১৭ই রায় নরওয়ে আদালতে
‘জীবনটা একেবারে শেষ’, তবু সন্তানদের পেতে মরিয়া অনুরূপ
ড়াইটা কুরে কুরে শেষ করে দিচ্ছে মধ্য তিরিশের যুবকটিকে। বললেন, “জানেন, প্রায় আশি জন লোককে দিনেদুপুরে খুন করেও অ্যান্ডার্স ব্রেভিক হয়তো এ দেশে পার পেয়ে যাবে। কিন্তু বাচ্চাদের ব্যাপারে পান থেকে চুন খসলেই হল! নরওয়েতে সেই বাবা-মায়ের আর নিস্তার নেই!”
অনুরূপ ভট্টাচার্য তা টের পেয়েছেন নিজের জীবন দিয়ে। কুলটির এই বঙ্গসন্তান নিজের দুই শিশুসন্তান অভিজ্ঞান আর ঐশ্বর্যাকে নরওয়ের শিশুকল্যাণ বিভাগের হেফাজত থেকে ছাড়িয়ে আনতে যে দৌড়ঝাঁপ করে চলেছেন, আর তা নিয়ে অসলো আর দিল্লির মধ্যে যে কূটনৈতিক হাঙ্গামা চলছে, এত দিনে তা মোটামুটি সবারই জানা।
নরওয়ের স্ট্যাভাঙ্গারে শহরতলির একটা ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে ইস্টারের ছুটির শুনশান মহল্লায় যে অনুরূপ ভট্টাচার্যকে দেখলাম, ক্লান্তি আর উৎকণ্ঠা তাঁর জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছে দশটা বছর। ডায়াবেটিস ধরেছে, আরও নানা শারীরিক সমস্যায় জেরবার এই যুবককে ঘনঘনই ছুটতে হয় ডাক্তারের কাছে। বাচ্চাদের নিয়ে ঝড়ঝাপ্টার আঁচ লেগেছে সাংসারিক জীবনেও স্ত্রী সাগরিকার সঙ্গে সম্পর্কটা যে স্বাভাবিক নেই মোটেই, চাইলেও লুকোতে পারেন না সেটা। কয়েক সপ্তাহ হল স্ত্রী ফিরে গিয়েছেন। অনুরূপ যত দূর জানেন সাগরিকা রয়েছেন কলকাতার উল্টোডাঙায় তাঁর বাপের বাড়িতে। ছোট ভাই অরুণাভাসকে নিয়ে স্ট্যাভাঙ্গারের বাড়ি আগলাচ্ছেন অনুরূপ আর দিন গুনছেন কবে নরওয়ের আদালত তাঁর ছেলেমেয়েকে তুলে দেবে কাকার হাতে।
সব ঠিকঠাক থাকলে ১৭ এপ্রিলই হয়তো এসে যাবে সেই রায় কাকা অরুণাভাসকে বৈধ অভিভাবকের স্বীকৃতি দিয়ে অনুরূপ-সাগরিকার দুই ছেলেমেয়েকে তাঁর হাতে তুলে দিতে বলবে আদালত। এ ব্যাপারে যে হলফনামা দরকার, বিস্তর জলঘোলার পর স্বামী-স্ত্রী দু’জনেরই সম্মতি মিলেছে তাতে। ভারত সরকারও যে তা মানতে রাজি, হলফনামায় তা জানিয়ে সই করেছেন অসলোয় ভারতীয় রাষ্ট্রদূতও। সেই হলফনামার প্রতিলিপি এখন যখের ধনের মতো বুকে করে আগলাচ্ছেন দুই ভাই। সদ্যপরিচিত অতিথিকেও, সেটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “এর পর আর তো কোনও সমস্যা নেই, বলুন?”
কাগজে-কলমে হয়তো সমস্যা নেই। কিন্তু দেশটা যখন নরওয়ে, তখন বোধ হয় না আঁচালে বিশ্বাস নেই!
সন্তানদের ফাঁকা খাটের সামনে বাবা। ছবিটি ঋজুলা ঘোষ মুখোপাধ্যায়ের তোলা।
প্রায় বছর ঘুরতে চলল। যে ভাবে মে মাসের এক বিকেলে এই প্রবাসী দম্পতির ছেলেমেয়েকে প্রায় ‘ছিনতাই’ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তা ভাবলে এখনও শিউরে ওঠেন অনুরূপ। ছেলে অভিজ্ঞানের কিছু কিছু আচরণ নিয়ে শিশুকল্যাণ বিভাগের সঙ্গে বাবা-মায়ের আলোচনা, কাউন্সেলিং ইত্যাদি চলছিলই। গত বছরের ১১ মে এমনই একটা ‘হোম ভিজিট’-এ এসেছিলেন শিশুকল্যাণ বিভাগের তিন আধিকারিক। কথাবার্তার ফাঁকে এদেরই এক জন “একটু বাইরে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি” বলে বেরিয়ে যান পাঁচ মাসের ঐশ্বর্যাকে নিয়ে। খানিক বাদে বাকি দু’জন জিজ্ঞেস করেন, “আপনাদের মেয়ে যদি আর ফিরে না আসে, আপনারা কী করবেন?”
অনুরূপ স্তম্ভিত। সাগরিকাও প্রায় মূর্চ্ছা যাওয়ার উপক্রম। পরে জানতে পারেন, ছেলে অভিজ্ঞানকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছে কিন্ডারগার্টেন থেকেই! দু’বছর আর পাঁচ মাস বয়সী দুই শিশুর ঠাঁই হয় দু’টি নরওয়েজীয় পরিবারে। আর অনুরূপদের জন্য বরাদ্দ হয় সপ্তাহে মাত্র এক বার দেখা করার সুযোগ, পরে যেটা নেমে আসে বছরে মাত্র তিন ঘণ্টায়। ব্যস, ভট্টাচার্য দম্পতির আইন-আদালত-উকিল, সংবাদমাধ্যম থেকে মন্ত্রী সামলানোর ঝক্কি আর ব্যক্তিগত অশান্তির পালা সে দিন থেকেই শুরু। আজও তার রেশ চলছে।
ঠিক কী কারণে বাচ্চাদের কেড়ে নেওয়া হল, গোপনীয়তার দোহাই দিয়ে নরওয়ে সরকার সেটা জানাতে বাধ্য নয়। কিন্তু যেটা গোপন নয়, তা হল হাজার হাজার বাচ্চাকে প্রতি বছর এ ভাবেই নানা কারণে নরওয়ে সরকার বাবা-মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে পালক পরিবারে (ফস্টার ফ্যামিলি) দিয়েছে। এই পরিবারগুলোর মাসিক আয় ২৬০০০ ক্রোনার (প্রায় দু’লক্ষ ভারতীয় টাকা), সঙ্গে বিস্তর সুযোগ সুবিধে। আর বাচ্চার যদি অটিজম থাকে (যে প্রবণতা অভিজ্ঞানেরও আছে বলে অনুরূপের বক্তব্য) তা হলে তো কথাই নেই, টাকার অঙ্কটা আরও কয়েক গুণ! সেই জন্যই নরওয়েতে চাকরিবাকরি ছেড়ে ‘ফস্টারিং’কে পুরোদস্তুর পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন অনেকেই।
তবে অনুরূপকে নরওয়ের শিশুকল্যাণ বিভাগ ঠারেঠোরে একটা কথাই জানিয়েছে, তাঁদের বাচ্চারা মায়ের সঙ্গে ‘কানেক্ট’ করতে পারছিল না এটাই নাকি অভিজ্ঞান আর ঐশ্বর্যাকে নিয়ে নেওয়ার প্রধান কারণ। এই মূল্যায়নের সঙ্গে অনুরূপ কতটা একমত তা সরাসরি ভাঙলেন না। গোটা ঘটনায় তিনি নিজেকে কতটা দায়ী করেন, এড়িয়ে গেলেন সে জবাবও। তবে যত যা-ই হোক, এটা যে বাচ্চাদের বাবা-মায়ের কোলছাড়া করার যুক্তি হতে পারে না, সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই অনুরূপের।
স্ট্যাভাঙ্গারের নরডিলায় অনুরূপদের ফ্ল্যাটে দেখা হয়নি সাগরিকার সঙ্গে। তবে যত দূর জানি তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা মানসিক সমস্যার অভিযোগ জোরালো ভাবে অস্বীকার করেছেন সাগরিকা ভট্টাচার্য। হয়তো তিনি ঠিক। কিন্তু ওই স্যাঁতস্যাতে জনবিরল, বাঙালি বিবর্জিত শহরটায় টানা তিন দিন কাটিয়ে মনে হচ্ছিল, এক জন আটপৌরে বাঙালি গৃহবধূর এই শহরে চার দেওয়ালের মধ্যে মাথা ঠিক রাখতে পারাটাই তো অস্বাভাবিক ব্যাপার!
বছর চল্লিশেক আগেও স্ট্যাভাঙ্গার ছিল ছোট একটা মাছধরা বন্দর। সার্ডিন আর স্যামনের ঝাঁক ধরে দিন চলত মোটামুটি। সত্তরের দশকের গোড়ায় নর্থ সি-র বুকে তেল মিলতেই কপাল ফেরে স্ট্যাভাঙ্গার আর নরওয়ের। অজস্র ‘অফ শোর অয়েল রিগ’-এর সুবাদে স্ট্যাভাঙ্গার আক্ষরিক অর্থেই হয়ে ওঠে নরওয়ের ‘তেল রাজধানী।’ (অনুরূপও পেশাগত ভাবে এই শিল্পেই যুক্ত। এক মার্কিন সংস্থায় ভূতত্ত্ববিদ হিসেবে সাগরের তলদেশের শিলাস্তর বিশ্লেষণ করেন তিনি।) সেই সঙ্গেই বিশ্বের সব থেকে দামি শহরের তকমা-ও পেয়েছে স্ট্যাভাঙ্গার। একটা খুব সাধারণ রেস্তোরাঁয় দু’জনের খাওয়ার খরচ ভারতীয় মুদ্রায় পাঁচ-ছ’হাজার টাকা। আর শহরে দু’মাইলের ট্যাক্সি ভাড়া কমপক্ষে এক হাজার!
আর আবহাওয়াও তেমনি নর্থ সি আর লাইসফিয়র্ডের হিমেল হাওয়া সারা দিন কাঁপুনি ধরাচ্ছে, সঙ্গে প্যাচপ্যাচে বৃষ্টি। বাঙালি নেই, ফলে বালাই নেই দুর্গাপুজো বা কালীপুজোরও। ‘নেমসেক’ মনে আছে? কর্তা অফিস বেরিয়ে গেলে গিলে খেতে আসে ফ্ল্যাটের দেওয়ালগুলো। সাগরিকার ক্ষেত্রে তার সঙ্গে যোগ হয় মাতৃত্বের আগে এবং পরের বিভিন্ন সমস্যা।
কার কী দোষ ছিল, এখন অবশ্য সে প্রশ্নগুলোই অবান্তর। অনুরূপ ভট্টাচার্য এখন আর পিছন ফিরে তাকাতেও রাজি নন। ভাই অরুণাভাস কুলটিতে নিজে ডেন্টিস্ট্রির চেম্বার ছেড়ে মাসের পর মাস পড়ে রয়েছেন বিদেশ বিভুঁইয়ে। তাঁকেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা জেরা করছেন নরওয়ের কর্মকর্তারা। এখন ভালয় ভালয় সব মিটলে তাঁর হাত দিয়েই দুই শিশুকে ভারতে ফেরত পাঠানো হবে। তার পর একটু সময় নিয়ে পাততাড়ি গোটানোর তোড়জোড় করবেন অনুরূপ নিজেও। তার আগে অবশ্য ফ্ল্যাটটা বিক্রির বন্দোবস্ত করতে হবে। কোম্পানি কয়েক মাস আগে ‘সিক লিভ’ মঞ্জুর করেছে। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে হবে। এত দিন জমে যাওয়া ধারদেনাগুলোরও তো ব্যবস্থা করতে হবে!
কিন্তু বাচ্চাদের ফিরে পেলে হলই বা সেটা কাকার মারফত পারবেন না নতুন করে আবার স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে জীবন শুরু করতে?
“জানি না। আসলে আমার জীবনটাই একেবারে শেষ হয়ে গিয়েছে!’’
স্ত্রীর সঙ্গে এখনও কথাবার্তা হয়?
“হ্যাঁ হয়, কথা হয়।” অনুরূপের সংক্ষিপ্ত উত্তর।
এর পর আর কথা বাড়ানো যায় না। ফ্ল্যাটের ভিতরে পাথরের মতো নীরবতায় দুই ভাইয়ের বিষণ্ণতা ক্রমশ ছুঁয়ে যেতে থাকে। কুলটির ভট্টাচার্য বাড়ির দুই ভাই রুপম আর জয়ম দিন গুনতে থাকেন ১৭ এপ্রিলের জন্য! বাচ্চাদের ফেলে যাওয়া খেলনাগুলো আলগোছে নাড়াচাড়া করতে করতে উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন রুপম। জয়ম হঠাৎ লাফ মেরে ইউটিউব-এ আইপিএল দেখতে শুরু করেন, “দারুণ ব্রডব্যান্ড স্পিড কিন্তু এখানে, জানেন, খেলা দেখে সুখ আছে!”
ফ্ল্যাটের ঠিক নীচেই একটা ছোট্ট চিনে রেস্তোরাঁর হাল্কা জটলা ঠেলে বেরিয়ে আসছি। অনুরূপ ভট্টাচার্যের অনুরোধ কানে এল, “আমাদের জন্য একটু প্রার্থনা করবেন প্লিজ!”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.