নতুন বন্ধু তৈরি করো খোলা মন নিয়ে
আমি এক জন কলেজ-ছাত্রী। আমার সমস্যা হল, আমি ছোটবেলা থেকে সহপাঠীদের এবং অন্যান্য বন্ধুদের কাছ থেকে খারাপ ব্যবহার পেয়ে আসছি। যে-সব বন্ধু মেশে, তারাও কথায় কথায় ঠাট্টার ছলে আমায় বিনা কারণে অপমান করে। আমার মানবিক মূল্যবোধকে তারা ঠাট্টা করে। সব বন্ধুকেই আমি নানা ভাবে সাহায্য করি, সঙ্গ দেওয়ার চেষ্টা করি, তবু তারা কোনও কোনও ক্ষেত্রে আমাকে বাদ দিয়ে চলে যায়। তারা তাদের গল্প শুনতে বাধ্য করে। আমি যদি অনীহা দেখাই, তাতেও তারা রাগ করে। বন্ধুর দলে আমায় নির্বাক শ্রোতা হয়ে থাকতে হয়। আমায় এখন বাড়ির লোকেরা নির্বোধ বলে। আমার মানসিক ধৈর্য তলানিতে ঠেকেছে। কিন্তু আমায় উপেক্ষা করার মতো কারণ দেখি না। আজকের দিনেও আমার মধ্যে সততা রয়ে গিয়েছে। আমি দেখতে যথেষ্ট সুশ্রী ও স্মার্ট। গান, নাচ এবং আঁকাতে পারদর্শী। বাড়ির লোকেরা পড়াশোনাকে বেশি গুরুত্ব দেয়, তাই পড়ার পাশাপাশি গানটা কষ্ট করে চালিয়ে যাচ্ছি। এক এক সময় ভাবি, আমার কি সত্যিই কোনও আচরণগত সমস্যা আছে? বই পড়া, গান শোনা, এগুলো কি এ যুগে অচল?
আমার বাড়ির লোকেরা আমায় সব সময় সঙ্গ দেয়। আমি বাইরের লোকের কাছ থেকে আঘাত পেতে পেতে বাড়ির লোকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি। বাবা-মা নানা জিনিস উপহার দিয়ে, সঙ্গে দিয়ে, বেড়াতে নিয়ে গিয়ে আমার মন ভাল করার চেষ্টা করে, তবুও আমার মন ব্যথিত। কারণ, অনেকের ঈর্ষা যে আমার এত কিছু পাওয়ার যোগ্যতা নেই। আমি অভিভাবকদের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছি। পাছে বন্ধুদের মতো বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যায়, তাই বয়ফ্রেন্ড পেতেও ভয় পাই। কী ভাবে চললে সঠিক বন্ধু পাব? বন্ধুদের কাছে আমার গুরুত্ব বাড়বে?
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
তোমাকে বলছি
তোমার নিজের লেখা চিঠিটা তুমি অনেক দিন পরে আজ আবার পড়ছ নিশ্চয়ই। দেখ তো, তোমার নিজের কোথাও খটকা লাগে কি না। তোমার নিজেরই কি আশ্চর্য মনে হচ্ছে না যে, ছেলেবেলা থেকে তোমার পরিচিত মানুষজন, তোমার বন্ধু এবং পরিবারের লোকজন সকলেই তোমাকে ভুল বুঝছে, ঈর্ষা করছে, নিন্দে করছে? তোমার বন্ধুত্ব করতে যে সমস্যা হচ্ছে, তার জন্য তোমার বন্ধু নেই, তা তুমিও বুঝতে পারছ। এমন হতেই পারে যে, কেউ কেউ তোমাকে হিংসে করে, তোমাকে এড়িয়ে যেতে চায়। কিন্তু সকলেই তেমন করবে, এটা কী করে সম্ভব? নিশ্চয়ই তোমার পরিচিত ছেলেমেয়েদের মধ্যে অনেকেরই অন্যান্যদের সঙ্গে বন্ধুত্ব রয়েছে, হয়তো যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতাও রয়েছে। তা হলে কেবল তোমার সঙ্গেই তাদের বন্ধুত্ব বাধা পাচ্ছে কোথায়? সবটাই তাদের স্বভাবের বা বুদ্ধির দোষ বলে ধরে নেওয়া বোধহয় ঠিক হবে না।
ভেবে দেখ, মানবিকতা, সততা, অন্যকে সাহায্য করার ইচ্ছা, সঙ্গীত বা সাহিত্যপ্রীতি, এমন যে সব মূল্যবোধ তোমার আছে বলে তুমি মনে কর, সে সব তোমার চারপাশে আরও অনেক মানুষের মধ্যে আছে। তারা সকলেই নির্বান্ধব নন। অথচ তোমার সমস্যা এতটাই যে, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করা সম্ভব হবে না ভেবে তুমি বয়ফ্রেন্ড তৈরি করতে চাইছ না।
তোমাকে আর একবার চিন্তা করতে হবে। তুমি যে ভেবে নিচ্ছ বন্ধুরা সকলে তোমার খুঁত ধরছে, তোমার নামে অপবাদ দিচ্ছে, এমনকী বাড়ির লোকও তোমাকে ‘নির্বোধ’ ভাবছে, মূল্য দিচ্ছে না, সেটা কি ঠিক? হয়তো সকলের ক্ষেত্রে এটা সত্যি নয়। অন্তত সমান ভাবে সত্যি যে নয়, সেটা নিশ্চিত। হয়তো তুমি ঠিক যতটা সম্মান, গুরুত্ব, ভালবাসা প্রত্যাশা করো বন্ধু বা পরিবারের মানুষদের থেকে, ঠিক ততটা পাচ্ছ না, বা ঠিক সেই রকম ভাবে পাচ্ছ না। তোমার সম্পর্কে অন্যের মনোভাব কী, তা কিন্তু তুমি জানো না। কারণ তুমি কখনও তাই নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা করোনি। এমনও হতে পারে যে, সে তোমাকে বেশি আত্মকেন্দ্রিক বা একটু বোরিং মনে করে। কিংবা সে হয়তো বুঝতেই পারেনি যে, তুমি বন্ধুত্ব করতে আগ্রহী। এমনও হতে পারে যে সে আসলে তোমাকে পছন্দই করে, কেবল সুযোগের অভাবে বন্ধুত্ব তৈরি করতে পারেনি। এর মধ্যে কোনটা সত্যি, তোমাকে যাচাই করে নিতে হবে। তাই খোলাখুলি কথা বলার অভ্যাস তৈরি করো।
তোমার যে সম্পর্ক তৈরিতে সমস্যা হচ্ছে, সম্ভবত তার একটা কারণ অন্য মানুষটি কী চায়, সে সম্পর্কে তুমি যথেষ্ট মনোযোগী হচ্ছো না। তুমি নিজেই লিখেছ, তুমি অন্যের কথা শুনতে গেলে অধৈর্য হয়ে পড়, নির্বাক হয়ে থাক। তা হলে সে-ই বা তোমার কথা বুঝতে আগ্রহী হবে কেন? বন্ধুত্ব তৈরি মানেই অন্যের সঙ্গে কিছু না কিছু আদান-প্রদান- সময়, ক্লাস নোটস, জোকস, পরামর্শ, গোপন কথা। কিন্তু দিতে হবে সেটাই যা তোমার বন্ধু চায়। এমন কাউকে তুমি নিশ্চয়ই খুঁজে পাবে, যে সাহিত্য আলোচনা করে খুশি হয়। সকলেই খুশি হবে না, সেটাই স্বাভাবিক। তুমি অন্যকে যা দিচ্ছ, যা ভাগ করে নিতে চাইছ, সেটা তার কাছে আদরণীয় জিনিস নয়। তাই প্রতিদানে কিছু দিতে সে আগ্রহী হচ্ছে না।
দেখো, যে কোনও সম্পর্ক তৈরির শর্ত অন্যের প্রতি আস্থা। তোমার চিঠির প্রতিটি ছত্রে অন্যের প্রতি তোমার অবিশ্বাস ফুটে উঠছে। তোমার সব ভাল, অন্যরা বোকা, মতলবি, এমন ধারণার উপর দাঁড়িয়ে তুমি কোনও সম্পর্কই তৈরি করতে পারবে না। যার উপর আস্থা আছে, তাকে নিজের মনের কথা খুলে বলো। নতুন বন্ধু তৈরি করো খোলা মন নিয়ে। যদি দেখ কিছুতেই পারছ না, অবশ্যই কাউন্সেলরের সাহায্য নাও।
বাবা-মাকে বলছি
মেয়ে কলেজে ওঠার পরেও যদি বন্ধুত্ব তৈরি করতে না পেরে থাকে, তা হলে এ সমস্যা অনেক দিনের। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে না পারা, এবং সেই কারণে একাকিত্ব, এ দুটোই মানসিক স্বাস্থ্যের যথেষ্ট ক্ষতি করে। তার উপর, সকলেই ওর সম্পর্কে নিন্দে করছে, এই ধারণা থেকে ওর ওপর অতিরিক্ত মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে। আপনাদের মেয়ে গান ভালবাসে, সেটাও কমিয়ে দেওয়ার জন্য আপনারা চাপ দিচ্ছেন। ফলে নির্বান্ধব, নিরানন্দ এবং ভীতিময় একটা জীবন তৈরি হয়েছে ওর জন্য। সমস্যার এই মূল রূপটাকে এড়িয়ে গিয়ে জিনিস উপহার দিয়ে, বেড়াতে নিয়ে গিয়ে ওর মন ভাল করার চেষ্টা করছেন। এতে ওর লাভ হবে না। এখনই এই সমস্যা থেকে ওকে বার করে আনতে না পারলে ভবিষ্যতে যথেষ্ট ক্ষতি হতে পারে। ওর সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলে, বন্ধুত্ব তৈরিতে উৎসাহ দিয়ে দেখুন, ও সহজ ভাবে সবার সঙ্গে মিশতে পারছে কি না। ওকে বোঝান যে, আপনারা ওকে ‘নির্বোধ’ মনে করেন না। যদি দেখেন, ‘সকলে আমার নিন্দে করছে, খুঁত ধরছে’ এই মনোভাব থেকে ও বেরোতে পারছে না, তা হলে কোনও মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলুন। ভাল রেজাল্টের চাইতে অনেক বেশি মূল্যবান সন্তানের সুস্থ জীবন।
ছেলেমেয়েকে নিয়ে মা-বাবার সমস্যা? নাকি মা-বাবাকে নিয়ে ছেলেমেয়ের সমস্যা? পড়ার খরচ
নিয়ে অভিভাবকের দুশ্চিন্তা? দূরের শহরে পড়তে যাওয়ার নামে মেয়ের গায়ে জ্বর আসা? যে
মুশকিলই হোক না কেন, পরিবারের সবাই মিলেই সমাধানে পৌঁছতে হবে। এ বার থেকে ‘প্রস্তুতি’-ও
কথা বলবে গোটা পরিবারের সঙ্গেই। অভিভাবকদের বা সন্তানের যে কোনও দুশ্চিন্তার কথা
আমাদের জানান (এবং জানাও) নিজেদের সমস্যা। সুচিন্তিত উত্তর দেবেন বিশেষজ্ঞরা।

ইমেল: prastuti@abp.in বিষয়:

অথবা, চিঠি পাঠান (এবং পাঠাও) এই ঠিকানায়:
হাতে হাত, প্রস্তুতি,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
এ বি পি প্রাঃ লিঃ,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা ৭০০ ০০১


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.