তর্কশীল কাহাকে বলে, অধ্যাপক অমর্ত্য সেন তাহার এক রূপ ব্যাখ্যা দিতে পারেন। আইনসভায় তাহার অন্য চেহারা। বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন প্রসঙ্গ লইয়া শাসক এবং বিরোধী পক্ষের বাদানুবাদে সেই চেহারাটি বাহির হইয়া পড়ে। সেই তর্কশীলতার ভিতর যুক্তির প্রক্ষেপ কম, অন্য পক্ষকে আঘাত করিবার মানসিকতাই প্রাণপণ। সুতরাং, আঘাত করিবার জন্য যদি ‘অসংসদীয়’ শব্দ ব্যবহার করিতে হয়, তাঁহারা পিছপা হইতে নারাজ। বড় জোর, সভার কার্যবিবরণী হইতে মন্তব্যটি বাদ যাইবে, কিছু (মৃদু) ভর্ৎসনাও জুটিতে পারে। কিন্তু, বল্গাহীন মুখ ছুটাইবার যে বীরত্ব, সেই ব্রহ্মাস্বাদ হইতে বক্তাকে বঞ্চিত করে সাধ্য কাহার? এই ভাবে আইনসভার ভিতরে কুরুচিকর মন্তব্যের ফোয়ারা ছুটিতে থাকে। কী ভাবে তাহা রোধ করা যায়? কেহ ‘অসংসদীয়’ শব্দের তালিকা দেখিবার শলা দিয়াছেন। পরামর্শটি ভাল, কিন্তু গ্রন্থপাঠে মানসিকতার পরিবর্তন হইবে কি? বিশেষত, সেই মানসিকতা যাহা যে কোনও মূল্যে আইনসভার ভিতর অন্য স্বরকে থামাইয়া দিবার কাজকেই প্রকৃত জনপ্রতিনিধি হইবার যোগ্যতা বলিয়া মনে করে। এই বিষয়ে শাসক এবং বিরোধী পক্ষের ভিতরে কোনও ভেদ নাই। কারণ, প্রতর্ক যে ন্যূনতম সহবৎ দাবি করে, তাহা মানিবার ব্যাপারে উভয় পক্ষই একই রকম অনিচ্ছুক। আইনসভাকে উভয় পক্ষই গ্রাম্য চণ্ডীমণ্ডপের এক প্রকার সম্প্রসারিত অংশ বলিয়া ধরিয়া লয়। তাই, খেউড় চলে নির্বিবাদে। তাহাতে মনে কোনও গ্লানি আসে না।
অথচ, এই গ্লানিটি আসা প্রয়োজন ছিল। কারণ, সেই গ্লানি প্রকৃতপক্ষে আত্মবীক্ষণেরই নামান্তর। সেই বীক্ষণটি অনুপস্থিত, ফলে গ্লানিরও প্রশ্ন উঠে না। সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় জনৈক বিধায়ক বক্তৃতাক্রমে ‘চাপরাশি’ শব্দটি উল্লেখ করিয়াছেন। কথার অনুক্রমটি ধরিলে বুঝা যায়, ঈষৎ ব্যঙ্গার্থে এবং হীনার্থেই এই উল্লেখ। ‘চাপরাশি হইতে মুখ্যমন্ত্রী’ যাবতীয় কাজই মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং করিতেছেন, ইহাই বিধায়কপ্রবরের অনুযোগ। তর্ক উঠিয়াছে, ইহাতে মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি অসম্মান জ্ঞাপন করা হইয়াছে। পরিণামে, মন্তব্যটি সভার কার্যবিবরণী হইতে বাদ যায়। অন্য দিকে, বিধানসভায় বিরোধী দলনেতার বক্তব্য, ‘চাপরাশি’ শব্দটি কি গর্হিত? যদি না হয়, তাহা হইলে কেন ইহাকে ‘অপমানকর’ বলিয়া গ্রহণ করা হইবে? দুই তরফের এই বাদানুবাদের ভিতর একটি কথা আড়ালেই থাকিয়া যাইতেছে। তাহা সংক্ষিপ্ত। ‘চাপরাশি’ শব্দটি গর্হিত নহে, ঠিক। রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীকে চাপরাশির সহিত তুলনা করাও বিশেষ রুচিকর নহে। কিন্তু, ‘চাপরাশি’ শব্দটি এই মন্তব্যে যে ধরনের হীনার্থে ব্যবহৃত হইয়াছে, তাহা চাপরাশিদের পক্ষেও আদপেই সম্মানজনক নহে। মুখ্যমন্ত্রীর ‘অপমান’ লইয়া নিশ্চিত ভাবেই সতর্ক থাকা জরুরি, কিন্তু অন্য সকলের (অ)সম্মানের প্রসঙ্গটিও একই রকম খেয়াল রাখা প্রয়োজন। এই মনোভাবটি নানা সময় আড়ালেই থাকে। সে ক্ষেত্রে বুঝিতে হইবে, গভীরে কোথাও সংবেদনশীলতার অভাব ঘটিয়াছে। নিছকই ‘অসংসদীয়’ শব্দের তালিকা মুখস্থ করিয়া সেই সংবেদনটি আয়ত্ত করা শক্ত। কার্যত, অসম্ভব। এই ধরনের তালিকা বড়জোর অশ্লীলতায় কিছু রাশ টানিতে পারে, কিন্তু মনোভঙ্গির বদল ঘটাইতে পারিবে না। প্রকৃত প্রস্তাবে, ইহা মানসিকতার প্রশ্ন। কোন শব্দ কোথায় কী ভাবে ‘অসংসদীয়’ হইয়া উঠে, তাহা সেই শব্দের ব্যবহার হইতে বুঝা যায়। সেই খেয়ালটি না থাকিলে নিছক গ্রন্থপাঠে কাজের কাজ হইবার সম্ভাবনা কম। |