শেষ জীবিত প্রতিষ্ঠাতাকেও
সরাতে তৎপর বিজয়নরা
ক জন পার্টি কংগ্রেসে উপস্থিতই হননি। শারীরিক অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে লিখিত চিঠি দিয়ে ‘ছুটি’ নিয়েছেন। অন্য জন প্রথম দিন থেকেই নিয়মিত পার্টি কংগ্রেসে থাকছেন।
এক জন বহু আগেই পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে সরে দাঁড়াতে চেয়েছেন। অন্য জন পলিটব্যুরো থেকে আগেই বাদ পড়েছেন। এ বার তাঁকে কেন্দ্রীয় কমিটি থেকেও হঠানোর প্রবল চেষ্টা শুরু হয়েছে।
একটা জায়গায় অবশ্য দু’জনের মধ্যে ‘মিল’ রয়েছে। দু’জনেই সিপিএমের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী! বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও ভি এস অচ্যুতানন্দন। তার মধ্যে অচ্যুতানন্দন আবার দলের শেষ জীবিত প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য।
সিপিএমের বিশতম পার্টি কংগ্রেসের শেষ দিনের আগের রাতে কোঝিকোড়ের সমুদ্রতীরে এই দু’জনকে নিয়েই যাবতীয় প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। আগামিকাল সিপিএমের নতুন পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটি তৈরি হবে। সাধারণ সম্পাদক পদে প্রকাশ কারাটের পুননির্বার্চিত হওয়া নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই। কিন্তু ভি এস ও বুদ্ধ-র ‘ভাগ্যে’ কী আছে, তা নিয়েই আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের একটা বড় অংশ চাইছে, বুদ্ধবাবুকে পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটিতে রেখে দেওয়া হোক। প্রকাশ কারাটেরও সেটাই মত বলে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের খবর।
এই পার্টি কংগ্রেসেই দলের সাধারণ সম্পাদক পদের মেয়াদ বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। রাজ্য কমিটি থেকে লোকাল কমিটি পর্যন্ত সমস্ত সম্পাদক পদেও একই ভাবে মেয়াদ বেঁধে দেওয়ার জন্য সংবিধান সংশোধনী প্রস্তাব আনা হয়েছে। সেই প্রস্তাব অনুযায়ী, একই ব্যক্তি তিন দফার বেশি ওই পদে থাকতে পারবেন না। চতুর্থ দফায় তাঁকে পদে থাকতে হলে কেন্দ্রীয় কমিটির ক্ষেত্রে কমিটির তিন-চতুর্থাংশের সম্মতি প্রয়োজন। একই ভাবে রাজ্য কমিটির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাজ্য কমিটির তিন-চতুর্থাংশের সম্মতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির অনুমোদন এবং জেলা বা তার নীচের কমিটির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কমিটির তিন-চতুর্থাংশের সম্মতি ও রাজ্য কমিটির অনুমোদন প্রয়োজন। এ নিয়ে ভোটাভুটির সময় প্রস্তাবের বিপক্ষে চার জন ভোট দিয়েছেন। ভোটদানে বিরত থেকেছেন দু’জন।
প্রকাশ্য সমাবেশের জন্য সৈকতে তৈরি হচ্ছে বিশাল মঞ্চ। নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মার্ক্সের মূর্তি। ছবি: সন্দীপন চক্রবর্তী
সূত্রের খবর, চতুর্থ দফায় পদে থেকে যাওয়ার ‘নতুন নিয়ম’ নিয়েই আপত্তি জানিয়েছেন ওই চার জন। এ নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই আজ নতুন একটি প্রস্তাব এসেছে। দাবি উঠেছে, শুধু মেয়াদ নয়, পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির পদে থাকার সর্বোচ্চ বয়সসীমাও বেঁধে দেওয়া হোক। যদিও কেরলের রাজ্য সম্পাদক পিনারাই বিজয়ন শিবিরের আনা ওই প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত খারিজ হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু হঠাৎ এমন প্রস্তাব কেন?
এক পলিটব্যুরো সদস্যের জবাব, “এ ভাবেই ওঁরা বুড়ো মানুষটাকে সরাতে চাইছেন!” এই ‘বুড়ো মানুষ’-টি হলেন ৮৯ বছর বয়সী ভি এস অচ্যুতানন্দন। আর ‘ওঁরা’? বিজয়ন এবং তাঁর দলবল। তাঁরাই দাবি তুলেছেন, পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটিতে অবসরের বয়স ৮০ বছর বেঁধে দেওয়া হোক। দলের একটা অংশ যখন ভি এস-কে ফের পলিটব্যুরোয় ফেরাতে উদ্যোগী, তখন বিজয়নরা বয়সের ছুতোয় তাঁকে কেন্দ্রীয় কমিটি থেকেও ছেঁটে ফেলতে চাইছেন। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একটা অংশ কিন্তু বয়সসীমা বেঁধে দেওয়ার বিরুদ্ধে। প্রকাশ নিজেও বলছেন, “আমাদের পার্টিতে এমন অনেকে আছেন, যাঁদের বয়স আশির ঘরে হলেও ষাটের কোঠায় থাকা নেতাদের থেকে বেশি উদ্যম ও উৎসাহে কাজ করে চলেছেন।” পার্টি কংগ্রেসে অনেক প্রতিনিধিও ঘরোয়া আলোচনায় বলছেন, ইএমএস, সুরজিৎ, জ্যোতি বসুরা আমৃত্যু দলের উঁচু পদে থেকে গিয়েছেন। তা ছাড়া সিপিএমের প্রতিষ্ঠাতা-সদস্যদের মধ্যে এক মাত্র ভি এস-ই জীবিত। সে কথা মাথায় রেখেই তাঁকে অন্তত কেন্দ্রীয় কমিটিতে রাখা উচিত।
তাৎপর্যপূর্ণ হল, ষাটের কোঠাতেই রয়েছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। দিনের পর দিন কেন্দ্রীয় কমিটি ও পলিটব্যুরোয় যোগ না দেওয়ায় অনেকেই চাইছিলেন, তাঁকে সরিয়ে সুর্যকান্ত মিশ্রকে পলিটব্যুরোয় আনা হোক। প্রয়োজনে বুদ্ধদেবকে পলিটব্যুরোয় স্থায়ী সদস্য হিসেবে রেখে দেওয়ার পক্ষেও ছিলেন অনেকে। কিন্তু বুদ্ধবাবুকে পলিটব্যুরোয় পূর্ণাঙ্গ সদস্য হিসেবেই রেখে দেওয়ার পক্ষে ইয়েচুরিরা। কারাটও দলের মধ্যে জানিয়েছেন, বুদ্ধ দিল্লি-হায়দরাবাদ বা কোঝিকোড়ে না এলেও কলকাতায় পলিটব্যুরো-কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে যোগ দিচ্ছেন। কোঝিকোড়ে না আসার কারণও চিঠি লিখে জানিয়েছেন। দল তাঁর ছুটি মঞ্জুরও করেছে। দলীয় সূত্রের মতে, বুদ্ধ পলিটব্যুরোর বাইরে থাকলে কারাটের সমস্যা বাড়বে। কারণ পলিটব্যুরোয় বুদ্ধদেবের থাকার অর্থ হল, বৈঠকে যোগ না দিলেও তিনিও শীর্ষনেতৃত্বের সব সিদ্ধান্তের শরিক।
বুদ্ধদেব পলিটব্যুরোয় থেকে গেলে আবার সূর্যকান্তের পলিটব্যুরোয় আসার সম্ভাবনা কমবে। যদিও বিরোধী দলনেতা হিসেবে তাঁর কাজের জন্য তিনি পলিটব্যুরোয় আসার দাবিদার হয়ে উঠেছেন। চার বছর আগে কোয়ম্বত্তূর পার্টি কংগ্রেসে পলিটব্যুরোয় যে ১৫ জন নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে এম কে পান্ধের মৃত্যু হয়েছে। বয়সের কারণে এ বার বাদ পড়তে পারেন মহম্মদ আমিন। দু’জনেই সিটু-নেতা হিসেবে পলিটব্যুরোয় ছিলেন। এঁদের পরিবর্তে একটি আসনে সিটু-র সর্বভারতীয় সভাপতি এ কে পদ্মনাভনের পলিটব্যুরোয় আসা নিশ্চিত। আর একটি আসনে কে আসবেন, তা নিয়ে জটিলতা রয়েছে। কারণ আমিন শুধু সিটু-নেতাই ছিলেন না, তিনি পশ্চিমবঙ্গেরও নেতা ছিলেন। একই সঙ্গে ছিলেন পলিটব্যুরোর এক মাত্র সংখ্যালঘু সদস্য। পশ্চিমবঙ্গে যখন সিপিএমের সংখ্যালঘু ভোটে ধস নেমেছে, তখন দলের শীর্ষ কমিটিতে অন্তত এক জন সংখ্যালঘু নেতা থাকা প্রয়োজন বলে দলের মত।
সংখ্যালঘু হিসেবে যে তিন জন পলিটব্যুরোয় যাওয়ার দৌড়ে রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে দু’জনই পশ্চিমবঙ্গের। এঁরা হলেন হান্নান মোল্লা ও মহম্মদ সেলিম। হান্নানের নেতৃত্বে রাজস্থানে জল ও বিদ্যুতের দাবিতে আন্দোলন করে সাফল্য মিলেছে। গোটা উত্তর ভারতে এক মাত্র রাজস্থানই সিপিএমের ‘মরুদ্যান’। সংখ্যালঘু হিসেবে দৌড়ে থাকা তৃতীয় জন হলেন সুভাষিণী আলি। বিদায়ী পলিটব্যুরোয় কোনও উত্তর ভারতের প্রতিনিধি ছিলেন না। সে দিক থেকে সুভাষিণীর পাল্লা ভারী। সিপিএমের শীর্ষনেতৃত্বে মহিলার সংখ্যা বাড়ানোরও দাবিও সুভাষিণীর পাল্লা ভারী করতে পারে। সে ক্ষেত্রে সিটু-র কোটায় থাকা দু’টি আসনের একটি কমবে। সিটু-র তরফে অবশ্য সাধারণ সম্পাদক তপন সেনকে পলিটব্যুরোতে নেওয়ার দাবি উঠছে। এ বার রাজ্য থেকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে আসার দৌড়ে রয়েছেন শ্রীদীপ ভট্টাচার্য, রবীন দেব ও সিটু-নেতা দীপক দাশগুপ্ত। তিন জনই রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য।
ভি এস-র ভাগ্যে কী জুটবে, তার উপরেও অনেক কিছু নির্ভর করছে। ভি এস পলিটব্যুরোয় না এলে তাঁর জায়গায় কেরল থেকেই অন্য কারও থাকার কথা। কিন্তু বিজয়ন কেরল থেকে এখনই অন্য কাউকে পলিটব্যুরোয় না নেওয়ার পক্ষে। সে ক্ষেত্রে ওই জায়গায় সূর্যকান্ত, তপন বা অন্য রাজ্যের কেউ আসতে পারেন। তিন বছর আগে দলবিরোধী কাজকর্মের জেরে ভি এস-কে পলিটব্যুরো থেকে বাদ দেওয়া হয়। কেরলে বিধানসভায় সামান্য ব্যবধানে হেরে ক্ষমতা হারালেও ভি এস-এর জনপ্রিয়তা ও মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সাফল্যে ভর করেই সিপিএম আশাতীত ফল করছে। দলীয় পর্যালোচনায় সেটাই উঠে এসেছে। কিন্তু বিজয়ন-গোষ্ঠী বলছে, দলের সঙ্গে আলোচনা না করে মুখ্যমন্ত্রী নিজের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়াতেই হার হয়েছে। তাই ভি এস-র বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়েছেন কেরলের রাজ্য সম্পাদক। এখন দেখার, দলের শেষ জীবিত প্রতিষ্ঠাতা সদস্যকে কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে তিনি সরাতে পারেন কি না।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.