সেনাপ্রধান জেনারেল ভি কে সিংহের অভিযোগ গুরুতর। কিন্তু, আরও গুরুতর প্রশ্ন তুলে দিলেন প্রাক্তন সেনাপ্রধান জেনারেল শঙ্কর রায়চৌধুরী। তাঁর বক্তব্য, সেনাবাহিনীতে ব্যবহৃত প্রায় সব গাড়িই সরকারি কারখানায় তৈরি হয়। সরকারের তৈরি গাড়ি ব্যবহারের জন্য কেনই বা ঘুষের প্রস্তাব দেওয়া হবে?
ভি কে সিংহের দাবি, সেনাবাহিনীতে এমন সাত হাজার গাড়ি ব্যবহার করা হচ্ছে, যেগুলি ভাল ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা যায় না। অথচ, আগে সেই সব গাড়ি কেনা হয়েছে। ওই ধরনের আরও ৬০০টি গাড়ি কেনার জন্যই তাঁকে
প্রাক্তন এক সেনা অফিসার ১৪ কোটি টাকা ঘুষের প্রস্তাব দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন ভি কে সিংহ। শঙ্করবাবুর মতে, বফর্স কেলেঙ্কারির পরে সেনাবাহিনীতে এত বড় দুর্নীতির অভিযোগ আর আসেনি। তাঁর বক্তব্য, “এক জন সেনাপ্রধান যখন অভিযোগ করছেন, তখন তার গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু, আমার মাথাতেই আসছে না, উনি কোন গাড়ির কথা বলছেন?” প্রাক্তন সেনাপ্রধান বলেছেন, জোঙ্গা জিপ, মালবাহী গাড়ির মতো যে সব গাড়ি সেনাবাহিনীতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়, তা তো সরকারি কারখানাতেই তৈরি হয়। তাহলে সে সব গাড়ি ব্যবহারের জন্য কেন ঘুষের প্রস্তাব দেওয়া হবে?
|
প্রাক্তন সেনাপ্রধান জেনারেল
শঙ্কর রায়চৌধুরী |
ভি কে সিংহ অভিযোগ করার পরে ‘কোলাস টেট্রা’ নামে একটি বড় গাড়ির নাম উঠে আসছে। বলা হচ্ছে, সেনাপ্রধান ওই গাড়ির কথাই নাকি বলতে চেয়েছেন। শঙ্করবাবু জানিয়েছেন, “ আমার সময়ে বিদেশে তৈরি এই গাড়ি ব্যবহার করা হয়েছে।” তাঁর মতে, মাল বহন, ট্যাঙ্ক টেনে নিয়ে যাওয়া, যুদ্ধক্ষেত্রে উদ্ধারকার্য চালানোর মতো বিভিন্ন কাজে পারদর্শী ‘কোলাস টেট্রা’। এক কথায় চমৎকার গাড়ি। শঙ্করবাবু বলেছেন, “তখনই কথা হয়েছিল, ওই গাড়ি ভারতে বানানো হবে। তার পরে কী হয়েছে তা আমার জানা নেই।”
১৯৯৪ সাল থেকে দু’বছরেরও বেশি সময় সেনাপ্রধানের দায়িত্বে ছিলেন শঙ্করবাবু। তাঁর মতে, সেনাবাহিনীতে এমন কোনও গাড়িই থাকতে পারে না যা রক্ষণাবেক্ষণের সুযোগ নেই। বেসরকারি কারখানায় তৈরি গাড়ি খুব কমই ব্যবহার করা হয়। শঙ্করবাবুর কথায়,“ শুনলাম জেনারেল (ভি কে সিংহ) প্রতিরক্ষা মন্ত্রককে বিষয়টি জানিয়েছেন। জানা দরকার, এত দিন ধরে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক তদন্ত করে কিছু পেল কি না!”
ভি কে সিংহের অভিযোগ অনুযায়ী, যে ব্যক্তি তাঁকে ঘুষ দিতে এসেছিলেন, তিনি নাকি বলেছেন, আগের সেনাপ্রধানেরা ঘুষ নিয়েছেন! শঙ্করবাবুর কথায়, “সেনাপ্রধান হিসেবে আমাকেও দেশি-বিদেশি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দেখা করতে হয়েছে। অনেকেই তাদের তৈরি গাড়ি বা উপকরণ ব্যবহার করার জন্য অনুরোধ করেছেন। কিন্তু, তার জন্য কখনও সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ঘুষের প্রস্তাব আসেনি।” একজন সেনাপ্রধানের কাছে গিয়ে সরাসরি তাঁকে এই প্রস্তাব দেওয়ার দুঃসাহস একজন প্রাক্তন সেনা অফিসারের কী করে হল সে প্রশ্নও তুলেছেন শঙ্করবাবু।
শঙ্করবাবু জানিয়েছেন, বফর্স নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হলেও তা নিয়ে কোনও দুর্নীতি এখনও প্রমাণিত হয়নি। উল্টে কার্গিল যুদ্ধে বফর্সের ভূমিকা নিয়ে সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। শঙ্করবাবু বলেছেন, “ স্বাধীনতার ঠিক পরেই পণ্ডিত নেহরু যখন প্রধানমন্ত্রী, কৃষ্ণমেনন প্রতিরক্ষামন্ত্রী, তখন ইংল্যান্ড থেকে জিপ কেনা নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। কিন্তু, সেনাবাহিনীকে ঘিরে এই ধরনের বিতর্ক বেশি হয়নি।” |
বিতর্কে প্রতিরক্ষা |
১৯৪৮ |
• জিপ কেলেঙ্কারিব্রিটেনে তৎকালীন হাইকমিশনার ভি কে কৃষ্ণ মেনন প্রোটোকল অগ্রাহ্য করে ৮০ লক্ষ টাকায় সেনাবাহিনীর জিপ কেনার চুক্তি করেন বলে অভিযোগ |
১৯৮৭ |
• বফর্স কেলেঙ্কারিএ বি সংস্থার হাউইৎজার কামান ভারতকে বিক্রির জন্য ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ। জড়িয়েছিল প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধীর নামও। পরে দিল্লি হাইকোর্টে অভিযোগমুক্ত রাজীব এবং অভিযুক্ত হিন্দুজা ভাইরা ২০০১ বারাক কেলেঙ্কারি |
২০০১ |
• বারাক কেলেঙ্কারি ইজরায়েলের কাছ থেকে বারাক ক্ষেপণাস্ত্র কেনায় ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ। নাম জড়ায় জর্জ ফার্নান্ডেজ, জয়া জেটলি, প্রাক্তন নৌ-কর্তা সুরেশ নন্দের। |
২০০২ |
• কফিন কেলেঙ্কারিকার্গিল যুদ্ধে নিহত ভারতীয় সেনাদের জন্য অত্যধিক বেশি দামে কফিন কেনার অভিযোগ। তিন সেনা কর্তা অভিযুক্ত। |
২০০৫ |
• ওয়ার রুম কেলেঙ্কারিনয়াদিল্লিতে নৌবাহিনীর ‘অপারেশনস ডিরেক্টরেট’ থেকে ভবিষ্যতের অস্ত্র কেনাসংক্রান্ত তথ্য পাচার। প্রাক্তন সেনাকর্তা ও অস্ত্র ব্যবসায়ী রবিশঙ্করন, অভিষেক বর্মার কাছে সেই তথ্য যায়। বরখাস্ত তিন সেনা অফিসার। |
২০০৫ |
• ডেনেল কেলেঙ্কারি দক্ষিণ আফ্রিকার সংস্থা ডেনেল-এর ৪০০টি অ্যান্টি-মেটেরিয়াল রাইফেল কেনায় দুর্নীতির অভিযোগ। পরে চুক্তি বাতিল। |
২০০৬ |
• সাবমেরিন কেলেঙ্কারিথেলস সংস্থার সাবমেরিন কেনায় টাকা লেনদেনের অভিযোগ। প্রধান অভিযুক্ত তৎকালীন নৌপ্রধান অরুণ প্রকাশের আত্মীয় রবিশঙ্করন |
২০০৮ |
• রেশন কেলেঙ্কারিসেনা জওয়ানদের জন্য অত্যন্ত নিম্ন মানের চাল-ডাল-দুধ-ডিম কেনার ঘটনা ফাঁস সিএজি রিপোর্টে |
২০০৯ |
• সুকনা কেলেঙ্কারিশিলিগুড়ি থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে সুকনার সেনা ছাউনি লাগোয়া জমি ‘লিজ’ নেওয়া ঘিরে দুর্নীতির অভিযোগ। ওই জমিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়তে সেনা এবং চারটি চা বাগান সংস্থার মধ্যে চুক্তি। শাস্তি লেফটেন্যান্ট জেনারেল অবধেশ প্রকাশ ও পি কে রথের। |
২০১০ |
• আদর্শ আবাসন কেলেঙ্কারিমহারাষ্ট্রে কার্গিল শহিদদের জন্য তৈরি আদর্শ আবাসনের ফ্ল্যাট পেলেন অন্যরা। উপকূল নিরাপত্তা বিধিও মানা হয়নি। গ্রেফতার তিন সেনাকর্তা। |
|