ইন্টিগ্রেটেড চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট (সংক্ষেপে আইসিডিএস) প্রকল্প সম্পর্কে আমার একটি পযর্বেক্ষণ সংবাদপত্রের পাঠকদের সামনে তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি।
কেন্দ্রীয় সরকার পরিকল্পিত এবং কেন্দ্র-রাজ্য যৌথ উদ্যোগে চলা এই আইসিডিএস প্রকল্প এ রাজ্যে পরিচালনার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার সম্প্রতি একটি পৃথক দফতর তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই নতুন দফতর তৈরির ব্যাপারে পূর্বে আইসিডিএস প্রকল্প পরিচালনার ভারপ্রাপ্ত নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ দফতরের মাননীয়া মন্ত্রীর ক্ষোভের কথাও সকলের জানা। আইসিডিএস চলে গেলে নাকি তাঁর দফতরে আর কিছুই পড়ে থাকবে না। দুটি বিষয় থেকেই পরিষ্কার ভাবে বোঝা যায়, প্রকল্পটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। প্রকল্প পরিচালনার জন্য পৃথক দফতর থাকলে কাজে গতি আসবে সন্দেহ নেই। কিন্তু কেবল প্রশাসনিক বিষয়ে আটকে না-থেকে তৃণমূল স্তরে কী ভাবে কতটা কাজ হচ্ছে সে দিকেও নজর দেওয়া দরকার।
এমবিবিএস পাঠ্যক্রমের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র হিসাবে কিছু দিন আগে সোনারপুরে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র পরিদর্শনের সময়ে সেখানে চিকিৎসার জন্য আসা একটি শিশু আমাদের নজরে আসে। মায়ের কোলে থাকা শিশুটিকে দেখে মনে হয়, সে অপুষ্টিতে ভুগছে। আমরা শিশুটির ওজন নিই। দেখা যায়, তা হল চার কিলোগ্রাম। তার বয়স জানা যায়, নয় মাস। ভারতে শিশুদের ‘গ্রোথ মনিটরিং’-এর জন্য অঙ্গনওয়াড়ি সেন্টারগুলিতে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন প্রণীত যে-স্ট্যান্ডার্ড ব্যবহৃত হয়, তা অনুযায়ী শিশুকন্যাটি ‘সিভিয়ারলি আন্ডারওয়েট’। শিশুটির ‘গ্রোথ চার্ট’ দেখা সম্ভব হয়নি। তাই তার বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বোঝা সম্ভব হয়নি। |
নানুর আটকুলা গ্রামের একটি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি |
এর পর তার মায়ের সঙ্গে আমাদের যে-কথোপকথন হয়, তা ছিল এ রকম:
‘বাচ্চার ওজন কম আছে। ওকে অঙ্গনওয়াড়ি সেন্টারে নিয়ে যান না?’
‘না।’
‘ওকে তা হলে বাড়িতেই খাওয়ান?’
‘না। পাশের বাড়িতে খায়’।
‘পাশের বাড়িতে খায় কেন?’
‘ওখানে খিচুড়ি হয়, দিদিমণি আসে একজন। খাওয়ায়।’
বোঝা গেল, ভদ্রমহিলা অঙ্গনওয়াড়ি সেন্টার নামটি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন।
‘ওখানে কী কী দেয় খেতে?’
‘খিচুড়ি, ডিম।’
‘সেটা ও খায়?’
‘হ্যাঁ।’
‘ওখানে বসিয়ে খাওয়ায়?’
‘না, বাড়িতে নিয়ে এসে খাওয়াই।’
‘ওখানে যা দেয়, সবটা খায় তো?’
‘সবটা মানে...ওর দাদা আছে, তাকে কিছুটা দিই, একে কিছুটা দিই।’
সুতরাং বিষয়টা দাঁড়াল, শিশুটি অঙ্গনওয়াড়ি সেন্টারে যাচ্ছে। সেখানে তার বরাদ্দ খাবার নিচ্ছে। কিন্তু সবটা সে খাচ্ছে না। ফলে, অপুষ্টি। এখানে কিন্তু কোনও নিয়মপালনে ফাঁক নেই। তিন বছরের কম বয়স্ক শিশুদের ‘টেক হোম রেশন’ ভিত্তিতেই খাবার সরবরাহ হওয়ার কথা। তাই হয়েছে। সমস্ত লিখিত তথ্য পর্যালোচনা করেও বিষয়টি ধরা যাবে না। অঙ্গনওয়াড়ি সেন্টার পরিদর্শক মুখ্য সেবিকা যদি শুধু রেকর্ডই দেখেন, বাড়ি বাড়ি পরিদর্শন না-করেন, তবে অপুষ্টির কারণটিও সামনে আসা মুশকিল।
সুতরাং, উপযুক্ত নীতি প্রণয়ন এবং তার প্রয়োগ করেও অপুষ্টি রোধ করা সম্ভব হল না। এই শিশুটির অপুষ্টির ক্ষেত্রে কারণ হিসাবে যে-দুটি বিষয় সামনে আসছে, তা হল দারিদ্র ও অশিক্ষা। ভাল বাংলায় সচেতনতার অভাব। দারিদ্র যাতে অপুষ্টির পথে বাধা না-হয়ে দাঁড়ায়, সে জন্য আইসিডিএস প্রকল্প। এবং সেই প্রকল্পের একটি ব্যর্থতার কারণ আবার সেই দারিদ্র। বিষয়টি লক্ষ করার মতো। অতএব নতুন গঠিত দফতর কেবল নীতি প্রণয়ন ও তার প্রয়োগে ব্যস্ত না থেকে নীতি প্রয়োগের উপযুক্ত পরিদর্শন এবং সেই অনুযায়ী নীতি পরিবর্তনের কাজটিও সমান গুরুত্ব সহকারে করবেন, এই আশা রাখছি।
অনুপম ব্রহ্ম। যাদবপুর, কলকাতা-৩২
|
আমরা বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজ নিজেদের স্বভাব আর দৃষ্টিভঙ্গি বদলাব না। আবার আমরাই সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবনের কথা মহা গৌরবে ঘোষণা করে যাব। বর্ষীয়ান প্রাবন্ধিক অশোক মিত্র তাঁর লেখায় নিম্নবর্গের প্রতি বাঙালি আচরণের অমানবিক দিকটি পুনর্বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন (১৩-৩)।
উচ্চবর্ণের বাঙালি কিংবা উচ্চপদস্থের কাছে নিম্নবর্গীয় কিংবা পিছিয়ে-থাকা অসচ্ছলরা অপমান আর লাঞ্ছনাই কুড়িয়েছেন। আর এ-অবজ্ঞার সংস্কৃতি শতাব্দীপ্রাচীন। বাবু-বাঙালি ভৃত্যসেবা না-পেলে, অফিসের মধ্যে বেয়ারা কিংবা বেড়াবার জায়গায় স্থানীয় গরিবদের দু’চার জনকে জো-হুজুর ভঙ্গিমায় দেখতে না-পেলে অস্বস্তিতে পড়ে। ভোজনরসিক বাঙালির প্রসিদ্ধি মান্য। কিন্তু দূরগ্রামের চড়ুইভাতি কিংবা ভ্রমণকালে আদিবাসী ঘরের মুরগি দেখে এমন হামলে পড়ার কারণ কী কে জানে!
শহরজীবনে ক্লান্ত হয়ে দু’চার ঘণ্টা ফুর্তির জন্য জেলা মফস্সলের কোনও গ্রাম এলাকা বেছে নেওয়ার অভ্যাসটা দিব্যি চালু আছে আমাদের। শিক্ষা এবং সম্বলে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর প্রতি হেয় মনোভাব দেখানো কিংবা ঠকিয়ে কিছু আদায় করতে আজও আমাদের বাধে না। ভ্যান বা রিকশাচালকদের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে দর কষাকষি অনেক সময় এমন কুরুচিকর হয়ে ওঠে যে, তা বাদ-বিতর্কে পৌঁছে যায়।
চাকুরে মানসিকতায় যে অদ্ভুত শ্রমবিমুখতা গড়ে ওঠে, তাতে প্রচ্ছন্ন থাকে কায়িক শ্রমের প্রতি এক ধরনের ঘৃণাবোধ। ঘৃণার এ-ভাব থেকেও আমরা শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা অনেক সময় অধস্তন কিংবা গতর-খাটা মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধাহীন আচরণে লিপ্ত হই। আমাদের এ-অভ্যাসটাও লোপ পায়নি।
তবু মধ্যবিত্ত বাঙালি ভাবপ্রবণ এবং সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কে অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর বলে গরিব মানুষের সমাবেশ ঘটিয়ে সংগ্রাম ও আন্দোলনে আজও শামিল হয়। প্লিবিয়ানদের সম্পর্কে শ্রদ্ধাহীনতা এবং সহমর্মিতা বিপরীতধর্মী এমন দ্বৈততায় আটকে থাকে বাঙালির মন ও স্বভাব। দলিত সমাজ নিয়ে আন্দোলন দানা বাঁধলেও গরিব-গুরবোদের জীবন তাই বদলায় না। শেষমেশ অ্যাকাডেমিক চর্চার বিষয় হয়ে যায়।
আদিবাসী, গরিব মানুষের জীবন তাই যে তিমিরে সে তিমিরেই।
শিবাশিস দত্ত। কলকাতা-৮৪ |