মতাদর্শে বিতর্ক অব্যাহত,
পার্টি কংগ্রেসে ভোটাভুটি
র্বহারাদের নিয়ে প্রায় দিশাহারা সিপিএম!
ভারতীয় পথে চলার অঙ্গীকার করেও দলের মতাদর্শগত অবস্থান ঠিক করতে বসে বিতর্ক মেটাতে পারল না কোঝিকোড় পার্টি কংগ্রেস। সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে এগোতে গিয়ে ১০ বছর আগে এই কেরলের মাটিতেই সিপিএমের দলীয় কর্মসূচি সংশোধন করে ‘সর্বহারার একনায়কতন্ত্র’ বাদ দেওয়া হয়েছিল। তার বদলে ব্যবহার করা হয়েছিল ‘সর্বহারার রাষ্ট্রক্ষমতা’ (প্রোলেতারিয়েত স্টেটহুড) শব্দবন্ধটি। তা নিয়ে তখন বিতর্ক হয়। এক দশক পরে এ বার মতাদর্শগত দলিলকে ‘যুগোপযোগী’ করে গ্রহণ করার সময় সেই ‘সর্বহারা’ প্রশ্নেই ফের বিতর্ক বাধল দলের অন্দরে! এতটাই যে, রবিবার এই প্রশ্নে সংশোধনী আনা হল। ভোটাভুটি হল। এবং ভোটে পরাজিত হল ‘সর্বহারার একনায়কতন্ত্র’ই!
তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য, ‘সর্বহারার একনায়কতন্ত্র’ বদলের বিপক্ষে সংশোধনী প্রস্তাব এনেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের দুই প্রতিনিধি, বর্ধমানের জেলা সম্পাদক অমল হালদার এবং রথীন রায়। সিপিএম সূত্রের খবর, শেষ পর্যন্ত পরাজিত হলেও প্রস্তাবটির পক্ষে ভোট পড়েছে ৩৭টি। যার অধিকাংশই আবার বাংলার প্রতিনিধি। এর আগে চিনকে আর ‘সমাজতান্ত্রিক’ বলা যায় কি না, এই প্রশ্নে কেন্দ্রীয় কমিটিতে ভোটাভুটি হয়েছিল এবং তাতে হার হয়েছিল কারাট-শিবিরের। পার্টি কংগ্রেসে ঠিক তার উল্টো ঘটনা ঘটল। যার ফলে মতাদর্শগত প্রশ্নে কমিউনিস্ট পার্টিতে আবহমান কালের বিতর্ক যে শেষ হওয়ার নয়, সেই সত্যই আর এক বার প্রতিষ্ঠিত হল!
‘সর্বহারা’ নিয়ে সংশোধনী প্রস্তাব যে হেতু বাংলার নেতারা পেশ করেছিলেন এবং যে হেতু কেন্দ্রীয় কমিটির বিগত ভোটাভুটির ইতিহাস রয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে সিপিএমের একাংশ এই গোটা বিষয়টিকে কারাট-শিবির বনাম বঙ্গ ব্রিগেডের লড়াই হিসেবেই দেখছে। দলের অন্য অংশের আবার ব্যাখ্যা, ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। তাঁদের যুক্তি, এই পার্টি কংগ্রেসেই মতাদর্শগত দলিল নিয়ে আলোচনার সময় রাষ্ট্রের শ্রেণি চরিত্রকে শ্রমিক শ্রেণির চরিত্র থেকে পৃথক করা উচিত নয় বলে মত দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য শ্রীদীপ ভট্টাচার্য। কিছুটা অন্য ভাবে হলেও যে মত মিলে গিয়েছে দিল্লি রাজ্য কমিটির সদস্য আলভিনা শাকিলের বক্তব্যের সঙ্গে।
কোঝিকোড়ে পার্টি কংগ্রেসের প্রচারে বাদ পড়েনি বাংলাও। তবে বানান-বিভ্রাট সহ। নিজস্ব চিত্র
যিনি বলেছেন, ‘সর্বহারার একনায়কতন্ত্রকে এ ভাবে এক কথায় খারিজ করা যায় না। বিপ্লবের ‘সারবস্তু’ প্রতিফলিত হবে, এমন শব্দবন্ধই ব্যবহার করা উচিত’। দলের একটা অংশের বক্তব্য, আলভিনারা যেমন কারাট-শিবিরের প্রতিনিধি বলে পরিচিত, তেমনই শ্রীদীপবাবু আলিমুদ্দিনের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাই এর মধ্যে কারাট-আলিমুদ্দিন বিভাজন খোঁজা অর্থহীন।
রাজনৈতিক দলিলের মতোই মতাদর্শগত দলিলটিও শেষ পর্যন্ত ‘সর্বসম্মতিক্রমে’ গৃহীত হয়নি। বাংলারই প্রতিনিধি কল্লোল রায় বিপক্ষে হাত তুলেছেন। আবার দিল্লির দম্পতি প্রসেনজিৎ বসু-আলভিনা শাকিল এবং অন্ধ্রপ্রদেশের এক প্রতিনিধি (যিনি রাজনৈতিক দলিলেও সংশোধনী এনে একাই তার পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন) ভোটদানে বিরত থেকেছেন। রাজনৈতিক দলিলের দায়িত্বে ছিলেন খোদ সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট। আর মতাদর্শগত দলিলের দায়িত্বে সীতারাম ইয়েচুরি। দলের একটি মহল থেকে বলা হচ্ছে, রাজনৈতিক দলিলে সর্বসম্মতি হয়নি দেখে কারাট-শিবিরই ইয়েচুরির দলিলে ‘ভিন্ন মত’ নথিভুক্ত করিয়েছে। সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্বের অভ্যন্তরীণ বিভাজন মতাদর্শ-প্রশ্নেও ছায়া ফেলেছে বলে মত ওই অংশের।
দু’দিন ধরে ৩৩ জন প্রতিনিধি বিতর্কে অংশগ্রহণ করেছেন। তার পরে এ দিন অধিবেশনের অন্দরে জবাবি ভাষণে পলিটব্যুরো সদস্য ইয়েচুরির ব্যাখ্যা, কমিউনিস্ট পার্টিতে কোনও পুরনো প্রস্তাবকেই নতুন প্রস্তাব এসে সরিয়ে দিতে পারে না, যত ক্ষণ না তাতে ‘সংস্কার’ হচ্ছে। ‘সর্বহারার একনায়কতন্ত্র’কে সিপিএম বিসর্জন দিয়ে দিল, বিষয়টা এমন নয়। ‘সর্বহারার রাষ্ট্রক্ষমতা’র কথা বলে আগের ধারণাকেই আরও ‘সময়োপযোগী’ (আপডেট) করা হল। অধুনা চিন যেমন বলে ‘জনগণতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র’। রুদ্ধদ্ধার কক্ষে স্বভাবসুলভ ‘সুললিত’ ভঙ্গিতে ইয়েচুরির উদাহরণ, ‘লেনিন এসে কার্ল মার্ক্সের বিকল্প হননি, মার্ক্সকে সরিয়েও দেননি। তাঁকে ‘সমৃদ্ধ’ই করেছেন। ঠিক তেমনই স্তালিন ‘সমৃদ্ধ’ করেছেন লেনিনকে’।
তবে দলের মধ্যে ওঠা প্রবল প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে ইয়েচুরি তাঁর জবাবি ভাষণে জানিয়েছেন, উত্তর কোরিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের বেশ কিছু ‘উল্লঙ্ঘন’ হচ্ছে, যা দলের দলিলে নথিভুক্ত করানো হবে। সে দেশে বংশানুক্রমিক শাসক মনোনীত হচ্ছেন, মাত্র ১৮% জমিতে চাষ করার সুযোগ পাচ্ছেন নাগরিকেরা। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই দলের অন্দরে ইয়েচুরির সতর্কবার্তা, চিন বা অন্য কোনও দেশকে ‘ঠিক বা ভুল’ তত্ত্ব বাতলে দেওয়ার মতো ‘ঔদ্ধত্য’ যেন এ দেশের সিপিএমে না-আসে। চিনের কোন কোন জিনিস তাঁদের পছন্দ হচ্ছে না, সুযোগ পেলে তা চিনের কমিউনিস্ট পার্টিকে (সিপিসি) বলা যেতে পারে, কিন্তু তত্ত্ব বাতলানো চলবে না! যেমন অতীতে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টিকে বলা হয়েছিল। ইয়েচুরি এ-ও বলেছেন, চিনের সমাজতন্ত্র কোনও দিন ভেঙে পড়লে পৃথিবীর সর্বহারা আন্দোলনে বৃহত্তম আঘাত লাগবে। তেমন কোনও ঘটনা ঘটলে একটা অংশকে পাওয়া যাবে, যাঁরা ‘পণ্ডিতের মতো’ মাথা নেড়ে বলবেন, ‘আমরা আগেই জানতাম’!
সব মিলিয়ে ৫৯টি সংশোধনী গৃহীত হয়েছে। কিন্তু এত সবের পরেও মত-বিরোধ, ভোটাভুটি তো রয়েই গেল! পলিটব্যুরোর এক সদস্যের জবাব, “এটাই দস্তুর এবং খুব স্বাভাবিক। আমাদের পার্টিটা তো কোনও হাইকম্যান্ডের কথায় চলে না!”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.