প্রবন্ধ ২...
জোটের দায়ে মন্ত্রিবদল
ঠিক কতটা সাংবিধানিক?
রেল বাজেট নিয়ে কংগ্রেস-তৃণমূল জোটনাট্য আপাতত শেষ হয়েছে। অন্তত আপাতত। কিন্তু এই ঘটনাবলি থেকে একটি মৌলিক প্রশ্নটি বেরিয়ে এসেছে। প্রশাসনের সাংবিধানিকতার প্রশ্ন। জোটনাট্যের বিচারে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী যথার্থই বলেছেন যে, যদি সনিয়া গাঁধীর মনমোহন সিংহকে প্রধানমন্ত্রী করার অধিকার থাকে, তবে তাঁরও অধিকার আছে কে রেলমন্ত্রী থাকবেন তা স্থির করার। নিহিতার্থ হল, কেন্দ্রীয় সরকার রেল দফতরটি কার্যত তৃণমূল কংগ্রেসের দফতর বা ওই দল কেন্দ্রকে সমর্থনের বিনিময়ে প্রাপ্ত হয়েছে। এত সরাসরি জোট রাজনীতির অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাকে এর আগে কেউ বেআব্রু করেছেন কি না জানা নেই। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে মমতাদেবী যে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন, তা তৃণমূল নেত্রী হিসেবেই করেছেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নয়।
আসলে আমরা ধরেই নিয়েছি, জোট সরকারে শরিকদের সমস্ত মত অবশ্যগ্রাহ্য, এবং দর কষাকষি এত দূর হতে পারে যে, তা ক্যাবিনেটের যুক্তিকাঠামোকে আঘাত করলেও কিছু আসে যায় না। অনেকে এমনও বলছেন যে, আমাদের সংবিধানে ব্রিটিশ ওয়েস্টমিনস্টারের যে ধাঁচটি গৃহীত হয়েছে, তাকে এ বার বর্জন করতে হবে। প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে আইনসভার উপর অতিনির্ভরতার ফলেই এই ধরনের সংকট তৈরি হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে মার্কিন রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের কাঠামো প্রবর্তন করলে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত আরও দ্রুত ও বলিষ্ঠ হতে পারে।
ঠিক, মার্কিন রাষ্ট্রপতি প্রশাসনের প্রকৃত (de facto) প্রধান হওয়ার দরুন তাঁর দল আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে পারল কি না, তা দিয়ে তাঁর প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হয় না। মনে রাখতে হবে যে, আর্থিক আয়ব্যয়ের হিসেব বা বাজেট কোনও নির্দিষ্ট বিল নয়, যাতে আইনসভার কোনও প্রবল ভূমিকা থাকতে পারে। সরকারের প্রশাসনিক কাজকর্ম চালানোর জন্য তা একটি একান্তই সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা। আইনসভায় তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হতে পারে, কিন্তু কোনও অবস্থাতেই তার বৈধতাকে প্রশ্ন করা চলে না। সে ক্ষেত্রে সরকারের সাংবিধানিক বৈধতাই প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ে।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিদেশ নীতি সংক্রান্ত প্রশ্নে আইনসভার দ্বিতীয় বা উচ্চ কক্ষ অর্থাৎ সেনেট-এর মুখাপেক্ষী থাকেন। কিন্তু প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁর ক্ষমতাকে বিচ্ছিন্ন করে এমন নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়েছে, যাতে কেউ কারও এক্তিয়ারে হস্তক্ষেপ করতে না পারে।
অনেকেরই এখন মনে হচ্ছে, ভারতে হয়তো-বা ওই রকম ব্যবস্থাই ভাল। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই বুঝতে পারব, এ দেশে প্রধানমন্ত্রীকেই সাংবিধানিক ভাবে যথার্থ প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে। মূল সংবিধানে কিছুটা ধোঁয়াশা থাকলেও ১৯৭০ সালে সঞ্জীবী বনাম স্টেট অব ম্যাড্রাস এবং ১৯৭৪ সালে ‘শামসের সিংহ’ বনাম ‘স্টেট অব পঞ্জাব’ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দিয়েছিল যে, রাষ্ট্রপতি প্রশাসনের নামসর্বস্ব প্রধান হলেও প্রকৃত প্রধান হলেন প্রধানমন্ত্রী। এই সূত্রেই ১৯৭৬ সালে ৪২তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ৭৪ নং ধারাটির ১ নং উপধারাটি পুনর্লিখিত হল এই ভাবে: There shall be a Council of Ministers with the Prime Minister at the head to aid and advise the President who shall, in the exercise of his functions, act in accordance with such advice.
অর্থাৎ, সাংবিধানিক ভাবে প্রধানমন্ত্রীই মন্ত্রিসভার প্রধান এবং তাঁর নেতৃত্বেই গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি কাজ করবেন। যদিও ইন্দিরা জমানার ওই সংশোধনীর উপর জনতা সরকার কলম চালিয়েছিল। ১৯৭৮ সালের ৪৪তম সংশোধনী অনুযায়ী বলা হয় যে, সবই ঠিক আছে, কিন্তু রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিসভার গৃহীত সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য এক বার ফেরত পাঠাতে পারেন, যদি পুনরায় একই সিদ্ধান্ত যায়, তবে রাষ্ট্রপতি তা মেনে নিতে বাধ্য থাকবেন।
প্রধানমন্ত্রীর প্রকৃত ক্ষমতা সাংবিধানিক ভাবেই রাষ্ট্রপতির অধিক, এমনকি তা শীর্ষ ন্যায়ালয়েরও অধিক। ওই ধারারই দ্বিতীয় উপধারায় বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্রপতিকে প্রদত্ত মন্ত্রিসভার পরামর্শ বিচারবিভাগীয় পর্যালোচনার আওতাধীন নয়। অবশ্য ১৯৯৪ সালে ‘এস আর বোম্মাই’ বনাম ‘ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া’ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, পরামর্শগুলি পর্যালোচনার অধীনে না এলেও, যে বস্তুগত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে তা দেওয়া হয়েছে, তা একান্ত ভাবেই বিচারবিভাগীয় পর্যবেক্ষণের আওতায় পড়ে।
সাম্প্রতিক ঘটনাবলি অতি স্পষ্ট ভাবে ওই সাংবিধানিক বৈধতার কেন্দ্রটিকে আঘাত করছে। রেলভাড়া বৃদ্ধির আর্থসামাজিক প্রভাব এই আলোচনার বিষয় নয়। সম্ভবত তার জন্য সংসদের বিতর্কই যথেষ্ট ছিল। একাধিক সংশোধনীর মাধ্যমে ওই বৃদ্ধিকে সাময়িক হ্রাস করার সুযোগ ছিল। কিন্তু যে ভাবে জোট শরিকের চাপের কাছে নত হয়ে প্রধানমন্ত্রীকে মন্ত্রিসভায় রদবদল ঘটাতে হল এবং সেই শরিককে একটি দফতরের একাধিপত্য দিয়ে দেওয়া হল, তা একান্ত ভাবেই প্রধানমন্ত্রীর প্রশাসনিক নেতৃত্বের যে যুক্তিকাঠামো রয়েছে, তার বিরোধী।
এমন কাণ্ড ঘটানোর সুযোগ তো অতীতের কংগ্রেস সরকারই করেছে। ‘আয়ারাম গয়ারাম’ রাজনীতি বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ১৯৮৫ সালে ৫২তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে দলত্যাগ-বিরোধী আইন চালু হল। বলা হল যে, কোনও সাংসদ বা বিধায়ক যদি স্বেচ্ছায় তাঁর দল ত্যাগ করেন, তবে তাঁর সাংসদ বা বিধায়ক পদটি যাবে। দল তাঁকে তাড়ালে অবশ্য সেই ভয় নেই। এর আওতাধীন নন বিধানসভা বা লোকসভার স্পিকার, বা রাজ্যসভার ভাইস চেয়ারম্যান। নিন্দুকেরা বলেন, যতই নৈতিকতার কথা বলা হোক, আসলে তৎকালীন সংসদে কংগ্রেস যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল, তাকে ধরে রাখার জন্যই ওই পদক্ষেপ। অনেকে এও বলেন যে, ওই আইনের দ্বারা আইনসভার অভ্যন্তরে সাংসদ বা বিধায়কদের ব্যক্তিগত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
সে না-হয় হল। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে ওই আইনটির সংশোধনী প্রয়োজন। কোনও রাজনৈতিক সমস্যা যদি পূর্বতন আইনটির নির্ণায়ক হয়, তবে বর্তমান পরিস্থিতি অবশ্যই তার পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। জোট রাজনীতির বাধ্যতা যদি প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীদের ক্যাবিনেটের নেতৃত্ব প্রদানে বাধা দেয়, তবে জোট সরকারের সাংবিধানিক রক্ষাকবচ প্রয়োজন। পঞ্চদশ আইন কমিশন ১৯৯৯ সালে ১৭০তম রিপোর্টে জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের বিষয়ে কিছু পরামর্শ দেয়। সেখানে বলা হয়, দলত্যাগ-বিরোধী আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনীর মাধ্যমে প্রাক্-নির্বাচনী দলীয় জোটকে একটি নির্দিষ্ট দলবদ্ধ রূপ হিসেবে দেখা উচিত। এই যুক্তিকে প্রসারিত করলে দেখা যাবে, জনগণকে প্রদত্ত আশ্বাস কোনও অবস্থাতেই নির্বাচনোত্তর কালে পাল্টানো চলবে না। তা ব্যক্তি সাংসদ বা বিধায়ক ও তাঁর দল, উভয়ের প্রতিই সমান প্রযোজ্য।
অথচ যে নির্বাচন-পরবর্তী জোট গড়ে উঠছে, তাকে কি ছাড় দেওয়া যায়? যদি ব্যক্তি সাংসদ বা বিধায়ক দলের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে পারেন, তা হলে দল কেন আইনসভার কাছে দায়বদ্ধ থাকবে না? রাষ্ট্রপতি বা রাজ্যপালের কাছে সরকারকে সমর্থনকারী দলগুলি যখন সাংসদ বা বিধায়কদের তালিকা জমা দেয়, তখন জানিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকা উচিত যে সেই সমর্থন পাঁচ বছরের জন্য। যে দল বিরোধী আসনে বসবে, সে-ও জানাতে বাধ্য থাকবে যে তার বিরোধিতা পুরো মেয়াদের জন্য। যখন খুশি অবস্থান বদলানো যাবে না। এতে নির্বাচিত আইনসভার স্থিতিশীলতা আসবে, দৃঢ় হবে সংসদীয় যুক্তিকাঠামো।
এমন নয় যে, সরকারের শরিক আইনসভায় সর্বদাই সরকারের অনুগত থাকবে। বরং, যদি দলীয় হুইপ শুধুমাত্র সরকারের প্রতি আস্থা বা অনাস্থা প্রস্তাবের ক্ষেত্রে পূর্বনির্ধারিত শর্ত অনুসারে নির্দিষ্ট থাকে, তবে অবশ্যই আইনসভায় ব্যক্তি সাংসদ বা বিধায়ক এবং তাঁর দলের প্রতিটি বিষয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতা অনেক বাড়বে। সে ক্ষেত্রে কখনও মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ, কখনও বা মমতাদেবীর চিন্তাধারা যতই সমাজ ও সংসদকে আলোড়িত করুক, তা কিছুতেই সরকার বা আইনসভার স্থিতিশীলতার প্রতি হানিকর হবে না।

বঙ্গবাসী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.