সিপিএমের সাংগঠনিক বিপর্যয়ের জেরে পার্টি কংগ্রেসের মঞ্চ থেকেই এ বার বিশেষ প্লেনামের দাবি উঠল। সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং তা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে সবিস্তার আলোচনা চেয়ে প্লেনামের দাবি তুললেন হিন্দি বলয়ের প্রতিনিধিরা।
দলের মধ্যেই প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে সিপিএম নেতৃত্বও এখন ‘বাস্তববাদী’ হওয়ার কথা ভাবছেন। প্রতিবার পার্টি কংগ্রেস থেকে কিছু ‘অগ্রাধিকার রাজ্য’ চিহ্নিত করে দেওয়া হয়। পরবর্তী তিন বছরে যে রাজ্যগুলিতে সংগঠন বিস্তার দলের প্রধান লক্ষ্য থাকে। কিন্তু পরের পার্টি কংগ্রেসে আগের বারের লক্ষ্যপূরণে ‘ব্যর্থতা’ নিয়ে হইচই হয়! গত তিন বছরে লোকসভা-সহ বিভিন্ন রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে দলের করুণ দশা থেকে শিক্ষা নিয়ে সিপিএম কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এ বার গোটা একটা রাজ্যের বদলে জেলা ধরে ধরে এগোতে চাইছেন। রাজস্থানে যে ‘মডেলে’ কাজ করে সিপিএমের সাংগঠনিক অস্তিত্ব শক্তিশালী হয়েছে বলে দলীয় সূত্রের অভিমত। চলতি পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত হতে-চলা ‘লাইন’ অনুযায়ী, এর পর থেকে সাংগঠনিক ভাবে পিছিয়ে-পড়া রাজ্যগুলির কয়েকটি জেলাকে লক্ষ্য ধরে কাজ করতে চায় সিপিএম। সেখানে ‘সাফল্য’ এলে সংলগ্ন এলাকায় সংগঠন ছড়িয়ে দেওয়া যাবে। এতে যেমন কাজের সুবিধা হবে, তেমনই গোটা রাজ্যের তুলনা টেনে সমালোচনার জায়গাও কমানো যাবে। কমবে দলীয় নেতৃত্বের ‘বিড়ম্বনা’।
বিপর্যয় থেকে ‘শিক্ষা’ নেওয়ার কথা দলীয় নেতৃত্ব ভাবতে শুরু করলেও বিভিন্ন রাজ্যের প্রবল সমালোচনার হাত থেকে তাঁরা অবশ্য রেহাই পাননি। উত্তরপ্রদেশ, বিহার, হিমাচলপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, রাজস্থান, ঝাড়খণ্ডের মতো হিন্দিভাষী প্রায় সব রাজ্য থেকেই বিশেষ প্লেনামের দাবি উঠেছে। ওই সব রাজ্যের নেতাদের একাংশের বক্তব্য, নিদেনপক্ষে হিন্দি বলয়ের রাজ্যগুলির জন্য প্লেনাম ডাকা হোক। কমিউনিস্ট পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, দু’টি পার্টি কংগ্রেসের মাঝে কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে বিশেষ প্লেনাম অধিবেশন ডাকা যেতে পারে। পার্টি কংগ্রেসে বসেই প্লেনামের দাবি সেই অর্থে অভিনব! হিন্দি বলয়ের প্রতিনিধিদের যুক্তি, পার্টি কংগ্রেসের পাঁচ রকম কর্মসূচির ফাঁকে সংগঠনের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ও খুঁটিনাটি আলোচনার সুযোগ ‘পর্যাপ্ত’ নয়।
সাংগঠনিক রিপোর্ট নিয়ে আলোচনায় রবিবার বারেবারেই উঠে এসেছে পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের ‘পারফরম্যান্সে’র কথা। পলিটব্যুরোর তরফে প্রকাশ কারাট উত্তরপ্রদেশ, বৃন্দা কারাট উত্তরাখণ্ড ও ঝাড়খণ্ড, সীতারাম ইয়েচুরি মহারাষ্ট্র, এস আর পিল্লাই বিহার, বিমান বসু অসমে দলের দায়িত্বে। হিমাচলের কাশ্মীর সিংহ ঠাকুরের মতো প্রতিনিধিরা রুদ্ধদ্বার আলোচনায় বলেছেন, ‘অগ্রাধিকার রাজ্য’ বলে চিহ্নিত করে পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যেরা যেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন, সেখানেই ছবিটা সব চেয়ে খারাপ! পার্টি কংগ্রেসের পঞ্চম দিনে এই সংক্রান্ত আলোচনায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছেন দলের প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্র-নেতারা। এসএফআইয়ের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক এবং অধুনা দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক সুজন চক্রবর্তী যেমন প্রশ্ন তুলেছেন, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যকে ‘অগ্রাধিকার’ করার অর্থ কী, যেখানে জাতপাতের রাজনীতির জন্য সিপিএম দাঁত ফোটাতেই পারে না! তার চেয়ে অনেক বেশি ‘গুরুত্ব’ দেওয়া উচিত রাজস্থান ও হিমাচলকে। সুজনবাবুর প্রস্তাব, বছরে ১০ হাজার টাকার নীচে আয়সম্পন্ন পরিবারকে বিপিএল তালিকায় আনতে হবে এই রকম দাবি নিয়ে দল জাতীয় স্তরে আন্দোলন করে দেখুক সংগঠন বাড়ে কি না! সুজনবাবুর আমলের এসএফআইয়ের সর্বভারতীয় সভাপতি, অন্ধ্রপ্রদেশের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ওয়াই ভি রাও সংগঠনের প্রশ্নে তাঁর মতকে সমর্থন করেছেন। মহারাষ্ট্রের মারিয়ম ধওয়লে বলেছেন, আন্দোলনের জন্য সুজনবাবুর প্রস্তাব দুর্দান্ত!
তেমনই এসএফআইয়ের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য ছিল, পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা শুধু বৈঠকে যোগ না-দিয়ে তৃণমূল স্তরে যান। ‘দুর্বল’ এলাকায় সংগঠন নিয়ে যাওয়ার কাজে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ভূমিকা কী? এই প্রশ্ন তোলার পাশাপাশিই প্রথা ভেঙে ঋতব্রত বক্তব্য শেষ করেছেন উর্দুতে এবং হাততালিও পেয়েছেন! এক দিকে যখন শীর্ষ নেতৃত্ব সমালোচনার মুখে, তখন বাংলার প্রাক্তন সাংসদ হান্নান মোল্লা কিন্তু রাজস্থান ও বিহারে ‘ভাল কাজ’ করার জন্য ‘অভিনন্দন’ পেয়েছেন। বিহারের অবধেশ কুমার যেমন বলেছেন, হান্নান তৃণমূল স্তরে গিয়েছেন। সেই জন্য তাঁরা হান্নানকে ‘কৃতজ্ঞতা’ জানাচ্ছেন। আবার পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সম্পাদক বিমানবাবুর নাম না-করে এক প্রতিনিধি কটাক্ষ করেছেন, অসমের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতা গত দু’বছর ধরে রাজ্য কমিটির কোনও বৈঠকেই হাজির হননি!
এসআরপি-র পেশ-করা সাংগঠনিক রিপোর্টে দলের কেন্দ্রীয় পার্টি সেন্টারের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের কড়া সমালোচনাও ছিল। যার মধ্যে কারাট, বৃন্দা, ইয়েচুরি এবং এসআরপি নিজেও পড়েন। প্রকাশ্যে বিবৃতি দেওয়া এবং রাজ্য ও গণ সংগঠনগুলির রিপোর্ট খতিয়ে দেখার ক্ষেত্রে পলিটব্যুরো সদস্যদের ‘ব্যর্থতা’র সমালোচনা ছিল। ছিল দুর্বল এলাকায় সংগঠন বাড়াতে না-পারার ব্যর্থতা কবুলও। এর পরে তাঁরা কী করবেন?
আলোচনার বিরতিতে এসআরপি এ দিন বলেছেন, “স্থানীয় মানুষের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করে
আমরা জনসংযোগ গড়ে তুলব। রাজ্যের নীচে জেলা
এবং জেলার নীচে এলাকা ধরে ধরে এগোব। পার্টি কংগ্রেসের পরে পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটি ‘দুর্বল’ এলাকাগুলি নিয়ে আবার বিশেষ ভাবে বসবে।” স্থানীয় মানুষের সাধারণ দাবিদাওয়া নিয়ে যে আন্দোলন করতে হয়, এই ‘সত্য’ তাঁরা এত দিনে বুঝলেন? এসআরপি-র সাফাই, “আগেও করতাম, করছি। কিন্তু জাতপাতের রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতির জন্য অনেক জায়গায় পৌঁছতে পারিনি।” |