একটি পুরাতন বাংলা গানের ভাষা ধার করিয়া বলা সম্ভব ‘যে পথে গিয়াছ তুমি, আজ সেই পথে হায়, আমার ভুবন হইতে লুফ্তহানসা চলিয়া যায়’। গানে সম্বোধিত মধ্যমপুরুষ একবচনটিকে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ বলিয়া ভাবিয়া লইলে কোনও দোষ নাই। তাহারই দেখানো পথে কলিকাতা ত্যাগ করিল জার্মান বিমানসংস্থা লুফ্তহানসা। রবিবার সকালে সংস্থাটির শেষ উড়ান কলিকাতা বিমানবন্দর ছাড়িল, ইউরোপের সহিত অতীতের ‘দ্বিতীয় লন্ডন’-এর আর কোনও সরাসরি যোগ রহিল না। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ বা এয়ার ইন্ডিয়া যে যুক্তিতে কলিকাতা ছাড়িয়াছে, লুফ্তহানসাও সেই যুক্তিই পেশ করিয়াছে কলিকাতা লাভজনক নহে। ইউরোপ হইতে এই শহরে বিমান চালাইলে আসন ভরে না, বিশেষত বিজনেস ক্লাস-এর সিংহভাগ আসনই খালি পড়িয়া থাকে। একটি শহর সম্বন্ধে বেশ কয়েকটি বিমানসংস্থা একই কথা বলিলে সংশয়াতীত ভাবে বোঝা যায়, শিল্পবাণিজ্যের দুনিয়ায় শহরটির আর কোনও গুরুত্ব নাই। যাঁহাদের নিকট একটি শহর গুরুত্বপূর্ণ হইলে সেই শহরের, সংশ্লিষ্ট রাজ্যের উন্নতি ঘটে, তাঁহারা আর কলিকাতাকে লইয়া ভাবেন না। কলিকাতা তাঁহাদের নিকট মৃত শহরের অতীত গরিমার আর কোনও বর্তমান দ্যুতি নাই। বিনিয়োগের দুনিয়ায় এই বার্তাটি সংক্রামক। অন্যরা কোন শহর বা রাজ্যকে পছন্দ করিতেছে অথবা করিতেছে না, ইহা প্রত্যেক বিনিয়োগকারীর নিকট অতি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য। কোনও শহরের পরিবেশ বিনিয়োগের অনুকূল কি না, তাহা বুঝিবার ইহা একটি বিশেষ মাপকাঠি। কলিকাতা সেই মাপকাঠিতে আরও এক বার ফেল করিল। ফলে, আন্তর্জাতিক উড়ানের মানচিত্রের মতো বিনিয়োগকারীদের মানচিত্র হইতেও যে কলিকাতা, এবং পশ্চিমবঙ্গ, ক্রমে মুছিয়া যাইবে, তাহাতে আর বিস্ময়ের অবকাশ নাই।
বিস্ময়ের কোনও কারণও নাই। এই পরিস্থিতি হওয়ারই ছিল। পূর্বতন সরকার তাহার শিল্প-বিরোধিতায় নাম কিনিয়াছিল। শেষ বেলায় যখন তাহার হুঁশ হইল, তখন রাজনীতির ঘোলা জলে সেই সচেতনতা বেবাক তলাইয়া গেল। সরকার পাল্টাইয়াছে, ঘোলা জলটি পূর্ববৎ রহিয়াছে। বর্তমান সরকার কদাচিৎ মুখে শিল্পের কথা বলিয়া থাকে বটে, কিন্তু তাহাতে যে মন নাই, সেই প্রমাণ বিস্তর। বস্তুত, শিল্প বিষয়ে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর মানসিকতা তাঁহার এক পূর্বসূরির ন্যায়। সেই পূর্বসূরির নাম জ্যোতি বসু। শ্রীবসু যেমন প্রত্যাশা করিতেন, শিল্পপতিরা নিজেদের তাগিদেই আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের সম্মুখে লাইন লাগাইবেন, শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায়ও তাঁহার অতিরিক্ত বিশেষ কিছু ভাবেন বলিয়া প্রত্যয় হয় না। বৎসরের গোড়ায় ‘বেঙ্গল লিডস’ নামক একটি সম্মেলনের আয়োজন করা হইয়াছিল। মুখ্যমন্ত্রী সেই সম্মেলনে বলিয়াছিলেন, শিল্পপতিরা আসিলে জমির ব্যবস্থা হইয়া যাইবে। সেই জমি কোথা হইতে আসিবে, জমি জোগাড় করিবার ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা কী হইবে এই প্রশ্নগুলি অমীমাংসিতই থাকিয়া গিয়াছিল। মুখ্যমন্ত্রী সম্ভবত ভুলিয়া গিয়াছিলেন যে তাঁহার দলের কর্মীদের সহিত শিল্পপতিদের ফারাক আছে প্রথম দলের নিকট যেমন তাঁহার মুখনিঃসৃত বাণীই যথেষ্ট, দ্বিতীয় দলের ক্ষেত্রে তাহা নহে। কলিকাতামুখী আন্তর্জাতিক বিমানের আসন কেন ফাঁকা পড়িয়া থাকে, তাহা বুঝিতে আর অসুবিধা হওয়ার কথা নহে। বিমানগুলির লাভের গুড় অবশ্য শুধু যাত্রীর অভাবেই মারা যায় না, কলিকাতা বিমানবন্দরে জ্বালানি নিলে তাহার দামও অন্য বিমানবন্দরের তুলনায় বেশি পড়ে। কারণ, জ্বালানির উপর বিক্রয় কর এই রাজ্যে অতি চড়া। কেহ বলিতেই পারেন, দিল্লির নূতন বিমানবন্দরে তো বিপুল পরিমাণ পরিষেবা কর দিতে হয়। তাহাতে কি দিল্লিতে উড়ানের সংখ্যা কমিয়াছে? এই প্রশ্নের উত্তরে একটিই কথা বলিবার গন্তব্য হিসাবে কলিকাতা দিল্লির তুল্য হইলে এই শহরেও প্রভাব পড়িত না। কিন্তু যে শহর লাভ দিতে পারে না, তাহার বাড়তি কর সহ্য হইবার নহে। |