প্রবন্ধ ১...
জারদারির সফরে দ্বিপাক্ষিক কূটনীতির বরফ গলবে কি
বাবা প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারির অন্যতম সফরসঙ্গী তেইশ বছর বয়সি বেনজির-তনয় বিলাবল জারদারি ভুট্টো আন্তর্জালে তাঁর অনুসমর্থকদের জানিয়েছেন যে, তাঁর প্রয়াত মা বলতেন, প্রত্যেক পাকিস্তানির মধ্যে এক টুকরো ভারত রয়ে গিয়েছে, আর প্রত্যেক ভারতীয়ের মধ্যে রয়েছে এক টুকরো পাকিস্তান। সম্ভবত সেই কারণেই দেশভাগের পঁয়ষট্টি বছর পরেও এবং পরস্পরের মধ্যে একাধিক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সত্ত্বেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য নিতান্তই ব্যক্তিগত তীর্থভ্রমণে ভারতে এলে তা সংবাদের শিরোনাম হয়, আর সেই সফরকে কেন্দ্র করে দুই দেশের কূটনীতিক তৎপরতাও তুঙ্গে ওঠে। সাত-সাত বছর বাদে যদি এই পড়শি দেশের কোনও প্রেসিডেন্ট ভারতের মাটিতে পদার্পণ করেন, তা হলে এমনটা হওয়াটাই তো দস্তুর!
এই সাত বছরে ভারত ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে শর্ম অল শেখ, সোল অথবা মলদ্বীপ কোথাও না কোথাও, কোনও না কোনও আন্তর্জাতিক অথবা আঞ্চলিক সম্মেলন উপলক্ষে দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে। কথাবার্তাও হয়েছে। কিন্তু কূটনীতির চিড়ে ভেজেনি তাতে। বস্তুত, ২০০৮ সালে ভারতের বাণিজ্যনগরী মুম্বইতে দুঃসাহসিক সন্ত্রাসবাদী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে দুই দেশের সম্পর্ক প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছিল। ৯/১১-এর অব্যবহিত পরে, আজ থেকে দশ বছর আগে লস্কর-ই-তইবা নামক জঙ্গি সংগঠনটি পাকিস্তানে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল বটে। মার্কিন প্রশাসনের রোষবহ্নি থেকে এ ভাবে বাঁচবার উপায় ইসলামাবাদ খুঁজলেও অচিরেই লস্করের সমর্থকরা জামাত-উদ্-দাওয়া নামক একটি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। ঘটনাচক্রে, লস্কর প্রতিষ্ঠাতা হাফিজ আলি সৈয়দ এই নতুন সংগঠনটির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। মুম্বই হামলায় তাঁর যুক্ত থাকবার অভিযোগ নয়াদিল্লির তরফে বার বার পাকিস্তানের কাছে করা হলেও ইসলামাবাদ এ-যাবৎ নির্বিকারই থেকেছে। আর, হাফিজ পাক ভূখণ্ডেও সদর্পে তাঁর কার্যকলাপ চালিয়ে গিয়েছেন। এই প্রেক্ষাপটেই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ সাম্প্রতিক অতীতে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন যে, সন্ত্রাস দমনে পাকিস্তান হাতেকলমে কিছু করে দেখালে তবেই তিনি ইসলামাবাদ সফরে যাবেন। তাই, জারদারির তীর্থপথে ভারত-পাক বাণিজ্যিক সম্ভাবনা উজ্জ্বলতর হওয়ায় এই সফর উভয় দেশেই নজর কেড়েছে।

সন্ত্রাসের কাঁটা পেরিয়ে দ্বিপাক্ষিক স্তরে উত্তেজনা প্রশমনের এই প্রয়াস নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। মনমোহন-জারদারির চল্লিশ মিনিটের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে হাফিজ প্রসঙ্গ উঠেছে। উঠেছে সিয়াচেন হিমবাহ, স্যার ক্রিক কিংবা কাশ্মীর প্রসঙ্গও। এই সব দীর্ঘমেয়াদি ও বিতর্কিত বিষয়ে দুই দেশের নেতৃবৃন্দের কোনও সমঝোতার ইঙ্গিত মেলেনি এই বৈঠক থেকে, কিন্তু আশ্বাস মিলেছে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের বিস্তার প্রসঙ্গে।
অতিথি। বিলাবল জারদারির ভুট্টোর (বাঁ দিকে) সঙ্গে আসিফ আলি জারদারি। দিল্লি, এপ্রিল ’১২
যেমন ভাবে গত শতাব্দীর পাঁচ ও ছয়ের দশকে দীর্ঘকালীন পারস্পরিক বৈরিতার ইতিহাসকে পিছনে ফেলে পশ্চিম ইউরোপের একাধিক দেশ বহুপাক্ষিক স্তরে অর্থনৈতিক সহযোগিতার পথে পা বাড়িয়েছিল, বা বিগত কয়েক বছরে দ্বিপাক্ষিক সীমান্ত সমস্যা মেটাবার ব্যাপারে ভারত ও চিন (উল্লেখযোগ্য কোনও অগ্রগতি ঘটাতে না পারলেও) পারস্পরিক বাণিজ্যের পরিমাণ ধাপে ধাপে বাড়িয়ে যেমন ভাবে তুঙ্গস্পর্শী করতে পেরেছে, অনেকটা সেই আদলেই দক্ষিণ এশিয়ার চির-বৈরী দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী এ বারে যেন সহযোগিতার নতুন অধ্যায়ের সূচনায় উদ্যোগী।
প্রসঙ্গত, জারদারির ভারত-সফর শেষে পাক প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি তাঁর বাসভবনে বসে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন যে, চিনের নেতারাই এই পথে এগোবার পরামর্শ ইসলামাবাদকে দিয়েছিলেন। আবার, আমেরিকার বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্রের মুখেও এই বৈঠক সম্পর্কে প্রশস্তি শোনা গেছে।
অথচ, তাঁর ঝটিকা সফরে নয়াদিল্লি ও আজমেঢ়ে আসবার আগে জারদারি নাকি দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় যাতে হাফিজ প্রসঙ্গ না উত্থাপিত হয়, সে দিকে লক্ষ্য রাখবার বিষয়ে দেশের সেনা ও গোয়েন্দা কর্তাদের দ্বারা সতর্কিত হয়েছেন। এ দিকে, পাকিস্তানে মুম্বই-হামলার ষড়যন্ত্রকারীদের বিচারের বিষয়ে দীর্ঘসূত্রিতার পরিপ্রেক্ষিতে মনমোহনের পক্ষেও সাহসী পদক্ষেপ করা দুরূহ ছিল। এর পরেও কিন্তু তীর্থ-কূটনীতির নবতম এই সোপানের মাধ্যমে নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদ নিজেদের অসেতুসম্ভব অন্তরায়কে অতিক্রম করতে পিছপা হয়নি।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোতে সেনাবাহিনী এখনও সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান বলে বিবেচিত। কিন্তু, এক দিকে বোতলবন্দি তালিবানি দৈত্যকে মুক্তি দিয়ে সেনাবাহিনী নাজেহাল হয়েছে, আর অন্য দিকে খাইবার পাখতুনখোয়া, বালুচিস্তান বা দেশের অন্যত্র সন্ত্রাস দমনের নামে বার বার নিজের দেশের নাগরিকদের মুখোমুখি হয়ে সেনাকর্তারা নিজেদের বহুচর্চিত গ্রহণযোগ্যতা অনেকটা হারিয়েছেন। মুশারফ-উত্তর যুগে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের উল্লেখযোগ্য প্রসার ঘটেছে, এমন হয়তো নয়। কিন্তু জনমানসে সেনাবাহিনী সম্পর্কে অগাধ আস্থায় চিড় ধরায় পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)-র নড়বড়ে সরকারও এ-যাবৎ অটুট। ইমরান খানের চাঁচাছোলা বিরূপ মন্তব্য সত্ত্বেও এটা বাস্তব।
ভুললে চলবে না যে, ইসলামাবাদের বর্তমান নির্বাচিত সরকার যদি শেষ পর্যন্ত তার কার্যকালের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারে, তা হলে তা জুলফিকার আলি ভুট্টো সরকারের পরে পাকিস্তানে এক নজির সৃষ্টি করতে পারে। আর, এমনটা হলে পিপিপি ও ভুট্টো পরিবারের পক্ষে তা বিশেষ কৃতিত্বেরই হবে।
সম্প্রতি একাধিক ভয়াবহ সন্ত্রাসী হানায় দীর্ণ পাকিস্তান আন্তর্জাতিক আর্থিক মন্দায় দক্ষিণ এশিয়ার সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। দেশের মহার্ঘ খনিজ সম্পদ ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ভাণ্ডার বলে পরিচিত ও ভৌগোলিক অবস্থানগত ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ বালুচিস্তানের বিদ্রোহ সে ভাবে না আনতে পারায় পাকিস্তানের বিদ্যুৎ সঙ্কট ইদানীং অত্যন্ত তীব্র। বড় কলকারখানাগুলিও এর শিকার। এই প্রেক্ষাপটে ভারত তার নর্দার্ন গ্রিডের মাধ্যমে পড়শিকে কিছু বিদ্যুৎ রফতানি করতে পারলে আসন্ন নির্বাচনের সাপেক্ষে ইসলামাবাদের ক্ষমতাহীন দলের কাছে তা আশার সঞ্চার করতে বাধ্য।
আট্টারি-ওয়াঘা সীমান্তে নতুন বাণিজ্যপথ, ভিসা ব্যবস্থার আপেক্ষিক ও আংশিক উদারীকরণ, আগামী কয়েক দিনে দিল্লির প্রগতি ময়দানে পাকিস্তানের নানা পণ্যসামগ্রীর অভূতপূর্ব প্রদর্শনী ছোট-বড় এই সব পদক্ষেপ দুই দেশের পারস্পরিক আস্থা বাড়াতে অনেকটাই সক্ষম হতে পারে। ওয়াশিংটনের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক বিগত পাঁচ দশকে কখনওই তো এত চরম সংকটে পড়েনি। প্রতিবেশীর এই দুর্দিনে তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়ানোর এই সুবর্ণসুযোগ নয়াদিল্লি হাতছাড়া করতে চায়নি। ঝুঁকি নিয়েও সহযোগিতার পথে পা ফেলেছে।

ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ওঠাপড়া সম্পর্কে অবহিত যে কোনও ব্যক্তির মনে পড়বে লাহৌর বাস-কূটনীতির পরেই কার্গিল যুদ্ধের কথা। মনে পড়বে ২৬/১১-র কথা। দাবি উঠবে ষড়যন্ত্রীদের শাস্তির। দীর্ঘমেয়াদি শান্তির জন্য জরুরিও তা। আবার, ঘটবে কথার খেলাপও। কোনও সরলরেখায় তো এই সম্পর্ককে বিচার করা যাবে না।
পাকিস্তানের সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্কের বিচারে চাই সে দেশের রাষ্ট্র-কাঠামোর বিশ্লেষণ। মনে রাখা দরকার সে দেশের নীতি নির্ধারণে সেনাবাহিনী ও মোল্লাতন্ত্রের বিশেষ অবস্থানের কথাও। তাই, জারদারির সফরের প্রাপ্তি সম্পর্কে উচ্ছ্বাস অনভিপ্রেত। কিন্তু, পড়শির সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের এমন সুযোগ তো পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা! বাকি দু’আনার সন্ধান মিলবে কি না, বলবে আগামী দিন।

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.