অর্ধেক পড়ুয়া কলেজে আসা বন্ধ করেছেন। নিয়মিত ফি-ও জমা দিচ্ছেন না। টান পড়ছে ভাঁড়ারে। আটকে যাচ্ছে অনেক শিক্ষক-আধিকারিকের মাস-মাইনেও। তাঁরাও অনিয়মিত হয়ে পড়ছেন। কিছু ছাত্রছাত্রী এখনও ক্ষীণ আশা নিয়েই কলেজে আসছেন। কিন্তু তাঁরাও বুঝতে পারছেন না, গোটাটাই পণ্ডশ্রম কি না! শিক্ষাবর্ষ নষ্ট হচ্ছে কি না! এ ছবি সিপিএম নেতা লক্ষ্মণ শেঠের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘আইকেয়ার’ পরিচালিত হলদিয়ার বি সি রায় মেডিক্যাল কলেজের।
নন্দীগ্রাম নিখোঁজ-কাণ্ডে সিআইডি-র হাতে লক্ষ্মণবাবু ধরা পড়ার পরে পড়ুয়া-অভিভাবক, শিক্ষক-আধিকারিকদের মধ্যে ভবিষ্যৎ নিয়ে এখন ঘোর অনিশ্চয়তা। সব চেয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ুয়ারা। কারণ, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নেই মোটা টাকা ‘ক্যাপিটেশন ফি’ দিয়ে তাঁরা ভর্তি হয়েছিলেন ওই বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে। বর্তমানে কলেজের অনেক পড়ুয়াই যে ফি দেওয়া বন্ধ করেছেন এবং তাতে শিক্ষকদের বেতন আটকাচ্ছে তা মেনে নিয়েছেন প্রশাসনিক আধিকারিক শ্রীমন্ত বসু। তাঁর কথায়, “লক্ষ্মণবাবু ছিলেন বটবৃক্ষের মতো। এখনকার পরিস্থিতিতে সমস্যা তো স্বাভাবিক। তবে সমস্যা মিটে যাবে বলেই এখনও আমাদের আশা।” |
নন্দীগ্রাম নিখোঁজ-কাণ্ডে নাম জড়ানোর পরে গত নভেম্বর থেকেই অজ্ঞাতবাসে ছিলেন লক্ষ্মণবাবু। তার আগেই অবশ্য ‘মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া’ এবং রাজ্য স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরিকাঠামোগত ‘খামতি’র কারণে (ডেন্টাল কলেজের ভবনকেই মেডিক্যাল কলেজের ভবন হিসাবে দেখানো) এই মেডিক্যাল কলেজের অনুমোদন বাতিল করেন। অভিযোগ, তার পরে প্রথমটায় লক্ষ্মণবাবু নিজে এবং পরে তাঁর স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অন্য কর্তারা সমস্যা মিটে যাওয়ার আশ্বাসই দিয়ে গিয়েছেন ছাত্রছাত্রী-অভিভাবকদের। অনুমোদন বাতিলের পরেও কলেজে ক্লাস বন্ধের নোটিস দেওয়া হয়নি। কিন্তু অনুমোদনের সমস্যাও মেটেনি। তাহলে কেন ছাত্রছাত্রীদের আশ্বাস দেওয়া? ওই বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের প্রশাসনিক আধিকারিক শ্রীমন্তবাবুর বক্তব্য, “আদালতে মামলার অগ্রগতির দিকে তাকিয়ে আছি আমরা। সেই জন্যই ছাত্রছাত্রীদের ভরসা দেওয়া হয়েছে। রাজ্য সরকার ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করবে না বলেই আমাদের আশা।”
এখন লক্ষ্মণবাবু ধরা পড়ায় অন্য কর্তাদের আশ্বাসে আর ভরসা রাখতে পারছেন না পড়ুয়ারা। ৮৮ জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে মাত্র ৪০-৪৫ জন এখন কলেজে আসছেন। অনুমোদন ফেরানোর জন্য হাইকোর্টে কয়েক জন অভিভাবক কিছু দিন আগে আর্জি জানিয়েছিলেন। সেই মামলার কী হয়, এখন সে দিকেই তাকিয়ে একাংশ ছাত্রছাত্রী। এক ছাত্র, দমদমের শৌভিক দাসের কথায়, “আদালতের কাছে সুবিচার চেয়েছি। আশা রয়েছে, পরীক্ষায় বসতে পারব। স্যারেরাও তাই বলছেন। তবে লক্ষ্মণবাবু গ্রেফতার হওয়ায় খুব ভাবনা হচ্ছে।” আর এক পড়ুয়া সৌনক জানাও বলেন, “উনি (লক্ষ্মণ শেঠ) থাকলে তবু একটা ভরসা থাকত!”
ফেব্রুয়া়রিতে ‘ডেন্টাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া’র প্রতিনিধিও ফের ডেন্টাল কলেজ পরিদর্শনে এসেছিলেন। কিন্তু কাউন্সিলের তরফে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত না জানানোয় ডেন্টাল কলেজের পড়ুয়ারাও রয়েছেন অনিশ্চয়তার মধ্যে। ডেন্টালের একাধিক আধিকারিক ও শিক্ষকও দু’মাস হল বেতন পাচ্ছেন না।
ইতিমধ্যে ‘হলদিয়া সার্ভিস সোসাইটি’ পরিচালিত দুর্গাচকের ‘বিদ্যাসাগর ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং সেন্টারে’র পড়ুয়ারা আন্দোলন শুরু করেছেন। এই প্রতিষ্ঠানেরও সভাপতি লক্ষ্মণবাবু। পড়ুয়াদের অভিযোগ, সভাপতি হিসাবে লক্ষ্মণবাবু ছাত্র-স্বার্থে কিছুই করেননি। ফি বাড়ানো হলেও ৮০ শতাংশ পড়ুয়া ‘ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ’য়েরও সুযোগ পান না। সভাপতি পদ থেকে অবিলম্বে লক্ষ্মণ শেঠের অপসারণ, ফি-হ্রাস এবং ক্যাম্পাসিংয়ের দাবি তুলেছেন সেখানকার ছাত্ররা। ‘আইকেয়ার’ পরিচালিত ‘হলদিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি’র প্রায় ৭০ জন কর্মী-শিক্ষকও মহার্ঘভাতার দাবিতে কলেজে বিক্ষোভ-আন্দোলন শুরু করেছেন। সে জন্য কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি কয়েক জনকে শো-কজ এবং সাসপেন্ড করেছিলেন। ওই শো-কজ, সাসপেনশনের নোটিস প্রত্যাহারের দাবিতে সম্প্রতি গভীর রাত পর্যন্ত ডিরেক্টর-রেজিস্ট্রারকে ঘেরাও করে রাখেন কর্মী-শিক্ষকরা। শেষ পর্যন্ত নোটিস প্রত্যাহারে বাধ্য হন কতৃর্পক্ষ। পঠনপাঠনে সমস্যা হচ্ছে অভিযোগ করে সোমবার আবার সেখানে বিক্ষোভ দেখান ছাত্রছাত্রীরা। ডিরেক্টর অভীককুমার মুখোপাধ্যায় অবশ্য ‘কলেজের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে’ কোনও মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন।
ডামাডোল যত বাড়ছে--ভবিষ্যৎ নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের বিপন্নতাই প্রকট হচ্ছে আরও বেশি করে। |