বছর সাতেক আগের কথা।
অজমেরের খ্বাজা মৈনুদ্দিন চিস্তির দরগায় আজকের মতোই লাল চাদর চড়িয়েছিলেন আসিফ আলি জারদারি। সস্ত্রীক। কারাবাসে থাকা স্বামীর মুক্তির ‘মন্নত’ কিছু দিন আগেই মঞ্জুর হয়েছে। সেই কৃতজ্ঞতা জানাতেই জারদারিকে নিয়ে খ্বাজার দরবারে উপস্থিত হয়েছিলেন বেনজির ভুট্টো। ঠিক যেমনটি আর পাঁচ জন তাঁদের মানত পূর্ণ হলে আসেন।
|
অজমেরে জারদারি।
ছবি: পিটিআই |
সেই সফরে স্বামীকে নিয়ে বেনজির ঘুরে বেড়িয়েছিলেন গোটা দরগা। দরগার প্রবীণ খাদিম (সেবায়ত বা পাণ্ডা) সৈয়দ ইকবাল কাপ্তানের কথায়, তার আগে ২০০৩ সালে দরগায় বেনজির স্বামীর মুক্তির জন্য প্রার্থনা জানিয়ে গিয়েছিলেন। তার পরেই কারাবাস থেকে মুক্তি পান জারদারি। ২০০৫-এ আবার এখানে এসে তাই কিশোরীর মতো উচ্ছল হয়ে পড়েছিলেন বেনজির। নিজেই জারদারিকে শুনিয়েছিলেন দরগার ইতিহাস।
আজ সাত বছর পরে ফের এক বার অজমেরে জারদারি। গরিবের ‘হমদম’ বলে যাঁর অন্য নাম ‘গরিব নওয়াজ’, সেই মৈনুদ্দিন চিস্তির দরবারে। সঙ্গে ছেলে বিলাবল জারদারি ভুট্টো-সহ প্রায় জনা চল্লিশের একটি দল। সহধর্মিণী বেনজির আজ ইতিহাস। যাঁর মৃত্যুতেই জারদারির উত্থান রকেট গতিতে সোজা দেশের প্রেসিডেন্ট পদে।
আজ প্রায় আধ ঘণ্টার দরগা সফরে একবারও কি জারদারির মনে পড়েনি অতীতের স্মৃতি? সেই খাদিম ইকবাল কাপ্তানের হাতে ‘জিয়ারত’ (প্রার্থনা) বা লাল মখমলের চাদর চড়াতে গিয়ে জারদারির চোখ কি ছলছল করে ওঠেনি? আর পাঁচটা রাজনীতিকের মতোই জারদারির নির্বিকার মুখাবয়ব বুঝতে দেয়নি এ সব কিছুই। প্রার্থনার পরে বিলাবলকে সঙ্গে নিয়ে গোলাপি রঙের দস্তুরবন্দ পাগড়ি পরে উপস্থিত সকলকে এক টুকরো হাসি উপহার দিয়েই ফেরার পথ ধরেন জারদারি। জারদারির মনের কথা জানা না গেলেও এ দিন সকাল থেকেই উদ্বেল ছিলেন স্বপ্নদীপ। গত ২২ বছর ধরে পাকিস্তানের জেলে চর সন্দেহে বন্দি সর্বজিৎ সিংহের মেয়ে তিনি। জারদারি অজমের আসবেন শুনে পিসি দলবীর কৌরকে নিয়ে গত দু’দিন ধরে আস্তানা গেড়েছিলেন খ্বাজার শহরে। খোদ প্রেসিডেন্টের কাছে পিতার মুক্তির দাবি সরাসরি জানাবেন পাক কর্তৃপক্ষের কাছে এটাই আর্জি ছিল তাঁর। সকাল থেকে আশা-নিরাশার দোলাচলে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও রাস্তাই খোলা ছিল না পিসি-ভাইঝির। শেষ পর্যন্ত পাক কর্তৃপক্ষ অবশ্য জারদারির সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেননি। তবে আশ্বাস মিলেছে, বাবার মুক্তি চেয়ে মেয়ের এই ব্যাকুল প্রার্থনার খবর অবশ্যই পৌঁছে দেওয়া হবে পাকিস্তানের সর্ব্বোচ্চ পর্যায়ে। অজমেরের জেলেই আবার বন্দি রয়েছেন ৮৫ বছরের পাক বিজ্ঞানী খলিল চিস্তি। পাক প্রেসিডেন্টের হাত দিয়ে পিতার মুক্তির দাবি জানিয়ে ভারতের শীর্ষ পর্যায়ের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন আমনা-ও। স্বপ্নদীপও আমনার হয়ে ভারতীয় প্রশাসনের কাছে আর্জি জানাতে চলেছেন বলে জানা গিয়েছে।
অজমরের ঘুঘড়া এয়ারস্ট্রিপ থেকে দরগা পর্যন্ত কার্যত আজ গোটা রাস্তার দু’ধারেই ছিল ব্যারিকেড। বেলা একটার পর থেকেই রাস্তার দায়িত্ব নিয়ে নেয় তিন হাজার রাজস্থান পুলিশ। দরগার আশপাশে ছড়িয়েছিটিয়ে ছিল কয়েকশো কম্যান্ডো। ত্রি-স্তরীয় নিরাপত্তা বলয়ে একদম প্রথমে ছিলেন পাক সেনার অফিসারেরা। সেখানে ভারতীয় অফিসারদের প্রবেশাধিকার ছিল না বলে রাজ্য প্রশাসনের একটি সূত্র জানিয়েছে। শহরে প্রবেশের আগেই ট্রেন-বাস থামিয়ে চলেছে তল্লাশি। বন্ধ করে দেওয়া হয় দোকানপাট। বহুতল হোটেল বা বাড়ির বারান্দায় দাঁড়ানো তো দূরে থাক, দরজা-জানলা খোলার অনুমতি দেয়নি পুলিশ। দরগা এলাকায় যেখানে জয়েন্ট এন্ট্রান্সের পরীক্ষা চলছে সেই ছাত্রছাত্রীদেরও বিকেল ছ’টার আগে পরীক্ষার হল থেকে বার হওয়ার অনুমতি দেয়নি প্রশাসন।
অজমেরের প্রাচীন প্রবাদ বলে, ‘ইরাদে রোজ বনকে টুট যাতে হ্যায়। অজমের ওহি যাতে হ্যায় যিনহে খ্বাজা বুলাতে হ্যায় (কত বাসনা রোজ জন্মায়, ভেঙেও যায়। খ্বাজা যাকে ডাক দেন, অজমের সে-ই যেতে পায়)।’ সেই নিয়ম মেনেই আম আদমি থেকে মোগল সম্রাট কিংবা বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়কেরা এসে খ্বাজার সমাধি দর্শন ও মনস্কামনা পূরণের প্রার্থনা জানিয়ে যান। আশির দশকে জিয়া উল হক, পারভেজ মুশারফের পরে এ বার পালা আসিফ আলি জারদারির। আগের দুই প্রেসিডেন্ট সামরিক শাসনকর্তার পরিচয়ে এসেছিলেন। গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত পাকিস্তানের কোনও প্রেসিডেন্টের এই প্রথম অজমের সফর। গত কয়েক দিন ধরে নতুন করে সাজানো হয়েছে শতাব্দী প্রাচীন দরগাটি। সোনালি পাতে ফুলের কাজ করা গম্বুজে নতুন পালিশের চিহ্ন স্পষ্ট। কাঁচা সবুজ রং দরগার দেওয়ালে। গোটা দরগায় ভাসছে গোলাপের খোশবাই। রাষ্ট্রনায়কের সম্মানে দরগার মার্বেলে লাল কার্পেট পাতা। চিরাচরিত ভাবে জারদারির হাতে তুলে দেওয়া হয় একটি তরোয়াল, দুয়ানামা ও চাদর (পাকিস্তানের বিভিন্ন দরগায় চড়ানোর জন্য)। আকবরের সময় থেকেই দরগা কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রনায়কদের হাতে সাম্মানিক উপহার হিসেবে তরোয়াল দিয়ে আসছেন। ছ’শো বছর ধরে আকবর, ঔরঙ্গজেব, রানি ভিক্টোরিয়া কিংবা হাল আমলে রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিল সকলেই ওই উপহার পেয়েছেন। সেই তালিকাতেই এ বার জারদারি। জারদারিও দরগার উন্নতিতে ১০ লক্ষ ডলার সাহায্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
এক দিকে ২৬/১১-র মূল চক্রী হাফিজ সইদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চাপ, অন্য দিকে নির্বাচনের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা পাকিস্তান। রাজনৈতিক শিবিরের মতে, জনসমর্থন কার্যত তলানিতে ঠেকে যাওয়া জারদারির বিদায় কেবল সময়ের অপেক্ষা। এই পরিস্থিতিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে কী রসদ নিয়ে জারদারি দেশে ফিরলেন, তা কূটনীতিকদের বিবেচ্য বিষয় হবে। কিন্তু ‘গরিব নওয়াজে’র দরবারে যে ‘জিয়ারত’ তিনি করে গেলেন, তা ভাবী কালে মঞ্জুর হবে কি না সেই উত্তর দিতে পারবেন এক জনই আসিফ আলি জারদারি। |