী করেছেন। মুকুলবাবুর কথায়, “বিনয় আমাদের দলের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। প্রতিবাদী চরিত্র। সে কারণেই সিপিএম-আশ্রিত সমাজবিরোধীরা এই নারকীয় কাণ্ড ঘটাল।” অভিযোগ অস্বীকার করে জেলা সিপিএম নেতা অমিতাভ নন্দী বলেন, “জমিজমা নিয়ে তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর বিবাদের জেরেই খুন। যাদের নামে অভিযোগ উঠছে, তারা আমাদের পঞ্চায়েতগুলি একের পরে এক দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে।”
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, মঙ্গলবার খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়ে পড়েছিলেন বিনয়বাবুরা। বিনয়বাবুর স্ত্রী শিউলি বিশ্বাস পুলিশকে জানিয়েছেন, রাত ১১টা নাগাদ প্রবল শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তাঁর। শিউলিদেবীর অভিযোগ, কাঠের দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে খুব কাছ থেকে বিনয়বাবুকে গুলি করে প্রভাস ঢালি ও তার লোকজন। রক্তাক্ত বিনয়কে ঘর থেকে টেনে বার করার চেষ্টা করে আততায়ীরা। বাধা দিতে গেলে গুলি করা হয় শিউলিকে। ভোজালি দিয়ে কোপানোও হয়। পাশের ঘর থেকে ততক্ষণে ছুটে এসেছেন বিনয়ের বাবা অমৃতবাবু। দুষ্কৃতীরা তাঁর মাথা তাক করে গুলি করে। বিনয়বাবুর মা তাপসীদেবীকে বাঁশের ঘা মেরে মাটিতে ফেলে দেয় এক জন। তারপরে কাছ থেকে গুলি করে। পাশের ঘরে ছিল বিনয়বাবুর বড় ছেলে বছর তেরোর বিশ্বজিৎ। বিপদ বুঝে বাড়ির পিছন দিয়ে সে পালায় লাগোয়া মাঠের দিকে। ছোট ছেলে বছর দশেকের অভিজিৎকে নিয়ে কোনও মতে পালিয়ে যান শিউলিও। পুলিশ সূত্রের খবর, বাড়ির সামনে তখন বেশ কয়েকজন সশস্ত্র দুষ্কৃতী ‘পাহারায়’ ছিল। বিনয়কে টেনে-হিঁচড়ে বাড়ির বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। পাশের মাঠে ফেলে একপ্রস্ত কোপানো হয়। ফের গুলি করা হয়। তার পরে বোমা মেরে ঘটনাস্থলেই খুন করা হয় ওই তৃণমূল কর্মীকে।
বিনয়বাবুর দুই ছেলে বিশ্বজিৎ ও অভিজিৎ।
গ্রামবাসীদের অনেকে এ দিন জানান, রাতে যে ‘তাণ্ডব’ চলেছে, তা টের পেয়েছিলেন। কিন্তু এগিয়ে আসার সাহস করেননি। ভোরের দিকে অভিজিৎ কাঁদতে কাঁদতে হাজির হয় বিনয়ের বাড়ির উল্টো দিকেই স্মৃতিকণা অধিকারীর বাড়িতে। তিনি স্থানীয় পঞ্চায়েতের তৃণমূলের উপপ্রধান। স্মৃতিকণাদেবী জানান, তাপসীদেবীর দেহে প্রাণ ছিল না। অমৃতবাবু তখনও বেঁচে। বারাসত হাসপাতালের পথেই মারা যান বৃদ্ধ। পরে মাঠ থেকে বিনয়বাবুর ক্ষতবিক্ষত দেহ মেলে। শিউলিদেবীকে ভর্তি করানো হয় বারাসত হাসপাতালে। তাঁর বা হাতে গুলি লেগেছে। দু’হাতেই ধারালো অস্ত্রের ক্ষত।
শিউলির অভিযোগ, “কত অনুরোধ করলাম। বললাম, ‘স্বামীকে ছেড়ে দাও’। কিছুই শুনল না। প্রভাস আর তার লোকজন চোখের সামনে স্বামীকে গুলি করে দিল। শ্বশুর-শাশুড়িকেও মারল।” বিশ্বজিৎ বলে, “মনে হচ্ছিল, ওরা আমাদের সবাইকে মারবে। আমি ছুটে পালাই। ওরা আমার দিকেও গুলি চালিয়েছিল। লাগেনি। সারারাত লুকিয়ে ছিলাম দূরের মাঠে।” কিন্তু কেন এই খুন?
রাজারহাট-নিউটাউন থেকে কেমিয়া-খামারপাড়া এলাকার দূরত্ব বড়জোর ১০ কিলোমিটার। এখন এই অঞ্চলে জমি কিনতে শুরু করেছে ছোট-বড় নানা সংস্থা। জমির দামও বাড়ছে হু-হু করে। স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ জানাচ্ছেন, কিছু রাজনৈতিক নেতাও ‘জড়িয়েছেন’ জমি কেনাবেচায়। পুলিশ সূত্রের খবর, জমি কেনাবেচার
বিনয় বিশ্বাস।
‘দালালি’তে জড়িয়ে পড়েছিলেন বিনয়বাবুও। এক সময় নওপাড়া গ্রামে তাঁর একটি চায়ের দোকান ছিল। ভ্যানে ঘুগনি-রুটিও বিক্রি করতেন। কিন্তু কয়েকমাস হল টালির ছাউনি দেওয়া মাটির বাড়িতে মার্বেল বসানো ঘর বানাচ্ছিলেন তিনি। স্থানীয় সূত্রের দাবি, হাতে আসা ‘কাঁচা টাকা’ নিয়ে তৃণমূলের অন্য একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে বিনয়ের ‘বিরোধ’ বাধে। তৃণমূলের সেই গোষ্ঠীর সঙ্গেই ‘ওঠাবসা’ করতে দেখা যেত প্রভাস ঢালি ও তাঁর সঙ্গীদের। মাস তিনেক আগে এক বার প্রভাসের সঙ্গে বিনয়ের ‘হাতাহাতি’ হয়। ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে সে দিনও চোট পেয়েছিলেন বিনয়ের বাবা অমৃতবাবু। মাসখানেক আগে প্রভাসের লোকজন একটি বিয়েবাড়িতে ফের ‘চড়াও’ হয় বিনয়ের উপরে। সে বারও বেঁচে যান বিনয়। দিনকয়েক আগে এলাকায় ১৬ বিঘা একটি জমির বিক্রি নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছিল। বুধবারই জমির মালিকের সঙ্গে ‘আলোচনা’য় বসার কথা ছিল দু’পক্ষের।
এই ‘তত্ত্ব’ খারিজ করে দিয়ে শিউলির দাবি, “এলাকায় প্রভাসের মতো লোকেরা ঢুকে খারাপ কাজ করছিল। তৃণমূলের নেতাদের সে কথা জানিয়েছিলেন আমার স্বামী। সেই আক্রোশেই হামলা হল আমাদের পরিবারের উপরে।”

সুদীপ ঘোষের তোলা ছবি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.