|
|
|
|
|
ঘুষের ‘প্রস্তাব’ সেনাপ্রধানকেই |
এত দিন চুপ কেন, প্রশ্ন উঠল তা নিয়েও
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
|
বয়স-বিতর্কের রেশ মিটতে না মিটতেই ফের তোলপাড় ফেলে দিলেন সেনাপ্রধান জেনারেল বিজয় কুমার সিংহ।
নিম্ন মানের ৬০০টি গাড়ি কেনার জন্য এক প্রাক্তন সেনা-অফিসারই তাঁকে ১৪ কোটি টাকা ঘুষ দিতে চেয়েছিলেন বলে সেনাপ্রধান অভিযোগ তুলেছেন। তাঁর দাবি, বিষয়টি তিনি সঙ্গে সঙ্গে প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনিকে জানিয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, বর্তমানে সেনাবাহিনীতে ওই নিম্ন মানের ৭ হাজারটি গাড়ি চলছে এবং অনেক বেশি টাকা দিয়ে সেগুলো কেনা হয়েছিল বলেও এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন সেনাপ্রধান। তাঁর বক্তব্য, ঘুষ দিতে চেয়ে ওই ব্যক্তি তাঁকে বলেছিলেন, ‘আপনার আগেও অনেকে টাকা নিয়েছে, আপনার পরেও সবাই নেবে। টাকা নিতে আপনার অসুবিধা কোথায়?’ এই অভিযোগ ঘিরে সংসদের দুই কক্ষেই আজ
বিরোধীরা সরব হয়েছেন। যার জেরে দফায় দফায় অধিবেশন মুলতুবি হয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই অভিযোগের সিবিআই তদন্ত হবে। সিবিআই-ও শীঘ্রই এফআইআর দায়ের করতে চলেছে বলে সূত্রের খবর।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যান্টনি বলেছেন, “বিষয়টি গুরুতর। আমি ব্যবস্থা নিয়েছি।” তবে সত্যিই তাঁকে সেনাপ্রধান বিষয়টি জানিয়ে ছিলেন কি না, তা নিয়ে মুখ খুলতে চাননি অ্যান্টনি। সরকারি সূত্রের খবর, আগামিকাল প্রতিরক্ষামন্ত্রী গোটা বিষয়টি নিয়ে সংসদে বিবৃতি দিতে পারেন। |
সিংহের তোপ |
• ৬০০ নিম্নমানের সেনাযান কেনার জন্য ১৪ কোটি টাকা ঘুষ দিতে চেয়েছিলেন
প্রাক্তন সেনা অফিসার।
• আমাকে বলেছিল, আপনার আগেও সবাই টাকা নিয়েছে, পরেও নেবে, আপনার আপত্তি কেন?
• নিম্নমানের ৭ হাজার যান সেনা ব্যবহার করছে।
অনেক বেশি টাকা দিয়ে এগুলি কেনা হয়েছিল।
• প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে জানিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন এদের দূরে রাখতে হবে।
• সেনায় দুর্নীতি ক্যানসারের মতো।
বড় অস্ত্রোপচার দরকার।
|
|
সেনাপ্রধানের এই অভিযোগে রাজনৈতিক শিবিরে দু’টি বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। সকলেই একমত, সমাজের বাকি ক্ষেত্রের মতো সামরিক বাহিনীতেও প্রবল ভাবে দুর্নীতি ছড়িয়েছে এবং সেনাপ্রধানের বক্তব্যে তা আরও স্পষ্ট হল। ভি কে সিংহ সংবাদপত্র এবং টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নিজেই স্বীকার করেছেন যে সেনাবাহিনীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে। এই ক্যান্সার সারাতে বড় ধরনের অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। পাশাপাশি, এই অভিযোগ তোলার পিছনে সেনাপ্রধানের নিজস্ব কোনও উদ্দেশ্য রয়েছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কংগ্রেস ও বিজেপি, দুই দলই প্রশ্ন তুলেছে, সেনাপ্রধান এত দিন লিখিত অভিযোগ করেননি কেন? প্রতিরক্ষামন্ত্রীর কাছে মৌখিক অভিযোগ করার পরেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া না হলে, তিনি এত দিন চুপ করেছিলেন কেন? বয়স-বিতর্কে তাঁর বয়স এক বছর কম বলে সেনাপ্রধান যে দাবি করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত তা ধোপে টেকেনি। আগামী ৩১ মে-ই তাঁকে অবসর নিতে হবে। তাঁকে অবসরের নোটিস ধরানো হয়ে গিয়েছে। উত্তরসূরির নামও ঘোষিত। অবসরের আগে ঠিক এই সময়টাকেই কেন ভি কে সিংহ দুর্নীতির অভিযোগ তোলার জন্য বেছে নিলেন, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে, সেনাপ্রধানের এই ভাবে মুখ খোলার পিছনে দু’টি উদ্দেশ্য থাকতে পারে। এক, মনমোহন-সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলা। দুই, সেনাবাহিনীর মধ্যেই তাঁর বিরোধী গোষ্ঠীর অফিসারদের দিকে আঙুল তোলা। যাঁর মধ্যে তাঁর পূর্বসূরিরাও রয়েছেন। কে তাঁকে ঘুষ দিতে চেয়েছিলেন, তা নিয়ে অবশ্য সেনাপ্রধান মুখ খোলেননি। কিন্তু ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে, সেনাপ্রধান অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল তেজেন্দ্র সিংহের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। কারণ কিছু দিন আগে প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনির দফতরের টেলিফোনে আড়ি পাতার অভিযোগ ওঠে। সে সময় সেনাবাহিনীর তরফে আড়ি পাতার কথা অস্বীকার করে বলা হয়েছিল, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা (ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি)-র প্রাক্তন প্রধান তেজেন্দ্র এই সব অপপ্রচার করছেন। তিনি একটি বেসরকারি সংস্থার তরফে সেনাকর্তাদের ঘুষ দিতে চেয়েছিলেন বলেও সে সময়ই জানানো হয়। এই তেজেন্দ্র আবার প্রাক্তন সেনাপ্রধান দীপক কপূরের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিলেন। সরকারি নথিতে তাঁর জন্মসাল ভুল থেকে যাওয়ার জন্য কপূরকেই দায়ী করেন ভি কে সিংহ। আজ তেজেন্দ্র সিংহ অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছেন, অবসরের পরে তিনি কোনও বেসরকারি প্রতিরক্ষাসরঞ্জাম সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হননি। দীপক কপূরের মন্তব্য, “এই অভিযোগ সম্পর্কে মন্তব্য করতে আমার মর্যাদায় বাধে।” জেনারেল সিংহের আবার তির্যক মন্তব্য, “সময় আসুক, এই নাটকের সূত্রধর কে, আপনারা জানতে পারবেন।” বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আবার অভিযোগ ওঠে, বেসরকারি ভেকট্রা (আগে নাম ছিল টেট্রা) সংস্থার যান কেনা নিয়েই বিতর্ক। সংস্থাটি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এ ভাবে তাদের সুনাম ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে। কী পদক্ষেপ করা যায়, সে ব্যাপারে তারা শীঘ্রই সিদ্ধান্ত নেবে। |
কী ব্যবস্থা সিবিআই তদন্তের নির্দেশ |
গুরুতর অভিযোগ।
আমাদের বিষয়টা দেখতে
হবে। আমি ব্যবস্থা নিয়েছি।
এ কে অ্যান্টনি
প্রতিরক্ষামন্ত্রী
|
নীরবতা এবং দ্বিধাই
অ্যান্টনির কাজের ধরন।
এটা দেশের ক্ষতি করছে।
যশোবন্ত সিংহ
প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী
|
সেনাপ্রধানকে যখন ঘুষ
দিতে চাওয়া হল, তখন
এফআইআর করেননি কেন? মণীশ তিওয়ারি
কংগ্রেস মুখপাত্র |
যে অভিযোগ আনা হয়েছে,
তার প্রতিক্রিয়া জানাতে
আমার মর্যাদায় বাধছে।
জেনারেল দীপক কপূর
প্রাক্তন সেনাধ্যক্ষ |
|
তাঁর জন্মসাল ১৯৫০ না ১৯৫১, তা নিয়ে সরকারের সঙ্গে আইনি লড়াইয়ে জড়িয়েছিলেন সেনাপ্রধান। শেষ পর্যন্ত ১৯৫০ সাল-ই তাঁর জন্মসাল বলে মেনে নিতে বাধ্য হন তিনি। সুপ্রিম কোর্ট এ নিয়ে বিতর্ক তৈরির জন্য তাঁকে ভর্ৎসনাই করেছিল। জেনারেল সিংহের ইঙ্গিত, ওই বিতর্কটি তৈরি করা হয়েছে। কিছু লোক নিজের স্বার্থে এই বিতর্ক জিইয়ে রেখেছিল। তাঁদের মধ্যে সেনার প্রাক্তন এবং বর্তমান, দুই ধরনের অফিসাররাই আছেন। তাঁর দাবি, সেনাবাহিনীকে কিছু লোক নিজের স্বার্থে ব্যবহার করবে এটা হতে দেননি বলেই তাঁকে পাল্টা আক্রমণ সহ্য করতে হয়েছে। তাঁর কথায়, “ভাবুন, আমাকে, দেশের সেনাপ্রধানকে ঘুষ দিতে চাওয়া হচ্ছে!” সামগ্রিক ভাবে সেনাবাহিনীর ‘নৈতিকতা ও সততার মান’ নেমে যাওয়ার ফলেই এক অবসরপ্রাপ্ত অফিসার সেনাপ্রধানকে সরাসরি ঘুষ নেওয়ার কথা বলতে পারেন বলেই তাঁর মত।
কংগ্রেস ও বিজেপি, দু’দলের নেতারাই আজ প্রশ্ন তুলেছেন, সেনাপ্রধান নিজে সেই প্রাক্তন সেনা অফিসারকে কেন গ্রেফতার করালেন না বা তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর করলেন না? জেনারেল সিংহের জবাব, “এমন তো নয় যে কেউ আপনার হাতে ঘুষের টাকা গুঁজে দিয়েছিল। পরোক্ষ ভাবে ঘুষ দিতে চাওয়া হয়েছিল। সেনা থেকে সদ্য অবসর নেওয়া অফিসার এসে এ-কথা সে-কথার মধ্যে বলছেন, ওই ফাইলটা যদি আপনি ছেড়ে দেন, আপনাকে ১৪ কোটি দেওয়া হবে।”
জেনারেলের ব্যাখ্যা, কথাটা বুঝতে বুঝতেই তাঁর সময় লেগেছিল এবং এমন কথা যে কোনও প্রাক্তন অফিসার বলতে পারেন, তা ভেবে তিনি হতভম্ব হয়ে যান। তার পরেই তিনি ওই প্রাক্তন অফিসারকে ঘর ছেড়ে চলে যেতে বলেন এবং বিষয়টি প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে জানান। প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ সব লোকের থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেন। সেনাপ্রধান জানিয়েছেন, এখন তাঁর মনে হচ্ছে যে এফআইআর দায়ের করলেই ভাল হত।
সেনাপ্রধানের পাশে না দাঁড়ালেও বিজেপি অবশ্য রাজনৈতিক ভাবে এ কে অ্যান্টনি তথা মনমোহন-সরকারকে আক্রমণের রাস্তা নিয়েছে। বিজেপি নেতা যশোবন্ত সিংহ বলেন, “অ্যান্টনিকে যখন বলা হয়েছিল, তিনি কেন ব্যবস্থা নেননি? নিশ্চয়ই সেনাপ্রধান হতাশ হয়ে সংবাদ মাধ্যমে গিয়েছেন।”
অ্যান্টনির ‘সিদ্ধান্ত না নেওয়ার ক্ষমতা’, প্রধানমন্ত্রীর ‘মূক দর্শক হয়ে থাকা’ নিয়ে কটাক্ষ করে যশোবন্ত বলেন, “এটাই এই সরকারের কাজের শৈলী!” |
|
|
|
|
|