|
|
|
|
জালে লক্ষ্মণ |
লক্ষ্মণদের কড়া শাস্তি চায় স্বজনহারা নন্দীগ্রাম |
আনন্দ মণ্ডল • মেদিনীপুর |
হল মিছিল। ফাটল বাজি। নন্দীগ্রাম নিখোঁজ-কাণ্ডে মুম্বইয়ে তমলুকের প্রাক্তন সাংসদ, হলদিয়ার একদা ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ’ সিপিএম নেতা লক্ষ্মণ শেঠের গ্রেফতারের খবর শনিবার এ ভাবেই ‘উদ্যাপন’ করল নন্দীগ্রাম।
মিছিলের পুরোভাগে এ দিন যাঁরা, তাঁদের অনেকের স্মৃতিতেই ২০০৭-এর ১০ নভেম্বর এখনও ‘দগদগে’।
সে দিনের কথা ভাবলে আজও শিউরে ওঠেন গাঙড়ার সেই আশি ছুঁই-ছুঁই বৃদ্ধা কল্পনা মুনিয়ান। নন্দীগ্রামে জমি-রক্ষার লড়াইয়ে সামিল হয়েছিলেন বৃদ্ধা। ২০০৭-এর ১০ নভেম্বর গোকুলনগর করপল্লি পেরিয়ে মহেশপুরের দিকে এগোচ্ছিল ভূমি-উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির মিছিল। সেই মিছিলের উপরেই গুলি চলে। পেটে, পায়ে, হাতে গুলি লেগেছিল কল্পনাদেবীর।
বৃদ্ধা বলেন, “ওই অবস্থাতেই পলিথিনে ঢেকে, দড়ি দিয়ে বেঁধে ভ্যান রিকশায় চাপিয়ে আমায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল খেজুরিতে। সঙ্গে আমারই মতো রক্তাক্ত আরও দু’জন। পরে জেনেছিলাম, ওরা ভিকেন গায়েন আর যাদব পাল। সাউদখালি-সোনাচূড়ার ওরাও মিছিলে গিয়ে গুলি খেয়েছিল।” একটু থেমে, কাঁপা-কাঁপা গলায় বৃদ্ধা বলে চলেন, “কামারদা থেকে আমাদের একটা গাড়িতে তুলে হেঁড়িয়া হয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। |
নিখোঁজ যাঁরা |
|
|
|
|
|
|
সত্যেন গোল |
আদিত্য বেরা |
বলরাম সিংহ |
ভগীরথ মাইতি |
নারায়ণ দাস |
সুবল মাঝি |
|
কোন দিকে, বুঝতে পারছিলাম না। গাড়িতে ছিল সিপিএমের কয়েকজন নেতা। একেবারে শেষ করে দেওয়ার ভয় দেখাচ্ছিল। এগরায় আমাদের গাড়ি আটকায় কিছু লোক। আমাদের উদ্ধার করে। ধরা পড়ে সিপিএম নেতারা।” ওই সিপিএম নেতাদের মধ্যেই ছিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতার সেই তপন ঘোষ, সুকুর আলি। ‘অপরাধমূলক উদ্দেশ্যে অপহরণে’র অভিযোগে গ্রেফতার হন ওই সিপিএম নেতারা। কিন্তু পরে জামিন পেয়ে যান। ছোট আঙারিয়া গণহত্যা মামলার সূত্রে তপন-সুকুর আরও কিছু দিন জেলবন্দি থাকলেও পরে ‘প্রমাণাভাবে’ সেখান থেকেও খালাস পেয়ে যান!
কল্পনাদেবীদের মামলাটা ধামাচাপাই পড়ে গিয়েছিল। রাজ্যে পালাবদলের পরে কয়েক মাস আগে নন্দীগ্রাম নিখোঁজ-কাণ্ডে হাইকোর্টের নির্দেশে সিআইডি তদন্ত শুরু হয়। তদন্তের সূত্রে সিআইডি অফিসারেরা ফের কল্পনাদেবীর জবানবন্দি নথিভুক্ত করেন। সেই থেকেই ফের বিচারের আশায় বুক বেঁধেছেন বৃদ্ধা। শনিবার লক্ষ্মণ শেঠের গ্রেফতার হওয়ার খবরে সেই আশাই আরও বেড়েছে। সোনাচূড়া বাজার, নন্দীগ্রাম রাজার, গড়চক্রবেড়িয়া, তেখালি থেকে সেই গোকুলনগরের করপল্লি পর্যন্ত শনিবার সন্ধ্যায় মিছিল করেন নন্দীগ্রামের কয়েকশো বাসিন্দা। আনন্দে বাজিও ফাটান। সোনাচূড়ার মিছিলে ফের সামনের সারিতেই ছিলেন কল্পনাদেবী।
নন্দীগ্রাম-কাণ্ডে লক্ষ্মণ শেঠকেই প্রধান অভিযুক্ত মনে করেন ২০০৭-এর ১০ নভেম্বর থেকে ‘নিখোঁজ’ আদিত্য বেরা, সুবল মাজি, নারায়ণ দাস, সত্যেন গোল, বলরাম সিংহ, ভগীরথ মাইতি-র পরিজনেরা। লক্ষ্মণবাবু, অমিয় সাউ, অশোক গুড়িয়াদের গ্রেফতারের খবরে ‘খুশি’ স্বজনহারা মানুষজন। সেই সঙ্গে সতর্কও। ভগীরথের স্ত্রী সুষমা যেমন বলছেন, “সুশান্ত ঘোষও জেলে ছিলেন। কিন্তু এখন তো ফের জামিন পেয়ে বাইরে। লক্ষ্মণবাবুরা যেন জেলেই থাকেন। অপরাধীদের কঠোর শাস্তি চাই।”
২০০৭-এর ওই নভেম্বরের এই ঘটনা নিয়ে রাজ্য প্রশাসনের দুই শীর্ষ ব্যক্তিত্বের প্রতিক্রিয়া ছিল একেবারেই দুই মেরুর। তদানীন্তন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধীর বিবৃতিতে লেখা হয়েছিল ‘দীপাবলির আলো, আনন্দ ম্লান’ হয়ে যাওয়ার বেদনাবোধ। আর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, “দে হ্যাভ বিন পেড ব্যাক ইন দেয়ার ওন কয়েন’ (ঢিলের বদলে পাটকেল খেয়েছে)! আর বিমান বসু, শ্যামল চক্রবর্তীর মতো সিপিএমের শীর্ষ নেতারা সে সময় বলেছিলেন, “নন্দীগ্রামে সূর্যোদয় হয়েছে!”
মুখ্যমন্ত্রী তথা শাসকদলের নেতৃত্বের এই মনোভাবেই ‘বিচারের’ সব আশা ছেড়েছিলেন ‘নিখোঁজ’দের পরিবার-পরিজন। জেলা পুলিশ চার বছরে কোনও খোঁজই দিতে পারেনি। গত বছর রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পরেই একমাত্র সাহস করে তাঁরা হাইকোর্টে ‘হেবিয়স কর্পাস’ করেছিলেন। হাইকোর্টের নির্দেশেই এর পর তদন্ত শুরু করেছিল সিআইডি। গত ৩০ জানুয়ারি হলদিয়া আদালতে সিআইডি চার্জশিট দেওয়ার পরেও মনে খটকা ছিল আদিত্যবাবুর পুত্রবধূ শ্যামলী বেরা, সুবল মাজির স্ত্রী কৃষ্ণাদেবীর। ওঁদের কথায়, “লক্ষ্মণ শেঠরা ধরা না পড়লে আর বিচার হবে কী করে ভাবতাম। মনে হচ্ছে এ বার কিছু হবে।” ‘নিখোঁজ’ নারায়ণ দাসের স্ত্রী সজলবালার দাবি, “ওদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।”
|
নিজস্ব চিত্র |
|
|
|
|
|