আইপিএলের এই এক মজা। কে যে কখন ‘হিরো’ থেকে ‘জিরো’ বা ঠিক তার উল্টোটা হয়ে যাবে, কেউ জানে না। এখানে কিংবদন্তিকে নিমেষে এসে দাঁড়াতে হতে পারে বাস্তবের রুক্ষ জমিতে, আবার অনামী তরুণ রাতারাতি উঠে আসতে পারেন শিরোনামে। গোলাপি শহরে রবিবার সন্ধেয় স্বল্প পুঁজি নিয়ে রাহুল দ্রাবিড় ও তাঁর টিমের নাইট-নিধন পর্ব থেকে ক্রিকেটের চিরন্তন শিক্ষাটা আরও একবার বড় উদাহরণ হিসেবে চলে আসবেই।
তুমি আগে কী করেছ, কত বড় নাম বা কবে ঘি দিয়ে মেখে ভাত খেয়েছিলে, তাতে কিসসু এসে যায় না। নাম দেখতে গেলেই এই মজার খেলা বড় নিষ্ঠুর ভাবে প্রতিশোধ নেবে। যেমন আজ নিল নাইটদের উপর। শাহরুখের টিমের ব্যাটিংয়ের ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’ বলতে নিশ্চয়ই ম্যাকালাম, কালিস আর গম্ভীরকেই বোঝায়। প্রথম জনের পাঁচ বছর আগে করা ১৫৮ এখনও আইপিএল রেকর্ড, কালিসের ৪২টা টেস্ট সেঞ্চুরি আছে আর গম্ভীরের আছে বিশ্বকাপ ফাইনালে ৯৭। তা এই ত্রয়ী কিনা পরপর তিনটে বলে ডাগআউটের রাস্তায়। আর বোলার কে? মর্নি মর্কেল বা মুরলীধরন কিংবা ভেত্তোরি নন, অনামী পেসার অমিত সিংহ এবং আনকোরা অঙ্কিত চহ্বাণ!
১৬৪ তাড়া করতে গিয়ে সহজ পাটা উইকেটে নাইটরা ৮-৩। পাওয়ার প্লে-র ছ’ওভার শেষে ২৭-৪। ম্যাচের অক্কাপ্রাপ্তি তখনই ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। সামান্যতম মুখরক্ষা হল মনোজ তিওয়ারি (৪৯ বলে ৫৯) ও ব্রেট লি (১১ বলে ২৫)-র জন্য। কিন্তু সেটা মুখরক্ষাই। মোদ্দা কথা হল, ব্যাটিংয়ের তথাকথিত হিরে-চুনি-পান্নারা এতটাই ডোবাচ্ছেন বা ঝোলাচ্ছেন যে শুরুতেই হেরে বসছে নাইটরা। কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই। এ ভাবে আর গোটা তিনেক ম্যাচ চললে....থাক গে! |
কানায় কানায় ভরা সোয়াই মান সিংহ স্টেডিয়ামে যখন রয়্যালসের থিমসং ‘হাল্লাবোল’-এর নাচনকোদনের সঙ্গে তাল মেলাচ্ছিল স্টেডিয়াম, কেমন লাগছিল নাইটদের, সেটা না লিখলেও চলে। শাহরুখ ভিআইপি বক্সে বসে একটার পর একটা সিগারেট ধ্বংস করছেন আর নাইটদের ডাগআউটে নেমে এসেছে শ্রাদ্ধবাসরের নিস্তব্ধতা। বাজিগরের সামনে বাজিমাত করছেন রাজ কুন্দ্রা-শিল্পা শেট্টির টিমের নতুন আমদানি অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড়। দেখছেন শিল্পার স্বামী, দু’হাত মুখে পুরে সিটিও দিচ্ছেন। বেচারি ডিজে---ভাল করে ‘করব, লড়ব, জিতব’ বাজানোর সুযোগটাই পেলেন না!
ম্যাচের কথায় আসি। প্রচলিত ধারণা হল টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানদের চটজলদি হিরো হয়ে যেতে আহামরি কিছু বাহাদুরি লাগে না। বিশ্বসেরা বোলারেরও দু’একটা খারাপ দিন যেতেই পারে। যে দিন হয়তো চব্বিশটা বল জায়গায় পড়ল না। আর যদি না-ই পড়ে, নেহাত মাঝারি মানের ব্যাটও দুমদাম আড়া চালিয়ে একটা ৩০ বলে ৬২ মেরে দিতেই পারে। বেমক্কা চালালেও কেউ দোষ ধরবে না। পা চলল কি না নিয়ে কে আর মাথা ঘামাচ্ছে, স্কোর যখন ঊর্ধ্বমুখী? যে দিন যাঁর লেগে গেল, সে দিন সে-ই নায়ক। সোমবার হয়তো ক বাবু, মঙ্গলবার খ বাবু বা বুধবার আরও অজ্ঞাতকুলশীল কেউ। |
উপরে যা পড়লেন, সেটা যে নেহাতই অর্ধসত্য, রবিবারের ম্যাচ তা হাতেগরম দেখাল। এটা কখনও ক্যাপ্টেনের খেলা, কখনও বোলারদেরও খেলা। জয়পুরের উইকেট পাটা বলেই এখানে ১৪০ কিলোমিটার গতিতে বল করলে বেশির ভাগ সময় ডুবতে হবে। দরকার নিয়ন্ত্রিত স্লো বোলিং, যেখানে স্ট্রোক খেলতে চাইলেই খেলতে পারবে না ব্যাটসম্যান। দরকার হবে মস্তিষ্কের। যতই টি-টোয়েন্টি হোক, খেলাটা তো আদতে ক্রিকেট। পিচ অনুযায়ী ব্যাটিং বা বোলিংয়ের ছাঁচ বদলাতে হয়, নয়তো পাততাড়ি গোটাতে হয়। অমিত সিংহ (২-৩০), অঙ্কিত চহ্বাণ (২-২৩), কেভন কুপারদের (৩-২৮) কী নিখুঁত ভাবে ব্যবহার করলেন রাহুল! দুই ম্যাচে সাত উইকেট পাওয়া কুপার তো বলেই দিচ্ছেন, “রাহুল যা বলেছিল, তাই করেছি। আর তাতেই সাফল্য।”
আসলে এই টিমে রাহুলের মহিমাই আলাদা। টিমে তিনি তো শুধু নামেই কোচ কাম ক্যাপ্টেন। কাজে মেন্টর, অভিভাবক এবং আর যা যা অভিভাবকসুলভ বিশেষণ ভাবতে পারেন, স-অ-ব। ভারী নাম নেই, তবু টানা দুটো ম্যাচ জিতে ফেললেন। দুটোতেই ব্যাটে রান, একটা ইনিংসেও একশোর কমে স্ট্রাইকরেট নেই। আজ রান আউট না হলে বড় ইনিংস আসতেই পারত। দ্রাবিড় সভ্যতার যেটুকু ভিতরে রয়ে গিয়েছে, তার পুরোটাই রাহুল ঢেলে দিয়েছেন রাজস্থানের জন্য। প্রকৃত পেশাদার যা করে থাকে।
কেকেআর-এর ভবিষ্যৎ? সামনে ক্রিস গেইলের ফাঁড়া। গত বারের ইডেন নিশ্চয়ই কেউ ভুলে যাননি। শুধু গেইলের কথাই বা বলি কেন? প্রাক্তন নাইট ব্র্যাড হজও তো এ দিন পুরনো টিমকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলে ২৯ বলে ৪৪ রান করে চলে গেলেন। নিঃসন্দেহে ঝটকা। প্রাক্তন নাইটরা সবাই প্রায় পুরনো টিমকে দেখলেই প্রতিশোধ নেন। এ প্রায় আইপিএলে নিয়মে পরিণত। যেমন বরাবর একই ছবি নাইটদের ডাগআউটে। সবাই যেন ‘রামগরুড়ের ছানা।’ কখনও সেখানে থাকতেন ঢ্যাঙা বুকানন, কখনও বা থম মেরে গালফোলা হোয়াটমোর। জয়পুরের সোয়াই মান সিংহ স্টেডিয়ামেও এক ছবি।
শুধু চরিত্রের নাম বদলে গিয়েছে। আপাতত গম্ভীরের টিমে গাম্ভীর্যের নাম ট্রেভর বেলিস! |