নয়া জমানায় নিজেদের একটা মর্যাদা আশা করেছিলেন
নন্দীগ্রামের মানুষ। কী পেলেন? লিখছেন বোলান গঙ্গোপাধ্যায় |
বার্ধক্য ভাতা-টা অবধি পাইনি’ দু’একটা কথা বলতে না বলতেই চোখে জল চলে আসে নর্মদার। ক্রমবর্ধমান বাজার দরের সঙ্গে তাল মেলাতে সাত জনের সংসার নিয়ে হিমশিম এই বৃদ্ধা। নন্দীগ্রামের সোনাচূড়ার নর্মদা শীট। জীবিকা পানবিড়ির দোকান চালানো। ২০০৬-০৭’এ তাঁর নাম প্রতিদিন বেরিয়েছে কোনও না কোনও সংবাদপত্রে, জাতীয় বৈদ্যুতিন মাধ্যমে শোনা গেছে তাঁর সাক্ষাৎকার। এখন অবশ্য এলাকার সাংসদ ছাড়া আর কেউ তেমন পোঁছে না। সাংসদ ব্যক্তিগত ভাবে তাঁকে অর্থসাহায্যও করেন। না, কোনও রকম ব্যক্তিগত স্বার্থ থেকে নর্মদা আন্দোলনে যাননি বলে এখনও দৃঢ় ভাবে জানান। গিয়েছিলেন একটা বড় অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। পরিবর্তন চেয়েছিলেন, যদিও এক সময়ে তিনি লক্ষ্মণ শেঠের ডাকে সিপিএমের মিটিং-মিছিলেও গেছেন। কিন্তু তাই বলে সিপিএমের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে তাঁর বাধেনি। এখনও পরিবর্তিত সরকারের, শাসক পার্টির অন্যায় দেখলেও বলবেন। নর্মদা গড়গড় করে বলেন পঞ্চায়েতের নানা দুর্নীতির কথা। সিপিএমের সুযোগসন্ধানীরা কেমন করে এখনকার শাসক পার্টিতে ঢুকে খবরদারি চালাচ্ছেন, সেই কথা।
আন্দোলনের আর এক মুখ রাধারানি আড়ি। মেধা পাটকরের সঙ্গে কথা বলার অপরাধে তাঁর স্বামীকে লক্ষ্মণ শেঠের লোকেরা মারধর করেছিল। রাধারানীর ছেলে চাকরি পেয়েছেন মেট্রো রেলে। শাসক পার্টি সম্বন্ধে রাধারানীর অভিযোগ নেই। কেবল বলেন, ‘একটু সময় লাগবে।’
এ গ্রাম থেকে ও গ্রাম, এ পাড়া থেকে সে পাড়া চাপা একটা ক্ষোভের আঁচ সহজেই টের পাওয়া যায়। এক সময় সমস্ত রাজনৈতিক দলকে নিয়ে তৈরি হয়েছিল ‘ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি’। তখন নন্দীগ্রামে যা-কিছু হয়েছে, তা প্রতিরোধ কমিটির নামেই হয়েছে। কোনও রকম রাজনৈতিক দলের ব্যানার, ফেস্টুন, স্লোগান ব্যবহার করা হয়নি। পরে যথা নিয়মে সেই কমিটির কার্যকারিতা আর থাকেনি। গোটাটাই শাসক দলের আওতায় চলে গেছে। ‘ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি’-তে ছিলেন, এমন এক তৃণমূল কর্মী বলেন, ‘যে ভাবে তখন সবাইকে নিয়ে কাজ হয়েছে, যদি তেমনটা রাখা যেত, নন্দীগ্রামের চেহারা অন্য রকম দেখতেন।’
১৪ মার্চ পায়ে গুলি লেগে পিজি হাসপাতালে ছিলেন মণি রাণা। এখন বাইশ বছর বয়স। পিজি’র সার্টিফিকেট আছে। সেখানকার আহতদের তালিকাতেও নাম আছে। কিন্তু পুরনো সরকারের আমলে সম্ভবত ভুলবশত তাঁর নামটি ক্ষতিপূরণের সরকারি তালিকা থেকে বাদ গিয়েছিল। নতুন সরকার আসার পর নিজের নামটি তালিকাভুক্ত করতে, ক্ষতিপূরণ বাবদ অর্থসাহায্য পেতে জুতোর সুখতলা খুইয়ে ফেলেছেন মণির অভিভাবক, কিন্তু কাজের কাজ হয়নি। অমল রাণার (অভিভাবক) গলায় ক্ষোভ ঝরে পড়ে। ‘কী বলব, এখন আর নেতারা আমাদের চিনতে পারে না।’
এই অভিযোগ নন্দীগ্রামের ঘরে ঘরে। যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, তাঁরা তবু শহিদ পরিবারের মর্যাদা পেয়েছেন। কিন্তু যাঁরা আন্দোলনে ছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই আশা করেছিলেন যে নতুন সরকার নন্দীগ্রামের মানুষের দাবিকে অগ্রাধিকার দেবে। কারণ তাঁরা মনে করেন, যদি নন্দীগ্রামের ঘটনা না ঘটত, তা হলে সরকার বদল এত সহজে হত না। স্থানীয় শাসক দলের নেতাদের কথাও এই ক্ষোভে ধরা পড়ে। সিঙ্গুরের সঙ্গে তুলনা টেনে স্থানীয় নেতা বলেন, ‘সিঙ্গুর মন্ত্রিসভায় যে মর্যাদা পেয়েছে, নন্দীগ্রাম সেই তুলনায় কী পেয়েছে? কিছুই না। সরকারের নীতি-নির্ধারণে নন্দীগ্রামের কোনও ভূমিকাই নেই। অথচ থাকা উচিত ছিল।’ অনেকেরই অভিযোগ, রাজনীতিটাই চলছে ‘পাইয়ে দেওয়া’র নীতির ওপর ভর করে। ফলে, এক দিকে আঙুল ফুলে কলাগাছ, অন্য দিকে প্রবঞ্চিত বোধ করার কাহিনি। কথা দিয়ে কথা না রাখার দায় কেবল সরকার বা শাসক দলের নয়। কলকাতার বিশিষ্টজনেরা সোনাচূড়ায় শহিদ স্মৃতিতে হাসপাতাল গড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। নন্দীগ্রামবাসীরা জানেন না কী হল সেই প্রতিশ্রুতির।
নন্দীগ্রামের মানুষ ধীরে ধীরে লক্ষ্মণ শেঠকে তৈরি হতে দেখেছেন। দেখেছেন একটি বাম দল কী ভাবে ‘পাইয়ে দেওয়ার’ রাজনীতির শিকার হয়ে কায়েমি স্বার্থের প্রতীক হয়ে ওঠে। সেই ছায়াই বর্তমান শাসক দলের কার্যকলাপে পড়তে দেখে তাঁরা শঙ্কিত বোধ করেন। ‘গণতান্ত্রিক পরিবেশে সুষ্ঠু প্রশাসন চেয়েই কিন্তু এত কাণ্ড, তাই না?’ নিজের অভিজ্ঞতার সমর্থন খোঁজেন সাধারণ এক গ্রামবাসী। নিজেদের প্রবঞ্চিত হওয়ার কথা বলতে বলতে বলেন, ‘পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি করতে গিয়ে কিন্তু সিপিএম তাল রাখতে পারেনি। একই জিনিস যদি এই সরকারও করে, তা হলে তাকে ভালই বা বলি কী করে, পরিবর্তনই বা বলি কী করে!’ |