শহরভিত্তিক উদাত্ত সমর্থনের ঢেউ কোথায় পৌঁছতে পারে, সেই সংসারের বড়দা যদি কলকাতা হয়। মেজদা আজ থেকে অঘোষিত ভাবে পুণে!
পুণে মানে অ্যাদ্দিন ছিল ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমি। পুণে বিশ্ববিদ্যালয়। ওশো আশ্রম। পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউট। রোববার এর সঙ্গে যোগ হল সুব্রত রায় স্টেডিয়াম। আর তাকে কেন্দ্র করে ভেসে উঠল আধুনিক যুগের এমন সব টি-টোয়েন্টি দর্শক যার পাশে প্রফেসর দেওধরের মাঠে বসানো ব্রোঞ্জ মূর্তিটা যেন একটা কনট্র্যাডিকশন। এক জন প্রতীক ক্রিকেটের মূল সংস্কৃতি আর ভাবনার। আর এক দল উদাত্ত বিনোদনের। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় যখন রাইডারকে নিয়ে ওপেন করতে যাচ্ছেন তখন পেছনে আবহসঙ্গীতের মত বাজছিল ‘বল্লে বল্লে’। তাঁর অবশ্য অভিযোগ করার কিছু নেই। টানা দু’ম্যাচে জয় সম্পন্ন হওয়ার আগে যখন কলকাতা গুনতে শুরু করেছে একটা টিম দুইয়ে শূন্য, একটা টিম দুইয়ে দুই। তখন মরাঠা দর্শকরা এমন তীব্র চিৎকার আর পতাকা উত্তোলনে পুরো স্টেডিয়াম ভরিয়ে দিচ্ছেন যেন সব ছত্রপতির সেনা। |
১৬৬ করেছিল পুণে। এ রকম চরমপন্থী দর্শক মানে বল করার সময় রানটা বেড়ে হয়ে যায় ১৮৬। কিংস ইলেভেন কেন, যে কোনও ফ্র্যাঞ্চাইজির পক্ষেই এই রান টপকানো কঠিন। কারণ উইকেটের তলায় এমন বালি যে, বল পড়ে ঝুরঝুর করে নেমে যাচ্ছে। শুনলাম পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে এই স্টেডিয়াম। নীচে মাঠের নানা জায়গায় বালি দেওয়া। এমনকী আউটফিল্ডেও। বল পড়ে ক্রমশ স্লো হয়ে যাচ্ছে। ভারতের স্টেডিয়াম জগতে পুণের সুব্রত রায় স্টেডিয়াম আধুনিকতম সংযোজন। কিন্তু স্টেডিয়াম চত্ত্বর জুড়ে এয়ারটেলের নেটওয়ার্ক আসে না। তেমনি বাইশ গজে বল পড়ে সমান উচ্চতায় আসে না ব্যাটে। এখানে চারে ম্যাচ জেতা যাবে না। ছয়ে জিততে হবে। পাঁচ বছর আগের অ্যাডাম গিলক্রিস্ট হলে ম্যাচ শেষ হওয়ার আগে ম্যাচ রিপোর্ট লিখতে বসতাম না। ২২ রানে হেরেও পঞ্জাব ম্যাচটা শেষ করত না। এই গিলক্রিস্ট কিপিং করে দিচ্ছেন এটাই বিস্ময়। কিন্তু ব্যাটিংয়ে যেন তাঁর নিশির ডাক এসে গিয়েছে। আর নয়। অন্তত ধারাবাহিক ভাবে তো নয়ই। |
অশোক দিন্দার দুটো ওভারে গিলক্রিস্টের ব্যাটিং দেখে মনে হচ্ছিল গোটা অস্ট্রেলিয়ান গ্রীষ্মে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের অত্যাচারিত হওয়ার অন্তত হালকা মর্যাদা নৈছনপুর গ্রামের এই তরুণ ফেরত এনেছেন। আজ পর্যন্ত কোনও বাঙালি পেসার এই গতিতে বল করেছেন কিনা সন্দেহ। বহু ফাস্ট বোলারের বিনিদ্র রজনীর খলনায়ক গিলক্রিস্ট ব্যাট ছোঁয়াতে পারছিলেন না দিন্দার বলে। ১৪৩.৫ কিলোমিটার তর্কযোগ্য ভাবে কোনও বাঙালি পেসারের সর্বকালের দ্রুততম স্পেল। বরুণ বর্মন কাছাকাছি তুলনা হতে পারেন। কিন্তু বরুণও সম্ভবত এই গতিতে বল করেননি।
পুণের দুটো ম্যাচ দেখে আভাস পাওয়া যাচ্ছে শিবাজি মহারাজের সভায় পাঁচ রত্ন। সৌরভের মগজাস্ত্র অর্থাৎ ক্যাপ্টেন্সি। সেটা এতই ধারালো যে নিয়মিত বোলার পরিবর্তনে কখনও ব্যাটসম্যানকে সেট হতে দিচ্ছে না। খেলার আগে অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে যখন দৌড়ে দেখা করতে এলেন সৌরভ, তখন সহারাশ্রী সুব্রত রায় অমিতাভের সামনেই সৌরভের ওয়াংখেড়ে অধিনায়কত্বের প্রশংসা করলেন। শুনে অমিতাভও বললেন, “ওটা খুব ইমপ্রেসিভ ছিল।” পাঁচ রত্নের দ্বিতীয় দিন্দার বোলিং। তিন, উথাপ্পার ব্যাটিং ও কিপিং। চার, মার্লন স্যামুয়েলসের অলরাউন্ড দক্ষতা। আর পঞ্চম রত্ন স্টিভ স্মিথ। |
খেলা শুরু হল রাত আটটায়। কিন্তু রবিবাসরীয় বিনোদন শুরু হয়ে যায় সওয়া ছ’টায়। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পুণেতে বেশ কিছু অনুষ্ঠান রয়েছে। আইটি বিজনেস হাব, ওশো আশ্রমে বড় অনুষ্ঠান। আর মহা-যোগা বিশ্ব সম্মেলন। কিন্তু ভরপুর গ্ল্যামার, প্রাচুর্য আর হাই ভোল্টেজ বিনোদনে রবিবারের পুণে শিখরে থেকে গেল। স্টেডিয়ামে প্রথম আইপিএল ম্যাচ দেখতে আসা অমিতাভ বচ্চন। প্রিয়ঙ্কা চোপড়া, বিপাশা বসু, দিয়া মির্জা। আর পঞ্জাব টিমের মালকিন প্রীতি জিন্টাকে ঘিরে এমনই গ্ল্যামারের সমারোহ যে এক এক সময় গুলিয়ে যাচ্ছিল প্রীতি ম্যাচ না সিরিয়াস ক্রিকেট খেলা। বনি কপূর, গুলশন গ্রোভারদেরও দেখা গেল লাউঞ্জ এলাকায়। ওপরে দুটো লাউঞ্জ বক্সে দেখলাম একটায় ডোনা গঙ্গোপাধ্যায় আর একটায় অর্পিতা পাল। শুনলাম অভিনেতা বিশ্বজিতও এসেছেন। মঞ্চের ওপর প্রিয়ঙ্কা যখন নাচছেন, তার কুড়ি গজ পিছনে নেট করাচ্ছেন অ্যালান ডোনাল্ড। দেওধরের ব্রোঞ্জ মূর্তির শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে যাওয়ার মত দৃশ্য।
কিন্তু কিছু করার নেই। সুব্রত রায় স্টেডিয়ামের প্রথম ম্যাচেই আইপিএল সুপার-ডুপার হিট। পুণে সমর্থকদের এ দিন দেখে মনে হল অন্য ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো তো বাকি থাক, একই রাজ্যের সচিনের মুম্বই এখানে খেলতে এলেও ঘোর ব্যারাকিংয়ের মুখে পড়বে।
আইপিএল শেষ হওয়ার আগে শেষ জন যদি তারকা হয়ে যান আশ্চর্যের কিছু নেই। মাত্র দ্বিতীয় বার ভারতে খেলতে এসে যা ব্যাটিং ও ফিল্ডিং করেছেন ভাবাই যায় না। হরভজনদের বিরুদ্ধে ম্যান অব দ্য ম্যাচ ছিলেন। এ দিনও জটিল সময় ১২ বলে ২৫ করে গেলেন। স্টিভের মতোই স্যামুয়েলসকেও খুব ভাল স্পট করেছেন সৌরভ। ব্যাট তো করেই দিচ্ছেন। তাঁর অফস্পিন যাচ্ছে কুম্বলের গতিতে। নাইট রাইডার্সের সমস্যা যদি মহাতারকাদের পারফর্ম না করতে পারা হয়, পুণে ওয়ারিয়র্সের সম্পদ হল স্ফুলিঙ্গদের তারা হওয়ার অভিযানে ছুটতে চাওয়া। এনার্জিতে এমন ভরপুর টিমটা যে, প্রতি ম্যাচে দুই থেকে তিনটে রানআউট স্বাভাবিক নিয়মে হতে থাকা উচিত। |
স্টেডিয়ামের জমজমাট উদ্বোধনের পর সৌরভ যখন ১৮ বলে ২০ করে আউট হয়ে গেলেন আর ঝপ করে দ্বিতীয় উইকেটটাও পড়ে গেল তখন মনে হচ্ছিল গানবাজনা আর উল্লাসের পৃথিবী না শেষে অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স প্রত্যক্ষ করে। পুণে দেখাল তাদের ব্যাটিংয়ে ভঙ্গুরতা থাকতে পারে, কিন্তু এনার্জি, সমর্পণ আর মগজাস্ত্রের ত্রিভুজে তারা এ বারের আইপিএলের ডার্ক হর্স হতে যাচ্ছে। মোহালিতে পঞ্জাবের সঙ্গে পরের ম্যাচটাও যদি জেতে তা হলে তিনে তিন হবে। বাকি থাকবে ১৬ ম্যাচে আর পাঁচটা জেতা। ছত্রপতির সৈন্যদের পক্ষে সমস্যা কীসের!
|