পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রাথমিক শর্ত, বন্ধ করতে হবে সন্ত্রাস। এবং মুম্বই সন্ত্রাসে অভিযুক্তদের পাশাপাশি জামাত-উদ-দাওয়ার প্রধান হাফিজ সইদেরও শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
চল্লিশ মিনিট কথা। তার মধ্যে নিমন্ত্রণ ও তা রক্ষা করার আশ্বাসের ভিতরে আলোচনার মূল হিসেবে উঠে এল এই একটিই প্রসঙ্গ। ৭ নম্বর রেসকোর্স রোডে মধ্যাহ্নভোজের আগে এই আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এবং পাক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি একমত হলেন বহু ক্ষেত্রে। কিন্তু সার্বিক ভাবে আলোচনার কেন্দ্রে রইল সন্ত্রাস ও হাফিজ সইদ প্রসঙ্গ। লস্করের প্রতিষ্ঠাতা তথা জামাত-উদ-দাওয়া প্রধানকে কাঠগড়ায় তুলতে হবে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে জারদারি জানালেন, হাফিজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কোনও অভিযোগ বা তথ্যপ্রমাণ পাক সরকারের কাছে নেই। ফলে তাঁকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সম্ভাবনাও নেই।
জারদারির কাছে এই সফরে হাফিজ সইদ প্রসঙ্গ কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা আজ সকালে তিনি ইসলামাবাদ থেকে নয়াদিল্লির উদ্দেশে রওনা হওয়ার সময়েই বোঝা গিয়েছে। সেখানে তাঁকে বলে আসতে হয়েছে, হাফিজ সইদের বিষয়টি সম্পূর্ণই তাঁর দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এ নিয়ে মনমোহনের সঙ্গে আলোচনা করবেন না তিনি। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী প্রসঙ্গটি তোলায় জারদারিও তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করে দেন।
মনমোহন কেন সন্ত্রাসের সঙ্গে হাফিজ সইদ প্রসঙ্গ তুললেন?
রাজনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, প্রথমে পাক প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকে হাফিজ সইদের প্রসঙ্গ না তোলারই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ভারতের শীর্ষ নেতৃত্ব। কারণ, হাফিজকে নিয়ে দ্বিপাক্ষিক স্তরে কূটনৈতিক তিক্ততা তৈরি হলে তাতে আখেরে লাভ হবে না নয়াদিল্লির। জারদারির সফরকে কাজে লাগিয়ে শান্তি প্রক্রিয়া এগোনোর যে চেষ্টা তারা করছে, তা ব্যাহত হবে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে জাতীয় ‘প্রত্যাশার’ দিকটি মাথায় রেখেই সেই কৌশলের পরিবর্তন করেন প্রধানমন্ত্রী। এ দিন শীর্ষ আলোচনায় সার্বিক ভাবে সন্ত্রাস নিয়ে সরব হয়েছেন তিনি। |
পাক প্রেসিডেন্টকে জানিয়েছেন, ভারতের বিরাট ‘প্রত্যাশা’ রয়েছে যে, সন্ত্রাস দমনে এ বার ইতিবাচক পদক্ষেপ করবে পাকিস্তান। এই সূত্রেই ওঠে হাফিজ সইদের প্রসঙ্গও।
জামাত-উদ-দাওয়া প্রধানের কথা তোলা হবে কি না, তাই নিয়ে অভ্যন্তরীণ এবং জাতীয়, দুই রকম চাপই বাড়ছিল নয়াদিল্লির উপরে। আমেরিকা ঘোষণা করেছে হাফিজ সইদের মাথার দাম। চিনও সন্ত্রাস প্রশ্নে ইসলামাবাদের দিকে তর্জনী তুলেছে। এই পরিস্থিতিতে হাফিজকে আলোচনার বাইরে রাখলে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মনমোহনকে যে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়তে হবে, সে কথা স্পষ্ট হয়ে যায় কংগ্রেস নেতৃত্বের কাছে। গত সন্ধ্যায় সে কারণেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছ থেকে মুম্বই সন্ত্রাস সম্পর্কে যাবতীয় ডশিয়ার এবং সইদ সম্পর্কিত তথ্যপ্রমাণ চেয়ে পাঠায় প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়। আজ বৈঠকের পর বিদেশসচিব রঞ্জন মাথাই জানিয়েছেন, “পাকিস্তানের মাটি থেকে ভারত-বিরোধী কার্যকলাপ বন্ধ করার বিষয়ে জারদারিকে অনুরোধ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। পাক প্রেসিডেন্ট বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে আরও আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। আসন্ন স্বরাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে এই নিয়ে পরবর্তী কথা হবে।”
কূটনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, আজ যে সইদ প্রসঙ্গে জারদারি নিজের অবস্থানে অটল ছিলেন, এর পিছনে তাঁর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে জারদারির অবস্থা এখন যথেষ্টই নড়বড়ে। সেনাবাহিনী থেকে মোল্লাতন্ত্র, সকলেই তাঁর ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে। সেখানে হাফিজ সইদের মতো একটি স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ যে তিনি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন, সেটা দেশ ছাড়ার আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন জারদারি। তবে মুম্বই সন্ত্রাসের অন্য ষড়যন্ত্রীদের বিচার নিয়ে জারদারি কিন্তু সম্পূর্ণ হতাশ করেননি। তাঁর কথায়, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইসলামাবাদ ঐকান্তিক এবং পাকিস্তান নিজেও সন্ত্রাসবাদের শিকার। মুম্বই সন্ত্রাসে অভিযুক্তদের বিচার দ্রুত শেষ হওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করেছেন পাক প্রেসিডেন্ট। কিন্তু পাশাপাশি এ-ও বলেছেন, এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের বিচারব্যবস্থা এবং আইনি ব্যবস্থার এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যার জন্য সময় লাগছে।
গত বছর বিশ্বকাপ ক্রিকেট সেমিফাইনালের সময় ক্রিকেট কূটনীতিতে ভারতে এসেছিলেন পাক প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি। জারদারির এ বারের সফরকে বলা হচ্ছে তীর্থ-কূটনীতি। কারণ, সরকারি ভাবে বলা হচ্ছে এই সফরের উদ্দেশ্য, মৈনুদ্দিন চিস্তির দরগা দর্শন। কিন্তু এই সফরকে কাজে লাগিয়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাই করেছে দুই পক্ষ। বাণিজ্য থেকে ভিসা, স্যর ক্রিক-সহ সব বিষয়েই আলোচনার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে একমত হয়েছেন দুই রাষ্ট্রপ্রধান। সম্প্রতি সোল-এ প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, সন্ত্রাস দমনে পাকিস্তান হাতেকলমে কিছু করে দেখালে তবেই তিনি ইসলামাবাদ সফরে যাবেন। আজ জারদারিকে পাশে রেখে মনমোহন বলেছেন, “প্রেসিডেন্ট জারদারি আমাকে পাকিস্তান যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। দু’তরফের সুবিধাজনক তারিখে পাকিস্তান যেতে খুবই আগ্রহী আমি।” তাঁর কথায়, “ভারত এবং পাকিস্তানের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়া প্রয়োজন। আমাদের মধ্যে বেশ কিছু বিষয় রয়েছে। এই বিষয়গুলির সমাধানের জন্য বাস্তবমুখী এবং সময়োচিত সমাধান খুঁজতে আমরা আগ্রহী।” একই সুরে জারদারিও বলেছেন, “আমরা ভারতের সঙ্গে আরও ভাল সম্পর্ক চাই। আজ দ্বিপাক্ষিক সমস্ত বিষয় নিয়েই কথা হয়েছে। আশা করছি খুব শীঘ্রই পাকিস্তানের মাটিতে কথা হবে।”
আজকের বৈঠকে স্থির হয়েছে, জুলাই মাসে বিদেশমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণ যাবেন পাকিস্তান সফরে। তার আগে, আগামী মাসে বৈঠকে বসবেন ভারত ও পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রসচিব। আজ বৈঠকের পর বিদেশসচিব রঞ্জন মাথাই বলেছেন, “আগামী মাসগুলিতে দু’দেশের মধ্যে আলোচনার প্রক্রিয়া পূর্বনির্ধারিত পথেই এগোবে। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ক্ষেত্রে পাকিস্তান যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আজ তাকে স্বাগত জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।” বিদেশ মন্ত্রকের এক শীর্ষ কর্তার বক্তব্য, “ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে আলোচ্যসূচি ক্রমশই বিস্তৃত করার চেষ্টা হচ্ছে। এ ব্যাপারে চিনের মডেল অনুসরণ করছে দু’দেশই। অর্থাৎ মতান্তরের জায়গাগুলি সরিয়ে রেখে বাণিজ্য-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্র, যেখানে মতৈক্যের সম্ভাবনা রয়েছে, সেগুলি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।”
এ দিনের বৈঠক সেই মডেলেরই উদাহরণ হয়ে থাকল। |